মাহে রমজান : আল্লাহভীতি ও আল্লাহপ্রীতির মাস
১২ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২৩ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০১:৩৪ পিএম
মাহে রমজান, সিয়াম সাধনা ও কিয়াম অনুশীলনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস। এ মাস কেবল উপবাস ব্রত বা সংযমের নয় বরং এ মাস আত্মসংশোধনেরও। এ মাস সহমর্মিতার, সহযোগীতার। এ মাস আল্লাহর ধ্যানের, এ মাস আল্লাহকে জ্ঞানের । এ মাসে বান্দাহগণ বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ ও নির্দেশনা পালন করে তাঁরই নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। পাপরাশি মোচনের অবারিত সুযোগ পেয়ে প্রতিটি বান্দাহ নিজেকে পাপমুক্ত করার নিদারুন সৌভাগ্য লাভ করে। রমজানের প্রথম দশকে সারা দুনিয়ায় মহান রবের রহমতের অবিরত ধারা বর্ষিত হয়। রহমতের এ ফল্গুধারায় মুমিন হৃদয় সিক্ত হয়, কোমল হয়। কঠিন পাষাণ অশান্ত হৃদয় রহমত সুধা পেয়ে প্রশান্তি লাভ করে। বান্দাহগণ মহান রবের কুদরতী চরনে লুটিয়ে পড়ে পাপের অনুশোচনা প্রকাশ করে, দুচোখ থেকে নোনাজল ছড়িয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে। বান্দাগণের এ নিদারুন দৃশ্য দেখে মহান রব বান্দাহদেরকে দয়া ও ক্ষমার আওতায় অর্ন্তভূক্ত করেন। সিয়াম সাধনার এ শুভক্ষণ কল্যাণকামী মুমিনের জীবনে নিয়ে আসে নতুন এক শুভ ও স্বার্থক অধ্যায়।
মাহে রমজান মহান প্রভুর নীতিতে খোদাভীতি অর্জনের তাগিদ দেয়। এ মাস বান্দাহদেরকে রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত অর্জন করার অবারিত সুযোগ দেয়। এর পাশাপাশি বান্দাহদেরকে সকল প্রকার মন্দকাজ, অশ্লীলতা, ভ্রষ্টতা সর্বোপরি আল্লাহর ক্রোধ উদ্রেককারী কাজ থেকে দুরে থাকতে কঠিন নির্দেশনাও দেয়। সত্যিই মাহে রমজানের প্রতিক্ষণ কল্যাণের, সৌভাগ্যের, পাপ মোচনের, জাহান্নাম থেকে চির মুক্তির। তাইতো মুহাক্কিক ওলামাগণ বলেন, ‘মাহে রমজান অনন্য ও অনুপম বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্টমন্ডিত’।
মাহে রমজান যে সকল অনন্য ও অনুপম বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত তা হলো-
১. পবিত্র কোরআন ও আসমানী কিতাবসমুহ নাযিলের মাস: মহান আল্লাহপাক রমজান মাসে সকল আসমানী কিতাব নাযিল করেন। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইবরাহিম (আ.)-এর ওপর সহিফাগুলো রমজানের প্রথম রাতে অবতীর্ণ হয়। রমজানের ষষ্ঠ দিনে তাওরাত অবতীর্ণ হয়। ১৩ রমজানে ইনজিল অবতীর্ণ হয়েছে। জাবুর রমজানের ১৮তম দিনে অবতীর্ণ হয়। কোরআন অবতীর্ণ হয় রমজানের ২৪তম দিনে।’ (মুসনাদে আহমাদ: হাদিস: ১৬৯৮৪)।
২. রোজাদের জন্য সুপারিশের মাস: কোরআন মাজিদ ও রোজা আল্লাহর দরবারে রোজাদার ব্যক্তির মুক্তির জন্য সুপারিশ করে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘রোজা ও কোরআন মানুষের জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে আমার রব, আমি তাকে খাবার ও প্রবৃত্তি পূরণে বাধা দিয়েছি। তাঁর ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কোরআন বলবে, আমি তাঁকে রাতের বেলা ঘুমাতে বাধা দিয়েছি। অতএব, তাঁর ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। অতঃপর উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদে আহমদ: হাদিস: ৬৫৮৯)।
৩. সালাতুত তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের মাস: রাসুল (সা.) অন্যতম সুন্নাহ হলো সালাতুত তারাবীহ, এছাড়া তিনি রমজান মাসে অধিক পরিমান তাহাজ্জুদ পড়তেন। তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, ক্বিয়ামে রামাজান, ক্বিয়ামুল লায়েল সবকিছুকে এক কথায় ‘সালাতুল লায়েল’ বা ‘রাত্রির নফল সালাত’ বলা হয়। তারাবীহ এর ফযিলত প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রামজানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রাত্রির সালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’। (মিশকাত: হাদিস: ১২৯৬)। তাহাজ্জুদ সালাত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ফরয সালাতের পরে সর্বোত্তম সালাত হ’ল রাত্রির (নফল) সালাত’। (মিশকাত: হাদিস: ২০৩৯)।
৪. তাওবা ও পাপ মোচনের মাস: এ মাসে সকল রোজাদার তাদের পূর্বকৃত গোনাহের জন্য অনুতপ্ত হন, তাঁরা বিনীত হয়ে মহান দয়াময় আল্লাহর দরবারে তাওবার দরখাস্ত করেন। আল্লাহপাক তাওবাকারী ব্যক্তির তাওবা কবুল করে পাপ মোচন করে দেন। আল্লাহপাক বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’ (সূরা আত-তাহরীম: আয়াত: ৮)। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ রাতের বেলা তাঁর হাত প্রসারিত করেন, যাতে দিনের অপরাধীরা তাওবা করতে পারে। আর তিনি অনুরূপ দিনে তাঁর ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন, যাতে অপরাধীগণ তাওবা করতে পারে। এমন চলতে থাকে যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিমাকাশে উদিত হয়’ (সহিহ মুসলিম: হাদিস: ২৭৫৯)। তিনি সতর্কবানী উল্লেখ করে বলেন, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে রমজান মাস পেলো, অথচ নিজের গোনাহ মাফ করাতে পারলো না’ (সুনানে তিরমিজি: হাদিস: ৩৫৪৫)।
৫. জান্নাতের দ্বার উম্মুক্ত ও জাহান্নামের দ্বার বন্ধকরণ এবং শয়তানকে শৃংখাবদ্ধ করণের মাস: এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান উপস্থিত হয়, জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুষ্ট শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়।’ (মুসলিম: হাদিস : ১০৭৯)।
৬. দানশীলতা, বদান্যতা ও অনুগ্রহের মাস: রমজান মাসে দরিদ্র ও নিঃস্ব জনগোষ্ঠীর প্রতি ধনী ও স্বচ্ছল রোজাদার ব্যক্তিদের দানশীলতা, বদান্যতা ও অনুগ্রহ বৃদ্ধি পায়। সর্বোত্তম দানশীলতা, বদান্যতা ও অনুগ্রহে অতুলনীয় পরম আদর্শ ছিলেন স্বয়ং রাসুল (সা.)। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, রমজান মাসে যখন হজরত জিবরাইল (আ.) নিয়মিত আসতে শুরু করতেন, তখন তাঁর দানশীলতা বহুগুণ বেড়ে যেত। (সহীহ বুখারি)। হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, ‘আমি নবী করিম (সা.)-এর চেয়ে কাউকে অধিকতর দয়ালু দেখিনি।’ (সহীহ মুসলিম)।
৭. বিভীষিকাময় জাহান্নাম হতে মুক্তির মাস: পবিত্র রমজানের শেষ দশকে মহান আল্লাহপাক অসংখ্য বান্দাহকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যাদের উপর জাহান্নাম নিশ্চিত হয়ে যায়। রাসুল (সা.) বলেন ‘রোজা (জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য ) ঢালস্বরূপ।’ (বুখারী: হাদিস:১৮৯৪)। তিনি আরও বলেন , ‘যে ব্যাক্তি আল্লাহর পথে একদিন রোযা রাখবে, আল্লাহপাক ঐ একদিন রোযার বিনিময়ে তার চেহারাকে জাহান্নাম হতে সত্তর বছর (পরিমাণ পথ) দূরে রাখবেন।’ (বুখারী: হাদিস: ২৮৪০)।
৮. লায়লাতুল কদরের মাস: হাজার মাসের চাইতেও শ্রেষ্ঠ হলো একটি মাত্র রাত, যেটিকে কোরআন মাজিদ লাইলাতুল কদর নামে অবিহিত করা হয়। কেননা এ রাতে পবিত্র কোরআন নাযিল হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামকে সমভিব্যহারে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তিধারা চলতে থাকে উষা বা ফজর পর্যন্ত। (সুরা আল কদর: আয়াত:১- ৫ )।
৯। নেক আমলের প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধির মাস: আল্লাহপাক বান্দার নেক আমলের প্রতিদান রমজানের উসিলায় বহুগুণ বৃদ্ধি করেন। তিনি রোযাদারের মর্যাদাকেও বাড়িয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকীর সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত আল্লাহপাক বলেন, কিন্তু রোযা আলাদা। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে। (সহীহ মুসলিম: হাদীস: ১১৫১; মুসনাদে আহমাদ: হাদীস: ৯৭১৪)।
১০. ধৈর্য্য ও কৃতজ্ঞতার মাস: পবিত্র রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি ধৈর্য্য ও কৃতজ্ঞতাবোধের প্রশিক্ষণ লাভ করে। দীর্ঘসময় পানাহার ও অনান্য বৈধ কার্যাবলী থেকে বিরত থাকার ধৈর্য তাকে প্রকৃত ইনসান বা মানুষ বানায়, যার ফলে সে কৃতজ্ঞতা জানার ও প্রকাশের সুযোগ পায়। আল্লাহপাক বলেন, হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। (সূরা বাকারা: আয়াত : ১৫৩)। তিনি আরো বলেন, তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা আদায় কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অস্বীকার কর তাহলে আমার আজাব অবশ্যই কঠিন। (সূরা ইবরাহীম : আয়াত: ৭) পরিশেষে, মহান আল্লাহপাক আমাদের রমজানের অগণিত ফযিলত লাভের নিমিত্তে এর যথাযথ কদরখানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর, মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নওগাঁর আত্রাই পৈসাতা গ্রামে ৩জনকে পিটিয়ে জখম আহতদের উদ্ধার করে ৯৯৯ পুলিশ
মাদারীপুরে গুড়ি বৃষ্টি আর হিমেল বাতাসে জনজীবন স্থবির
দুমকীতে বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফনে বাঁধা
দুবাই মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীর অ্যাওয়ার্ড লাভ
'বরবাদ' সিনেমা শতকোটির গন্ডি পেরিয়ে যাবে! কি বললেন শাকিব?
রাজশাহীর পুঠিয়ায় বাস চাপায় মা ছেলেসহ একই পরিবারের তিনজন নিহত
দোয়ারাবাজারে ভারতেীয় সীমান্তে ৩০০ বস্তা রশুন আটক করেছে টাস্কফোর্স
রাজশাহীতে নেসকোর ভৌতিক বিল বন্ধসহ নানারকম হয়রানীর প্রতিবাদে বিক্ষোভ
শ্যামনগর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার
যুবদলের উদ্যোগে ৩১ দফা অবহিতকরণে আলোচনা সভা
এমাজউদ্দীন আহমদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বজনীন
বাংলাদেশে সা'দ পন্থিদের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে: হাটহাজারীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে বক্তারা
ভারত বাধা পেরিয়ে শিরোপা জিততে মরিয়া বাংলাদেশ
দোয়ারাবাজারে ভ্যানের ধাক্কায় শিশু নিহত
গারো পাহাড়ের পানি হাতায় ঘুরতে এসে ভোগা নদীতে ডুবে ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
সিলেট-তামাবিল চার লেন উন্নতিকরণে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ
১০ বছর আগে উধাও মালয়েশিয়া বিমানের নতুন করে খোঁজ শুরু
৯/১১-র ধাঁচে রাশিয়ায় ড্রোন হামলা ইউক্রেনের, বন্ধ বিমানবন্দর
আজ ঐতিহ্যবাদী লেখক হোসেন মাহমুদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী
দ. আফ্রিকাকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের অভিযানে পাকিস্তান