সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)

Daily Inqilab মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী

১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

পাকভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে আলোকিত এক মহাপুরুষ ছিলেন গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (৫৩৬-৬২৭ হিজরি) ইলমে তাসাউফের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ তাপস ওসমান হারুনী (র.)-এর নিকট বাইআত গ্রহণ করে ইলমে তাসাউফে পূর্ণতা লাভ করেন। ওসমান হারুনী (র.) মঈন উদ্দিন চিশতীকে খিলাফত প্রদান করেন। হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) হযরত ওসমান হারুনীর নিকট থেকে ইলমে তাসাউফ অর্জনের পর হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় যান। হজ পালন করে রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনায় যান। হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) অত্যন্ত নিবিষ্ট মনে যখন রাসূল (সা.)-এর দরবারে সালাম পেশ করেছেন এমন সময় তিনি শুনতে পান রওজা মোবারক থেকে বলা হয়েছে, ‘হে মঈন উদ্দিন! আমি আল্লাহর নির্দেশে হিন্দুস্থানের বেলায়েত তোমার হাতে অর্পণ করলাম, তোমাকে হিন্দুস্থানের বাদশাহ মনোনীত করলাম। কিয়ামত পর্যন্ত আজমীর তোমার বিশ্রামস্থল’ (সীরতে নিজামী)। হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) নবী (সা.)-এর নির্দেশেই সুদূর আরব থেকে ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লি হয়ে আজমীরে শুভাগমন করেন। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতীর আধ্যাত্মিক সাধনায় মুগ্ধ হয়ে দলে দলে অগণিত লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন। কায়েমী স্বার্থবাদীরা রাজদরবারে গিয়ে খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী ও তাঁর সহচরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন রাজা পৃথ্বীরাজ। রাজা একদল সেনাকে নির্দেশ দিলেন ফকির দরবেশ দলকে এক্ষুনি রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে। রাজার নির্দেশ পেয়ে সেনারা ঝাপিয়ে পড়লো মঈন উদ্দিন চিশতী ও তাঁর সহচরদের উপর। হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) নির্বিকার। তিনি তাদেরকে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কী চাও? তারা আরও গালিগালাজ শুরু করলো। তিনি আবার তাদেরকে বললেন, ‘সাবধান! আর এক পা অগ্রসর হলে তোমরা আল্লাহর গজবে পতিত হবে।’ কিন্তু পৃথ্বীরাজ বাহিনী তাঁর কথা মানলো না। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। পৃথ্বীরাজের সৈন্যরা অগ্রসর হলে তিনি এক মুষ্টি মাটি তাদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। ফলে কেউ অন্ধ, কেউ বধির, কেউ খঞ্জ, আবার কেউ মাতাল হয়ে চিৎকার করতে করতে দিকবিদিক পলায়ন করলো।

এ ঘটনার পর দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে এবং মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা পৃথ্বীরাজ ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিক সিদ্ধপুরুষদের দ্বারা প্রতিরোধ করতে হবে ফকিরকে। তাই সিদ্ধপুরুষ বলে খ্যাত শ্রীরামদেও ও অজয় পালকে তাদের যোগমন্ত্র বলে এই মুসলিম ফকিরকে বিতাড়িত করার দায়িত্ব দেন। শ্রীরাম দেও ও অজয় পাল তাদের সাধনালব্ধ আধ্যাত্মিক শক্তি বলে খাজা মঈন উদ্দিন চিশতীকে পরাস্ত করার জন্য আসলেন বটে; কিন্তু তারা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)-এর জ্যোতির্ময় চেহারার দিকে তাকিয়েই নত হয়ে গেলেন এবং খাজা মঈন উদ্দিন চিশতীর কদমে লুটিয়ে পড়লেন। তারা খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)-এর অলৌকিক শক্তি দেখে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) শ্রীরামদেও-এর নাম রাখলেন মুহাম্মদ সাদী আর অজয় পালের নাম রাখলেন আব্দুল্লাহ। তারা উভয়েই পরবর্তীতে ওলীয়ে কামিল হয়েছিলেন।

খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) তাঁর প্রিয় মুরিদ খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (র.)-কে দিল্লীতে রেখে আজমীর রওয়ানা হন। আজমীরে গিয়ে কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করতে না পেরে উটের চারণ ভূমিতে আবাস স্থাপন করেন। উটের রাখালরা বিরক্ত হয়ে খাজা মঈন উদ্দিন চিশতীকে স্থান ত্যাগ করতে আহ্বান জানায়। সন্ধ্যায় রাখালরা উট রেখে চলে গেলে পরদিন ভোরে এসে দেখে উঠের চামড়া মাটির সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করার পরও তারা উটগুলোকে দাড় করাতে পারলো না। অবশেষে তারা খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)-এর নিকট গিয়ে ক্ষমা চাইলে উটগুলো আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। আধ্যাত্মিক স¤্রাট খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) রাখালদের উৎপীড়নে চারণভূমি ছেড়ে আনা সাগরের তীরে বসতি স্থাপন করেন। আনা সাগরের দুইতীর ছিল অসংখ্য মন্দিরে সয়লাব। যেখানে প্রতি দিবারাত্রে অসংখ্য হিন্দুরা পূঁজা-অর্জনা করতো, শুধু তাই নয়: প্রতিদিন ওই মূর্তির পদতলে ঢালা হতো তিন মন তেল। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) সেখানে আজানের মাধ্যমে সালাত আদায় করতেন। একদিন সন্ধ্যায় আহ্নিকের সময় পূঁজারীরা সুমধুর আজানের ধ্বনি শুনে এ ফকিরের স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে যায়। সাথে সাথে তারা ফকিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে শাস্তি প্রদানের দাবী করেন। এতে রাজা পৃথ্বীরাজ মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)-এর প্রতি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়। রাজা পৃথ্বীরাজ মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)-এর প্রতি হিংসায় বশবর্তী হয়ে আনা সাগর থেকে পানি আনতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) তাঁর মুরিদ মুহাম্মদ সাদীকে একটি পাত্রে সুকৌশলে কিছু পানি আনতে বললে তিনি পানি নিয়ে আসেন। ফলে আনা সাগরসহ সব নদ-নদী, খাল-বিল ও পুকুরের পানি শুকিয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় হাহাকার। সাধারণ জনগণ ছুটে আসেন খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)-এর দরবারে। জনগণের কাকুতি-মিনতির কারণে খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) পুনরায় পানি সাগরে ছেড়ে দেন। ফলে সকল খাল-বিল, নদ-নদী ও পুকুর পানিতে ভরপুর হয়ে যায়।

সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) রাজা পৃথ্বীরাজের একজন মুসলিম কর্মচারীকে দিয়ে তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠান। চিঠি পেয়ে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে পৃথ্বীরাজ। মুসলমান কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করলেন পৃথ্বীরাজ। সেই সাথে মঈন উদ্দিন চিশতীর বিরুদ্ধে উচ্চারণ করলেন অশালীন বক্তব্য। শুনে মঈন উদ্দিন চিশতী (র.) এক টুকরো কাগজ লিখে পাঠালেন পৃথ্বীরাজকে-‘আমি তোমাকে তোমার জীবিতাবস্থায়ই মুসলিম সেনাদের হাতে সোপর্দ করলাম।’ এর আগে দুবার ভারত আক্রমণ করেও সফল হতে পারেননি সুলতান শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ তাঁকে লক্ষ্য করে বলছেন, ‘যাও, তোমাকে আমি হিন্দুস্থানের শাসনক্ষমতা দান করলাম।’ এ শুভ স্বপ্ন দেখে সুলতান শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে রওয়ানা হলেন। এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন কুতুব উদ্দিন আইবেক। এতে রাজা পৃথ্বীরাজের বাহিনী পরাজিত হয় অত্যন্ত নির্মমভাবে। যুদ্ধ শেষে সুলতান শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি আজমীর পৌঁছান। তখন সন্ধ্যা। দূরে আজানের ধ্বনি শুনে সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখলেন একদল লোক হাত বেঁধে দাঁড়িয়েছেন। দরবেশদের জামাতে নামাজ আদায় করলেন সুলতান। সালাত শেষে জামাতের ইমামের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি। এই তো সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ, স্বপ্নে যিনি জানিয়েছেন হিন্দুস্থান বিজয়ের সুসংবাদ। সুলতান শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি শ্রদ্ধাভরে পরিচিত হলেন খাজা মঈন উদ্দিন চিশতীর সঙ্গে। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (র.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে তাঁর পবিত্র সুহবতে তিনদিন অতিবাহিত করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

প্রশ্ন: তাকওয়া ও খোদাভীতির স্বরূপ কী?
মাহে রমাদান: সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যের প্রশিক্ষণ
আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.)
মাহে রমযানের আমল ও করণীয়
বরকতময় রামাদান
আরও
X

আরও পড়ুন

নোয়াখালীতে কলেজ টেক্সটাইল কলেজ ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি, র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার-২

নোয়াখালীতে কলেজ টেক্সটাইল কলেজ ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি, র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার-২

মির্জাপুরে নারী ক্রেতাদের ছবি তুলে নগ্ন ছবিতে ব্যবহারের অভিযোগে দোকানী গ্রেপ্তার

মির্জাপুরে নারী ক্রেতাদের ছবি তুলে নগ্ন ছবিতে ব্যবহারের অভিযোগে দোকানী গ্রেপ্তার

২৫৯ বছরেও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আওকরা মসজিদ

২৫৯ বছরেও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আওকরা মসজিদ

গণমাধ্যমে ঘাপটি মেরে আছে হাসিনার দোসররা, অসাবধানতায় ঝলক দেখালেন বর্ণা

গণমাধ্যমে ঘাপটি মেরে আছে হাসিনার দোসররা, অসাবধানতায় ঝলক দেখালেন বর্ণা

ধর্ষণের ঘটনায় জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ

ধর্ষণের ঘটনায় জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ

ধর্ষনের বিচার নিশ্চিত করতে ট্রাইবুনাল গঠন করুন : বাংলাদেশ ন্যাপ

ধর্ষনের বিচার নিশ্চিত করতে ট্রাইবুনাল গঠন করুন : বাংলাদেশ ন্যাপ

থানায় ইভটিজিংয়ের অভিযোগ দেওয়ায় স্কুলছাত্রীর বাবাকে জখম, আটক ২

থানায় ইভটিজিংয়ের অভিযোগ দেওয়ায় স্কুলছাত্রীর বাবাকে জখম, আটক ২

রমজান মু’মিনের জন্য গনিমতের মাস- জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ান

রমজান মু’মিনের জন্য গনিমতের মাস- জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ান

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ হতে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ হতে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার

আছিয়ার বাড়িতে গেলেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস

আছিয়ার বাড়িতে গেলেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে মুসল্লিদের ঢল

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে মুসল্লিদের ঢল

গফরগাঁওয়ে ফ্যানের সাথে ওড়না ঝুলিয়ে আত্মহত্যা

গফরগাঁওয়ে ফ্যানের সাথে ওড়না ঝুলিয়ে আত্মহত্যা

গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের হওয়া উচিত: ট্রাম্প

গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের হওয়া উচিত: ট্রাম্প

কন্যা হারালেন জাজাই

কন্যা হারালেন জাজাই

ধর্ষণরোধ ও ধর্ষকের প্রকাশ্যে শাস্তির দাবিতে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ মিছিল

ধর্ষণরোধ ও ধর্ষকের প্রকাশ্যে শাস্তির দাবিতে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ মিছিল

সাতক্ষীরায় শিশু আছিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত, ধর্ষকদের ফাঁসি দাবি

সাতক্ষীরায় শিশু আছিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত, ধর্ষকদের ফাঁসি দাবি

আলভারেসের সেই গোল নিয়ে যা বলল উয়েফা

আলভারেসের সেই গোল নিয়ে যা বলল উয়েফা

শরীয়তপুরে উপ-সহকারী প্রকৌশলীর ওপর ঠিকাদারের হামলা, থানায় অভিযোগ

শরীয়তপুরে উপ-সহকারী প্রকৌশলীর ওপর ঠিকাদারের হামলা, থানায় অভিযোগ

জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন

জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন

সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে

সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে