বাঁচা মরার সংগ্রাম এবং প্রকৃতির নির্বাচন নীতি

Daily Inqilab ইলিয়াজ হোসেন রানা

০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম

গোটা দুনিয়া জুড়ে বাঁচা-মরার সংগ্রাম চলছে, তাই এটা এখন একটা মহা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য সৈন্য পরস্পর যুদ্ধে নিযুক্ত রয়েছে। যে যাকে পারে ঘায়েল করছে, দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে নিজেরে স্থান অধিকার করে নিচ্ছে। প্রতিটি সৈন্যই চাচ্ছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর উপরে জয়ী হতে, নিজে বেঁচে থাকার জন্য অপরকে মেরে ফেলতে। পশুপাখি, বৃক্ষ-গুল্ম, জড়বস্তু, এমনকি সজিব ও নির্জীব সবকিছুই পারস্পরিক আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োযিত রয়েছে। যেহেতু সৃষ্টির প্রয়োজনে ধ্বংস অনিবার্য, প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে লয় অপরিহার্য, তাই অযোগ্য যা, তার লোপ পেয়ে যোগ্যই প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অযোগ্য স্থান ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় যোগ্যতরের জন্য। এই অবস্থার নাম হচ্ছে বাঁচা-মারার সংগ্রাম এবং প্রকৃতির নির্বাচন নীতি। এখন এই বাঁচা-মরার টানা-পোড়নে সাফল্য লাভ করবে সে-ই যার ভেতরে সততা-সুস্থতা রয়েছে; যাকে আমরা স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী বলতে পারি। যুদ্ধক্ষেত্রে যে রূপ শক্তিশালী দল জয়ী হয় এবং দুর্বল দল পরাজিত হয়, তেমনি এই যুদ্ধেও স্বাস্থ্য ও শক্তির অধিকারীই জয়ী হবে এবং দুর্বল ও পঙ্গু পরাজিত ও বিলুপ্ত হবে। এর থেকেই আসে আত্মরক্ষার নীতি। অর্থাৎ এই টানা-পড়নে যারা আত্মরক্ষা ব্যবস্থা সুদূঢ় করে তুলতে পারবে এবং আক্রমণকারীর কাছে কখনো মাথা নত করবেনা তারাই টিকে থাকবে। শক্তি ও স্বাস্থ্যই দুনিয়ার বুকে টিকে থাকার যোগ্যতা রাখে এবং অসুস্থ ও দুর্বল দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নেবেই। প্রকৃতির এই চিরন্তন বিধান পরিষ্কার করে বলে দেয় যে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে, টিকে থাকতে হলে, প্রতিপালিত হতে হলে, জয়ী হতে হলে, শক্তি ও স্বাস্থ্যই হচ্ছে তার অপরিহার্য শর্ত। তাই প্রকৃতির নিয়মই হচ্ছে শক্তিমান কি বেছে নেবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং দুর্বলকে ছাটাই করে ধ্বংস করে দিবে এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নির্বাচনী বিধান। যোগ্যকে বেঁচে থাকার জন্য পৃথক করে নিয়ে সে অযোগ্যকে নির্মূল করে দেবে। ইংরেজিতে একেই বলে “ন্যাচারাল সিলেকশন”।

প্রাকৃতিক নির্বাচনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় যথা: স্বাভাবিক ও কৃত্রিম। স্বাভাবিক নির্বাচনটাই হলো মূল। প্রকৃতি ধীরে ধীরে সে বিবর্তন এনে দেয়। যোগ্যতরকে উৎরিয়ে এনে জঞ্জালগুলো ঝেড়ে ফেলে দেয়। কৃত্রিম নির্বাচন মানুষের হাতে ঘটে। মানুষ বিভিন্ন ধরনের তদবির ও ফিকির চালিয়ে একটি গাছকে সবল ও সতেজ করে তুলতে পারে। তখন সে গাছটির যোগ্যতর হয়ে প্রকৃতির বিধান অনুসারে বেঁচে থাকে। মানুষ কোন একটি ভূখ-কে বিবিধ উপায়ে উত্তম করে তুলে, তা থেকে আগাছা তুলে ফেলে, খাদ ভরে ফেলে চারদিক পরিষ্কার করে দেয়। ফলে তা যোগ্যতর ভূখ-ে পরিণত হয়। বিশেষ এক ধরনের জীবকে এনে মানুষ রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং সর্ববিধ যতœ নেয়, ফলে তা যোগ্যতর হয়ে বেঁচে থাকে। পক্ষান্তরে আরেক ধরনের জীব রক্ষণাবেক্ষণ ও যতেœর অভাবে তাড়াতাড়ি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। দলগতভাবে মানুষের অবস্থা লক্ষ্য করলে সেখানেই একই অবস্থা দেখতে পাবো। শক্তি ও সামর্থ্যের অধিকারী পরিবার দুর্বল পরিবারগুলোকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করে চলেছে। শক্তিশালী জাতি দুর্বল জাতিগুলোকে ধ্বংস করে চলছে। যে দল বা জাতির হাতে শক্তি ও সামর্থ্য রয়েছে, তারা শক্তির প্রাকৃতিক দাবি নিয়ে ঘোষণা করে, “আল্লাহর পৃথিবী আমাদের জন্যে”। কারণ, আমরা শক্তিমান। সাথে সাথে পৃথিবীর আর সব দুর্বল জাতি তাদের সামনে মাথা ঝুকিয়ে দিতে বাধ্য হয় এবং তাদের জন্য স্থান ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। এভাবেই সবল জাতি এসে দুর্বল জাতির স্থান দখল করে নেয়। এটাই হচ্ছে সেই যোগ্যতরের বেঁচে থাকার বিধান। যোগ্যতর জাতি এসে দুর্বলতর জাতিকে পরাজিত করে দিয়েছে। সাথে সাথে বিশ্ব প্রকৃতি তাকে বেঁচে থাকার জন্য বেছে নিয়েছে। এবার দৃষ্টি ফেলা যাক পশু-পাখির অবস্থা দিকে। সেখানও দেখবেন যে, শক্তিশালী ও যোগ্যতর পশুরা বেঁচে থাকতে পারে এবং দুর্বল পশুরা নিপাত হতে থাকে। আপনা থেকেই দুর্বলরা সরে গিয়ে সবলদের স্থান করে দেয়, কারণ দুর্বলতার পরিণামই হলো মৃত্যু। দুর্বলতার কারণে যে পশু নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে সমথ্র্ নয়, সে সবল পশুর শিকারে পরিণত হয়। বাঘ বকরীকে খেয়ে ফেলে, বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, হাওয়ায় উড়ে বেড়াবার মতো শক্তিশালী জীবগুলো দুর্বল-কীটপতঙ্গগুলো আহার করে বেঁচে থাকে। জড় বস্তুগুলোর একই অবস্থা। অবশ্য সেগুলোর অণু-পরমাণুর দৃঢ় সংলগ্নতা ও স্থিরতার দরুন পরিবর্তনটা আসে খুবই ধীরে। তাই ঘড়ির কাটার পরিবর্তনের মত দ্রুত পরিবর্তন আপনারা তাতে দেখতে পান না। আবলুস গাছ দ্বারা চিরুনি তৈরি করে প্রিয়তমার সুভাসিত কেশবিন্যাসে ব্যবহার করা হয়, আর তার পাশেই অপর গাছ থাকে, যা চিরে নিয়ে প্রিয়তমার হাতে তুলে দেয়া হয় আগুনে জ্বালিয়ে ফেলার জন্য। ভেবে দেখুন এও হচ্ছে যোগ্যতরের বাঁচার বিধান। যোগ্যতর যথাযোগ্য স্থানই পাবে এবং অযোগ্য তার নির্ধারিত স্থানে যাবে এটাই প্রকৃতির নির্বাচন। দুনিয়ায় যত ভাষা রয়েছে, সেগুলোর ভেতরেও অস্তিত্বের লড়াই চলছে। প্রকৃতি তার ভেতর থেকে সে ভাষাকেই ডিঙ্গিয়ে নেয়, যেটা যোগ্যতর। অযোগ্যগুলো আপনা থেকেই লোপ পেয়ে যায়।

এ কি কথা যে, একই ভূমির এক পাশে কাটাবন আরেক পাশে ফুলের বাগান করা হয়। একাংশ জাহান্নাম এবং আরেক অংশ জান্নাত কেন? কারণ, দ্বিতীয় খ- যোগ্যতর বলেই জান্নাতের শোভা নিয়ে বিরাজমান এবং প্রথম খ- নিকৃষ্ট বলেই জাহান্নামের পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রথম খন্ড অনাচারপুষ্ট ও ধ্বংসকারী তাই সেখানে ফুল গজিয়ে উড়তে পারেনা। ফুলের মালা পরিধানের যোগ্যতা সে ভূমির নেই বলেই কাটার মুকুট ধারণ করেছে। দ্বিতীয় খ- সেই যোগ্যতা রাখে বলেই মনোমুগ্ধকর কুসুম মাল্যে তাকে ভূষিত করে রাখা হয়। সৌন্দর্য সুষমায় ম-িত থাকে তা সর্বদা। কোন কোন নদী শুকিয়ে যায় কেন? কারণ,পানির স্রোত বুকে নিয়ে নদী হয়ে বেঁচে থাকার যোগ্যতা সে হারিয়েছে বলেই। গঙ্গা ও যমুনা প্রবাহমান কেন? নদী হয়ে বেঁচে থাকার যোগ্যতা তাদের আছে বলেই আশেপাশের যত ছোটখাটো নদী-নালার পানি টেনে নিয়ে তারা দিন দিন বড় হয়ে বেঁচে চলছে। পৃথিবীর সব কিছুর ভেতরেই শক্তি পরীক্ষার সংগ্রাম চলছে। বাঁচা-মরার দ্বন্দ্ব চলছে। একটি আরেকটিকে হামলা করে ও একে অপর থেকে আত্মরক্ষা করে চলে। এই আক্রমণ ও আত্মরক্ষার দ্বন্দ্বের ফলে শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার বুকে সুস্থ ও সবলরা বেঁচে থাকে, অসুস্থ, দুর্বল এবং অযোগ্যরা নির্মূল হয়ে যায়। এরই নাম প্রকৃতির নির্বাচন। প্রকৃতি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করে দিয়েছে, যোগ্যতরের সঙ্গে আমি থাকবো। তাদের বাঁচার সংগ্রামে সাফল্য দান করব এবং বাধা বিপত্তি থেকে ডিঙ্গিয়ে নিব।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ইসলামি অর্থনীতির স্বরূপইসলামি অর্থনীতির স্বরূপ
হাজারো পীর-আউলিয়ার শিরোভূষণ সৈয়দ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ঘুষ : দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ
আরও

আরও পড়ুন

আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু

আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু

বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন

বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন

২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের

২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের

ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা

চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা

চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত

চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত

এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে

এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে

ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী

ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী

আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ

আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ

বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত

বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত

মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০

মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক

ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন

ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন

কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু

কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু

আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ

আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ

ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী

ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী

সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের

যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের

পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন

পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন

শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন

শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন