প্রশ্ন: বিদায় হজের গুরুত্ব কি?

Daily Inqilab ইনকিলাব

২১ জুন ২০২৩, ০৮:০০ পিএম | আপডেট: ২২ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম

উত্তর : আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ:) কে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় যে হেদায়েতের ওয়াদা দিয়েছিলেন (সুরা বাকার : ৩৮) যুগে যুগে তা (নবী-রাসুল ও আসমানি কিতাব পাঠিয়ে) বাস্তবায়িত করে সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ (সা.) এর মাধ্যমে সে ওয়াদার পূর্ণতা দান করেন। সর্বশেষ আসমানি কিতাব কোরআন মাজিদ নাজিল করে অহির দরজাও চিরতরে বন্ধ করার ইচ্ছা করেন। তাই তাঁর রাসুলকেও আর পৃথিবীতে রেখে কষ্ট দিতে চান নাÑ সে ইঙ্গিতও দিয়ে দিলেন। নবী করিম (সা.)ও সেটা বুঝে ছিলেন। এজন্য ১০ হিজরিতে হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) কে ইয়ামনের গভর্নর করে পাঠানোর সময় তিনি বলেছিলেন, ‘হে মুয়াজ এ বছরের পর আমার সঙ্গে হয়তো তোমার আর সাক্ষাৎ নাও হতে পারে, তখন হয়তো তুমি আমার এ মসজিদ কিংবা কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২০৫২) তাই আল্লাহর দীন পূর্ণতার ঘোষণা ও রাসুলকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য একটি মহাসমাবেশের প্রয়োজন ছিল। কারণ যে দ্বীনের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসুলরা মার খেয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, সে দ্বীন আজ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত। নবী মুহাম্মাদ (সা.) যে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য মক্কার মুশরিকদের গালি খেয়েছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, তায়েফের মাটিতে রক্তে পা রাঙিয়েছেন, বদর ও উহুদে জখম হয়েছেন সে দ্বীন আজ আরবের ঘরে ঘরে প্রবিষ্ট। তাই আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা হলো তাঁর রাসুলকে এ দৃশ্য দেখিয়ে শেষ জীবনে কিছুটা আনন্দ দেবেন এবং রাসুলের মাধ্যমে মূল্যবান কিছু উপদেশ বান্দাদের শোনাবেন যাতে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের জন্য তা হেদায়েত হতে পারে। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে হজের ঘোষণা এলো। এ হজ নবীজির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ যে মানুষদের তিনি তিলে তিলে ২৩ বছর সময় লাগিয়ে কোরআনের রঙ লাগিয়েছেন সে মানুষগুলো আসলে কতটুকু কোরআনের রঙে রেঙেছেন, কতটুকু আল্লাহ ও রাসুলভক্ত হয়েছেন, ধর্মের জন্য তাদের মনোভাব কেমন তৈরি হয়েছে ইত্যাদি বিষয়গুলো জানার দরকার ছিল। সে সঙ্গে মাতৃভূমি ও কাবার দর্শন, আত্মীয়-স্বজন ও নবদীক্ষিত মুসলিমের খোঁজখবর নেয়াসহ সকল সাহাবির সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়ের প্রয়োজন ছিল। তাই আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই হজের ঘোষণা সারা আরবে প্রচারের নির্দেশ দেন।

প্রিয়নবী (সা.) হজ করবেনÑ ঘোষণা শুনে দিগি¦দিক থেকে সাহাবিরা দলে দলে সমবেত হতে আরম্ভ করেন। প্রত্যেকেরই ইচ্ছা রাসুল (সা.) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেকে ধন্য করার পাশাপাশি ঐতিহাসিক এক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকা। প্রিয় মনীষীর পবিত্র জবান থেকে মূল্যবান নসিহত গ্রহণ করা। বিশ্বজগতের অধিপতির ঘরে বিশ্বনবীর কদম পড়বে সে কী গৌরব ও মর্যাদার কথা! সঙ্গে থাকবেন তাঁর অনুগত ভাগ্যবান সাহাবিদের জামাত সে কী আনন্দের কথা! একে একে বহু লোকের সমাবেশ ঘটল। পরিশেষে ১০ হিজরির জিলকদ মাসের ৪ দিন অবশিষ্ট থাকতে শনিবার রাসুল মক্কা অভিমুখে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। আনন্দের সঙ্গে চুলে তেল লাগিয়ে চিরুনি করে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হন। এরপর কুরবানির পশুগুলোকে বিশেষ চিহ্নমূলক হার পরিয়ে জোহরের নামাজের পর মদিনা থেকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে ‘জুল হোলাইফা’ নামক স্থানে যাত্রা বিরতি দেন এবং পরদিন জোহরের নামাজ আদায় করে হজের ইহরাম বেঁধে ঐতিহাসিক ‘কাসওয়া’ উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে ‘লাব্বায়িক’ ধ্বনি তোলে সাহাবিদের নিয়ে পথচলা শুরু করেন। সপ্তাহব্যাপী পথ চলার পর একদিন বিকাল বেলায় মক্কার নিকটবর্তী জি’তাওয়া নামক স্থানে পৌঁছে যাত্রা বিরতি করে সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরের দিন সকালে মক্কা মোকাররমায় প্রবেশ করেন। দিনটি ছিল ১০ হিজরির ৪ জিলহজ রবিবার। অতঃপর কাবার তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সায়ী করে ওমরার কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু ইহরাম ভঙ্গ করেননি। কারণ তিনি হজ ও ওমরার নিয়ত একই সঙ্গে করেছিলেন। এরপর মক্কার উপরিভাগে অবস্থিত ‘হাজুন’ নামক স্থানের পাশে অবস্থান নেন। এরপর ৮জিলহজ থেকে হজের কাজ শুরু করেন। ৯জিলহজ আরাফায় পৌঁছেন। সেখানে বিকাল বেলা এক লাখ চল্লিশ হাজার মতান্তরে একলাখ পঞ্চাশ হাজার জনতাকে লক্ষ্য এক মর্মস্পর্শী ভাষণ প্রদান করেন। ইতিহাসে সে ভাষণ ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে পরিচিত। সে ভাষণকে অনেকে ‘মানবতার মুক্তিসনদ’ নামেও আখ্যায়িত করেছেন। সে ভাষণটি ছিল মানবতার পক্ষে, দানবতার বিপক্ষে। সত্য ও সুন্দরের সমর্থনে, মিথ্যা ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে। যাবতীয় অন্যায়, অশ্লীলতা, কুসংস্কার ও জাহেলি যুগের রেওয়াজ-রসমের চিরতরে কবর রচনার নিমিত্তে। সে ভাষণের মধ্য দিয়ে ইসলামের শাশ^ত সৌন্দর্য বিশ^বাসীর কাছে বুলন্দ করেন। এবং ভক্তদের কেয়ামত পর্যন্ত সুন্দর ও সঠিক পথে চলার নির্দেশনা দেন। ভাষণটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলোÑ

তিনি বলেন, ‘হে লোক সকল, তোমাদের জান, মাল ও সম্পদ আজকের পবিত্র আরাফার দিন, পবিত্র জিলকদ মাস ও বরকতময় নগরী মক্কার মতোই পবিত্র। আজ থেকে বর্বর যুগের যাবতীয় রেওয়াজ-রসম আমার পদতলে পিষ্ট হলো। জাহেলি যুগের শোণিতধারা চিরতরে রহিত হলো। সুদের কারবার নিষিদ্ধ করা হলো। সবসময় আল্লাহকে ভয় করবে। বিশেষ করে মহিলাদের বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকবে। তারা তোমাদের কাছে আল্লাহর আমানত স্বরূপ। তাদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করবে। আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকবে। স্মরণ রাখবে, আমার পরে নতুন কোনো নবীর আগমন ঘটবে না কাজেই তোমাদের পরে কোনো উম্মত হওয়ারও প্রশ্ন আসে না। অতএব ঠিক মতো আল্লাহর আনুগত্য করবে। পাঁচওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজ, মালের জাকাত ও সামার্থ্য থাকলে নিজ প্রভুর ঘরের হজ করবে, তবেই প্রভুর ওয়াদা মোতাবেক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে হজরত তাঁর কথা শেষ করলে আল্লাহতায়ালা এবার তাঁর দ্বীনের ব্যাপারে চূড়ান্ত ঘোষণা পাঠান। নাজিল হয় কোরআনের এ আয়াত ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবুল করলাম।’ (মায়িদাহ : ৩) বিদায় হজের পর রাসুল (সা.) আশি বা তিরাশি দিন জীবিত ছিলেন।

উত্তর দিচ্ছেন: আবদুল আউয়াল, কবি ও কলামিস্ট


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ইসলামি অর্থনীতির স্বরূপইসলামি অর্থনীতির স্বরূপ
হাজারো পীর-আউলিয়ার শিরোভূষণ সৈয়দ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ঘুষ : দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ
আরও

আরও পড়ুন

মাগুরার শালিখায় অজ্ঞাত বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার

মাগুরার শালিখায় অজ্ঞাত বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার

আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু

আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু

বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন

বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন

২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের

২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের

ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা

চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা

চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত

চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত

এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে

এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে

ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী

ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী

আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ

আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ

বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত

বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত

মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০

মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক

ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন

ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন

কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু

কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু

আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ

আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ

ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী

ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী

সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের

যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের

পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন

পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন