ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

আল কুরআনে নূর প্রসঙ্গ-৩

Daily Inqilab এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী

১৩ জুন ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ১৩ জুন ২০২৪, ১২:০৯ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে “নূর” শব্দটির আভিধানিক ও ব্যবহারিক অর্থ ও সংজ্ঞার প্রতি খেয়াল করে একে বস্তুু বলে সাব্যস্ত করা চূড়ান্ত বোকামী ছাড়া কিছুই নয়। কারণ, আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালার যাত বা সত্তার জন্য ব্যবহৃত “নূর” শব্দটির অর্থ সকল তাফসীরবিদদের মতে “মুনাব্বির” অর্থাৎ ঔজ্জ্বল্যদানকার,ি আলোদানকারী। অথবা অতিশয়ার্থবোধক পদের ন্যায় নূরওয়ালাকে নূর বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন আরবী ভাষায় দানশীলকে “দান” বলে ব্যক্ত করা হয় এবং ন্যায়পরায়ণকে ন্যায়পরায়নতা বলে আখ্যায়িত করা হয়। আল কুরআনের নি¤েœাল্লিখিত আয়াত সমূহে আল্লাহ তায়ালার যাত বা সত্তার জন্য “নূর” শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন :

(এক) ইরশাদ হয়েছে : “আল্লাহ তায়ালা নভোমন্ডল ও ভূম-লের নূর”। [সূরা নূর: আয়াত-৩৫]
(দুই) ইরশাদ হয়েছে : “ভূম-ল তার প্রতিপালকের নূরে আলোকিত হয়েছে।” [সূরা যুমার : আয়াত-৬৯]

(তিন) ইরশাদ হয়েছে : তারা ইচ্ছা করে যে, নিজেদের মুখের বুলী দ্বারা আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিবে, অবশ্য আল্লাহ স্বীয় নূরকে পরিপূর্ণ করবেনই। [সূরা সক : আয়াত-৮] তাছাড়া আরোও অনেক আয়াতে নূর শব্দটির ব্যবহার আল্লাহর যাত বা সত্তার জন্য হয়েছে। সুতরাং এ সকল আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহতায়ালা নভোম-ল ও ভূম-ল ও এতদুভয়ের মধ্যে বসবাসকারী সকল সৃষ্ট জীবের নূর দাতা বা আলোদানকারী এবং হেদায়েতকারী। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) এ সকল আয়াতের তাফসীর এভাবে করেছেন : “আল্লাহাক নভোম-ল ও ভূম-লের অধিবাসীদের হেদায়েতকারী।” [তাফসীরে ইবনে কাািসর, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে মাজহারী]

আলোচ্য বিষয়ের আলোচনাকে আরও সহজবোধ ও গ্রহণীয় করার লক্ষ্যে আল কুরআন ও আহাদীসে নাবুবীতে আল্লাহর জন্য “নূর” শব্দটি কি কি ভাবে সাব্যস্ত হয়েছে তা জানা থাকা আবশ্যক। আসুন, এবার আমরা সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার চেষ্টা করি। (এক) আল্লাহর নাম হিসেবে “নূর” শব্দের ব্যবহার। সে সমস্ত বরেণ্য আলেমগণ এটাকে আল্লাহর নাম হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, তারা হলেন (১) হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ খাত্তাবী (রহ:)। (২) হযরত ইবনে মান্দাহ (রহ:)। (৩) হযরত হালিমী (রহ:)। (৪) হযরত বাইহাকী (রহ:) (৪) হযরত ইস্পাহানী (রহ:)। (৫) হযরত ইবনুল আরাবী (রহ:)। (৬) হযরত কুরতুবী (রহ:) (৭) হযরত ইবনুতাইমিয়্যাহ (রহ:) (৮) হযরত ইবনুল কাইয়্যেম (রহ:)। (৯) হযরত ইবনুল ওয়ামীর (রহ:)। (১০) হযরত ইবনে হাজার আসফালানী.... (রহ:) (১১) হযরত আসসাদী (রহ:)। (১২) হযরত আল কাহতানী (রহ:)। (১৩) হযরত আল হামুদ (রহ:) (১৪) হযরত আশ্শারবাসী..... (রহ:)। (১৫) হযরত নূরুল হাসান খান (রহ: প্রমুখ।

(দুই) আল্লাহর গুণ হিসেবে “নূর” শব্দের ব্যবহার। মহান আল্লাহ তায়ালা “নূর” নামক গুণটি নিজের জন্য বিভিন্নভাবে সাব্যস্ত করেছেন। যেমনÑ(১) মহান আল্লাহ তায়ালা কখনো কখনো সরাসরি “নূরকে” নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : “মাছালু নূরিহি কা মিশ্কাতিন” অর্থাৎ আল্লাহর নূরের উদাহরণ হলো যেন একটি দীপাধার।” [সূরা নূর” আয়াত ৩৫] অন্য এক আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন।” আর আলোকিত হল যমীন তার প্রতিপালকের আলোতে [সূরা আয যুমার : আয়াত-৬৯] হাদীস শরীফে এসেছে : আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টিকে অন্ধকারে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি তাতে স্বীয় “নূরের” কিছু ঢেলে দিলেন। সুতরাং এ নূরের কিছু অংশ যার উপরই পড়েছে সে হেদায়েত লাভ করেছে। আর যার উপর পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে।” [জামেয়ে তিরমিজী: ২৬৪২]

(২) কখনো কখনো আল্লাহতায়ালা এ নূরকে তাঁর চেহারার দিকে সম্পর্ক যুক্ত করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন : “আসমান ও যমীনের যাবতীয় নূর আল্লাহরই চেহারার আলো।”[আবু সাইদ আদদারেমী।]

(৩) আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালার নূরকে আসমান ও যমীনের দিকে সম্পর্ক যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: আল্লাহ আসমান ও যমীনের নূর।” [সূরা নূর : আয়াত-৩৫]

এক হাদীসে এসেছে নূর নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, “হে আল্লাহ! আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা, আপনি আসমান ও যমীনের নূর”। অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: “হে আল্লাহ! আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা, আপনি আসমান ও যমীনের নূর এবং এ দুয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তারও।” [সহীহ বুখারী : ১১২০; সহীহ মুসলিম : ১৯৯]

(৪) আল্লাহ আয়ালার পর্দা ও নূর। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন : “তাঁর পর্দা হলো “নূর”। [সহীহ মুসলিম : ২৯৩] আর রাসূলুল্লাহ (সা:) মিরাজের রাতে পর্দার নূরই দেখেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ (সা:) কে জিজ্ঞাসা করে ছিলেন: আপনি কি আপনার রবকে দেখেছিলেন? তিনি বললেন: “নূর”! কিভাবে দেখতে পারি? [সহীহ মুসলিম : ২৯১] অপর বর্ণনায় এসেছে, “আমি নূর দেখেছি।” [সহীহ মুসলিম : ২৯২] এ হাদীসের সঠিক অর্থ হলো- “আমি কিভাবে তাঁকে দেখতে পাব? সেখানে তো নূর ছিল। যা তাঁকে দেখার মাঝে বাধা দিচ্ছিল। আমি তো কেবল “নূর” দেখেছি। এ নূরের পর্দার কারণেই সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে না। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন : “যদি তিনি তাঁর পর্দা খুলতেন, তবে তাঁর সৃষ্টির যতটুকুতে তাঁর নজর পড়ত, সব কিছু তাঁর চেহারার জ্যোতির কারণে পুড়ে ছাই হয়ে যেত।” [সহীহ মুসলিম : ২৯৩-২৯৫] সুতরাং আসমান ও যমীনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দু ধরনের “নূরই” আল্লাহর। প্রকাশ্য নূর যেমন-আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং নূর। তাঁর পর্দা নূরের। যদি তিনি তাঁর সে পর্দা উন্মোচন করেন, তাহলে তাঁর সৃষ্টির যতটুকুতে তাঁর দৃষ্টি পড়বে এর সব কিছুই ভর্স হয়ে যাবে। তাঁর নূরেই আরশ আলোকিত। তাঁর নূরেই কুর্সী, সূর্য, চাঁদ ইত্যাদি আলোকিত। অনুরূপভাবে তাঁর নূরেই জান্নাত আলোকিত। কারণ, সেখানে তো সূর্যই নেই। আর অপ্রকাশ্য নূর যেমনÑ (১) আল্লাহর কিতাব নূর। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : “কাজেই যারা তাঁর (রাসূলুল্লাহ (সা:) প্রতি ঈমান আনে, তাঁকে সম্মান করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং যে নূর তাঁর সাথে নাযিল হয়েছে সেটার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম।” [সূরা আল আ’রাফ: আয়াত-১৫৭] (২) “তাঁর শরীয়ত নূর। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয় আমি তাওরাত নাযিল করেছিলাম, এতে ছিল হেদায়েত ও নূর; নবীগণ যারা ছিলেন অনুগত, তাঁরা ইহুদীদেরকে তদনুসারে হুকুম দিতেন।” [সূরা আল মায়েদাহ : আয়াত-৪৪] (৩) তাঁর বান্দাহ ও রাসূলদের অন্তরে অবস্থিত ঈমান ও জ্ঞান তাঁরই নূর। ইরশাদ হয়েছে : “আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, ফলে সে তার রবের দেয়া নূরের উপর রয়েছে, সে কি তার সমান হতে পারে যে এরূপ নয়”? [সূরা আয যুমার : আয়াত-২২] যদি এ নূর না থাকত, তাহলে অন্ধকারের উপর অন্ধকারে সব কিছু ছেয়ে যেত। সুতরাং সেখানেই তাঁর নূরের অভাব হবে, সেখানেই অন্ধকার ও বিভ্রান্তি দানা বেঁধে থাকে। আর এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা:) দোয়া করতেন : “হে আল্লাহ ! আমার অন্তরে নূর দিন, আমার শ্রবনেন্দ্রিয়ে নূর দিন, আমার দৃষ্টি শক্তিতে নূর দিন, আমার ডানে নূর দিন, আমার বামে নূর দিন, আমার সামনে নুর দিন, আমার পেছনে নুর দিন, আমার নীচে নূর দিন, আর আমার জন্য নূল দিন অথবা বলেছেন আমাকে নূর বানিয়ে দিন। অন্য বর্ণনায় এসেছে- আর আমার জন্য আমার আত্মায় নূল দিন আমার জন্য বৃহৎ নূরের ব্যবস্থা করেদিন। [সহীহ বুখারী : ৬৩১৬; সহীহ মুসলিম : ৭৬৩] (সমাপ্ত)


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা