বিবস্ত্র হওয়া নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ
২৭ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম
শয়তানের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো মানুষকে বিবস্ত্র করা। বিবস্ত্র হওয়া নির্লজ্জতার বহিপ্রকাশ। আর নির্লজ্জতার মাধ্যমেই মানুষ পাপের সা¤্রাজ্যে প্রবেশ করে। লজ্জা মানুষের একটি প্রকৃতিগত ও স্বাভাবিক অনুভূতি। মানুষ নিজের শরীরের বিশেষ স্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করার ব্যাপারে যে লজ্জা অনুভব করে সেটি ঐ স্বাভাবিক অনুভূতির প্রাথমিক প্রকাশ। কুরআন আমাদেরকে জানায়, সভ্যতার ক্রমোন্নতির ফলে মানুষের মধ্যে কৃত্রিমভাবে এ লজ্জার সৃষ্টি হয়নি বা এটি বাইরের থেকে অর্জিত কোন জিনিসও নয়, যেমন শয়তানের কোন সুচতুর শিষ্য ও অনুসারী অনুমান করে থাকে। এবং তারা তথাকথিত আদি মানুষের ন্যাংটা চিত্রকর্ম অংকন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকে। বরং জন্মের প্রথম দিন থেকেই এ প্রকৃতিগত গুণটি মানুষের মধ্যে রয়েছে। তাই শয়তান কারো পদস্খলন সৃষ্টির জন্য তার প্রথম চেষ্টা ও সাধনা হয় কিভাবে তাকে পূর্ণ বা অর্ধ উলঙ্গ করবে। এই উলঙ্গপনার মাধ্যমে প্রথমে তাঁর লজ্জা নামক বিশেষ গুণটিকে তছনছ করে দেয়। আর সে যদি কোন মানুষ থেকে লজ্জা নামক ভূষণটি ছিনিয়ে নিতে পারে, তখন এই ব্যক্তির দ্বারা পৃথিবীর হেন কুকর্ম নেই, যা তার দ্বারা করাতে পারে না। অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ে শয়তানের আর তেমন পরিশ্রম করতে হয় না। কারণ নিলর্জ্জ ব্যক্তি নিজেই তখন শয়তানের এজেন্ট বা শিষ্য হিসাবে কুকর্মে প্রতিণিধিত্ব করে। পৃথিবীর নিলর্জ্জদের দৈনন্দিন কুকর্মের উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে।
আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি যে, জাহেলিয়াতে আরববাসীরা কেবলমাত্র সৌন্দর্য সামগ্রী হিসাবে ও বিভিন্ন ঋতুর প্রভাব থেকে শারীরিকভাবে আত্মরক্ষার জন্য পোশাক ব্যবহার করতো। কিন্তু এর যে প্রাথমিক ও মৌলিক উদ্দেশ্য শরীরের লজ্জাস্থানগুলোকে আবৃত করা, সেটি তাদের কাছে কোন গুরুত্ব লাভ করেনি। নিজেদের লজ্জাস্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে তারা মোটেই ইতস্তত করতো না। প্রকাশ্য স্থানে উলংগ হয়ে গোসল করা, পথে ঘাটে যেখানে সেখানে প্রকাশ্য জায়গায় প্রকৃতির ডাকে উদোম হয়ে বসে পড়া, পরণের কাপড় খুলে পড়ে যেতে এবং লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে যেতে থাকলেও তার পরোয়া না করা ইত্যাদি ছিল তাদের প্রতিদিনের অভ্যাস। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল হজ্জের সময় তাদের অসংখ্য লোকের কা’বার চারদিকে উলংগ হয়ে তাওয়াফ করা। এ ব্যাপারে তাদের পুরষদের চেয়ে মেয়েরাই ছিল কিছু বেশী নিলর্জ্জ। তাদের দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি ধর্মীয় কাজ এবং সৎকাজ মনে করেই তারা এটি করতো। আরবাসীদের এই শয়তানী ভ্রষ্টতা-প্রতারণার প্রতি অংগলী নির্দেশ করে আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ হে বনী আদম! তোমাদের শরীরের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকার এবং তোমাদের দেহের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বিধানের উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছি। আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম। এইগুলো আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম, সম্ভবত লোকেরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।”(সুরা আরাফ:২৬)
আর যেহেতু এটি কেবল আরবদের বৈশিষ্ট্য না বরং দৃনিয়ার অধিকাংশ জাতিও নিলর্জ্জ বেহায়াপনায় লিপ্ত এবং আজো আছে তাই এখানে কেবলমাত্র আরববাসীদেরকে সম্বোধন করা হয়নি বরং ব্যাপকভাবে সারা দুনিয়ার মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে সমগ্র জাতিকে এই বলে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, দেখো শয়তানী প্রতারণার একটি সুস্পষ্ট আলামত তোমাদের নিজেদের জীবনেই রয়েছে। তোমরা নিজেদের রবের পথনির্দেশনার তোয়াক্কা না করে এবং নিজেদের নবী-রাসুলের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছো। আর সে তোমাদেরকে মানবিক প্রকৃতির পথ থেকে বিচ্যুত করে সেই একই নিলর্জ্জতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে যার মধ্যে ইতিপূর্বে সে তোমাদের প্রথম পিতা-মাতাকে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল। এ ব্যাপারে চিন্তা করলে প্রকৃত সত্য তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে।
এ জন্য সারা বিশ^বাসীকে আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিচ্ছেন,“হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদের আবার ঠিক তেমনিভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ না করে যেমনভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার জন্যে তাদেরকে বিবস্ত্র করেছিল। সে ও তার সাথীরা তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাওনা। এ শযতানদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি।”(সুরা আরাফ:২৭) এ আয়াতগুলোতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সুস্পষ্ট হয়ে সামনে ভেসে উঠেছে।
এক: পোশাক মানুষের জন্যে কোন কৃত্রিম জিনিস নয়। বরং এটি মানব প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী। আল্লাহ মানুষের দেহের বহির্ভাগে পশুদের মত কোন লোমশ আচ্ছাদন জন্মগতভাবে তৈরী করে দেননি। বরং লজ্জার অনুভূতি তার প্রকৃতির মধ্যে গচ্ছিত রেখে দিয়েছেন। তিনি মানুষের যৌন অংগগুলোকে কেবলমাত্র যৌনাংগ হিসেবেই তৈরী করেন না বরং এগুলোকে ‘সাও’আত’ও বানিয়েছেন। আরবী ভাষায় ‘সাওআত এমন জিনিসকে বলা হয় যার প্রকাশকে মানুষ খারাপ মনে করে। আবার এ প্রকৃতিগত লজ্জার দাবী পূরণ করার জন্য তিনি মানুষকে কোন তৈরী করা পোশাকও দেননি। বরং তার প্রকৃতিকে পোশাক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যাতে নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করে সে প্রকৃতির এ দাবীটি উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহর সুষ্ট উপাদান ও উপকরণসমূহ কাজে লাগিয়ে নিজের জন্যে পোশাক তৈরী করতে সক্ষম হয়।
দুই: এ প্রাকৃতিক ও জন্নগত উপলব্ধির প্রেক্ষিতে মানুষের জন্যে পোশাকের নৈতিক প্রয়োজন অগ্রগণ্য। অর্থাৎ প্রথমে সে সাওআত তথা নিজের লজ্জাস্থান আবৃত করবে। আর তার স্বভাবগত চাহিদা ও প্রয়োজন দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত। অর্থাৎ তারপর তার পোশাক তার জন্যে দৈহিক সৌন্দর্য বিধান করবে এবং আবহাওয়ার প্রভাব থেকে তার দেহ সৌষ্ঠবকে রক্ষা করবে। এ পর্যায়ে মানুষ ও পশুর ব্যাপার স্বভাবতই ভিন্ন। পশুর শরীরের লোমশ আচ্ছাদন মূলত সৌন্দর্য ও ঋতুর প্রভাব থেকে রক্ষা করে কিন্তু তার লোমশ আচ্ছাদন তার লজ্জাস্থান ঢাকার কাজ করে না। কারণ তার যৌনাংগ আদতে তার ‘সাওআত’ বা লজ্জাস্থান নয়। কাজেই তাকে আবৃত করার জন্য পশুর স্বভাব ও প্রকৃতিতে কোন অনুভূতি ও চাহিদা থাকে না এবং চাহিদা পূরণ করার জন্য কোন পোশাকও সৃষ্টি করা হয় না। কিন্তু মানুষ যখন শয়তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করলো তখন ব্যাপারটি উল্টো হয়ে গেলো। শয়তান তার এ শিষ্যদেরকে এভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হলো যে, তোমাদের জন্যে পোশাকের প্রয়োজন নেই যেমন দরকার নাই পশুর এবং লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার ব্যাপারটি মোটেই কোর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বরং পশুদের অংগ-প্রত্যংগ যেমন তাদের লজ্জাস্থান হিসেবে বিবেচিত হয় না, ঠিক তেমনি তোমাদের এ অংগ-প্রত্যংগগুলোও লজ্জাস্থান নয় বরং এগুলো নিছক যৌনাংগ।
তিন: মানুষের পোশাক কেবলমাত্র তার লজ্জাস্থান আবৃত করার এবং তার শারীরিক শোভাবর্ধন ও দেহ সংরক্ষণের উপায় হবে, এতটুকুই যতেষ্ঠ নয়। বরং আসলে এ ব্যাপারে তাকে অন্তত এতটুকু মহত্তর মানে পৌঁছতে হবে, যার ফলে তার পোশাক তাকওয়ার পোশকে পরিণত হয়। অর্থাৎ তার পোশাক দিয়ে সে পুরোপুরি সতর তথা লজ্জাস্থান ঢেকে ফেলবে। সৌন্দর্য চর্চা ও সাজ সজ্জার মাধমে শরীরের শোভাবর্ধনের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করা যাবে না বা ব্যক্তির মর্যাদার চেয়ে নি¤œমানেরও হবে না । তার মধ্যে গর্ব-অহংকার ও আত্মম্ভারতার কোন প্রদর্শনী থাকবে না।
উলংগপনা আজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। লজ্জাস্থান আবৃত করার পোশাকটিকে কে কতটুকু কাটছাট করতে পারে, তার প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। এটিকে তারা নাম দিয়েছে ফ্যাশন শো। প্রকৃতপক্ষে এটি সুস্পষ্টভাবে বেহায়াপনা ও নিলর্জ্জতার চরম পরাকাষ্ঠা ছাড়া আর কিছই নয় এবং সন্দেহাতীতভাবে শয়তানই তার প্রধান পরামর্শক। অর্থাৎ এটি শয়তানী কাজ। এ জন্যই আল্লাহ তা’আলা বলে দিয়েছেন যে,“ এ শযতানদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি।” যারা এ অশ্লীলতা মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে তারা অবশ্যই শয়তানের শিষ্য এবং শয়তানই তাদের অভিভাবক। কতই না নিকৃষ্ট সেই অভিভাবক। দুর্ভাগা তাদের যারা তার অভিভাবকত্বের আশ্রয় লাভ করেছে।
লেখক: গবেষক, ইসলামী চিন্তাবিদ, কলামিষ্ট।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
চলছে পাল্টাপাল্টি হামলা ,দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে হিজবুল্লাহ!
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবার পূঁজায় প্রশাসন আন্তরিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন
ফরিদপুরে শেখ হাসিনাসহ আ.লীগের ৫০০ নেতাকর্মীর নামে মামলা
বিএনপি ক্ষমতায় এলে নদী ভাঙনের স্থায়ী সমাধান হবে : কৃষক দল
আবারও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা ইসরাইলের
রাউজানে এমপির জানালাবিহীন ‘আয়নাঘর’, মাটির নিচে চলত নির্যাতন-হত্যা
ভেজাল চায়ে চুমুক দিচ্ছেন না তো? এই সহজ উপায়ে চিনে নিন খাঁটি চা
হিলিতে বিভিন্ন পূজা মন্ডব পরিদর্শনে বিএনপির নেতাকর্মীরা
১৭ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা বোয়িং-এর
পাকিস্তানে কয়লা খনিতে হামলা,তেহরানের তীব্র নিন্দা
১০০ বছর পর এভারেস্ট পর্বতারোহীর দেহাবশেষ উদ্ধার
ব্যবহারকারীদের ‘ক্ষতি ও সুরক্ষা’ দিতে ব্যর্থ টিকটকের বিরুদ্ধে মামলা
ইরানের তেল খাতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের সমাপ্তি চায় ইউক্রেন
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানালো জাতিসংঘ
গণহত্যাকারী ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলো নিকারাগুয়া
ইমরানের মুক্তির দাবিতে পিটিআই এর বিক্ষোভের ঘোষণা
এক ঘণ্টায় ইসরায়েলে ১০০ রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর
টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ৫৪ বছর ধরে একই আঙিনায় চলছে নামাজ ও পূজা
ভারতীয় দুই নাগরিক আটক