ভারত উপমহাদেশে মুসলিম সভ্যতার জাগরণে আবুল হাসান আলী নদভির শিক্ষাচিন্তা

Daily Inqilab শামসীর হারুনুর রশীদ

০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৪ এএম | আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৪ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
৬. জাতি গঠনে প্রয়োজন নিজস্ব শিক্ষাদর্শন: এ প্রসঙ্গে নদবি বলেন, প্রত্যেকটি জাতি তাদের নিজস্ব দর্শনের উপর ভিত্তি করেই তাদের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করে থাকে। এর একটি উদাহরণ হিসাবে শায়েখ নাদাভি রা. রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, একজন প্রভাবশালী রাশিয়ান চিন্তাবিদ (গ. ঈ. এড়াবৎহ)-এর মতে, ‘রাশিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান বৈশ্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি সাধারণ অংশ নয়, বরং এই জ্ঞান-বিজ্ঞান হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র ও আলাদা ভাগ, অন্যদের জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা। আলাদা হওয়ার কারণ আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান একটি সুনির্দিষ্ট দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার পিছনে ভিত্তির প্রয়োজন থাকে তাই আমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তি হচ্ছে আমাদের বস্তুবাদী দর্শন যা আমাদের আদর্শের মহান নেতা কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন পেশ করে গিয়েছেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণার সংগ্রামে আমরা যখন অবতীর্ণ হবো, তখন আমাদের হাতে অবশ্যই এই দর্শন থাকবে এবং এই দর্শনের বিরোধিতায় যারাই আমাদের সামনে আসবে তাদেরকে কঠিন হাতে দমন করতে হবে’।
নদভি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে উত্তম ব্যাখ্যা হচ্ছে এটা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অভিভাবক ও শিক্ষকগণ তাদের নিজেদের বোধ-বিশ্বাস, ইমান-আকিদা, জীবন-জগতের প্রতি তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তাদের নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করে থাকে।

“ঋ. ড. এধৎভড়ৎফ তার বই ‘ঊফঁপধঃরড়হ ধহফ ঝড়পরধষ চঁৎঢ়ড়ংব’, (১৯৬২) তে উল্লেখ করেন: “শিক্ষা ব্যবস্থার সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ণয়ের মানদন্ড হচ্ছে সমাজের রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটা ও না ঘটা। সমাজের রীতিনীতি ও মূল্যবোধ হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কাজেই শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজের রীতিনীতি ও মূল্যবোধের মাঝে কোন ধরনের দুরত্ব ও ব্যবধান থাকতে পারে না। আরেক শিক্ষাবিদ ঠবৎহড়হ গধষষরহংড়হ তার বই ‘অহ ওহঃৎড়ফঁপঃরড়হ ঃড় ঞযব ঝঃঁফু ড়ভ ঈড়সঢ়ধৎধঃরাব ঊফঁপধঃরড়হ’ (১৯৫৭) তে একই ধারণা পেশ করেছেন”। সুতরাং আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা যে, ইংল্যন্ড, ইউরোপ থেকে শিক্ষাব্যবস্থার ধারণা গ্রহণ করার কারণে একটা দীর্ঘ সময় আমাদের বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে।

৭. শিক্ষার ইসলামিকরণ : এই সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে এমনভাবে ঢেলে সাজানো যা ইসলামি আকিদা, বোধ-বিশ্বাসের সাথে উপযুক্ত। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্য পুস্তক থেকে এমন সব উপাদান বের করে দেওয়া যা ইসলামি আকিদা ও বিশ্বাসের সাথে খাপ খায় না, বস্তুবাদি, নাস্তিক্যবাদ, ভোগবাদী সকল ধারণা ও উপাদান দূর করে সেখানে আল্লাহর প্রতি ইমান, আখেরাতের প্রতি ইমান, মানব জাতির কল্যাণ এই সকল ধারণা ও উপাদান প্রতিষ্ঠিত করা। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যেই এই ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। মূলকথা এটাই যে, শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া উম্মতের অবস্থার পরিবর্তন অন্য কোনভাবে হতে পারে না। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদেরকে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করতে হবে যাদের বুকে থাকবে ইসলামি আকিদা এবং মাথায় থাকবে আধুনিক বিজ্ঞানের সুন্দর সহাবস্থান। (নাহওয়া, ৪৫)

তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থা একটি স্বতন্ত্র ও পরিপূর্ণ ইস্যু। শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে নতুন প্রজন্মকে তাদের বোধ-বিশ্বাস, ইমান-আকিদার উপর গড়ে তোলার একটি মাধ্যম। যে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না সেই শিক্ষা ইসলামি শিক্ষা হতে পারে না, এই ধরণের শিক্ষার চেয়ে নিরক্ষতা মেনে নেওয়া অনেক উত্তম। শিক্ষাব্যবস্থার অর্থ এই নয় যে, এর মাধ্যমে কিছু বিষয়, শাস্ত্র, মাতৃভাষা, বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেওয়ায় ব্যবস্থা করা, বরং শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একটি জাতির চিন্তা-চেতনা, আদর্শ-আখলাক তৈরি করা উদ্দেশ্য।

কোন সন্দেহ নেই যে, এই কাজ অনেক কষ্টসাধ্য ও দীর্ঘ সময়ের কাজ। তবে এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই যদি আমরা সত্যিকারের মুসলিম উম্মাহ গড়ে তুলতে চাই। এটা কোন ব্যক্তিগত কাজও নয়, বরং এর জন্যে দরকার একাধিক জামাত, কমিটি, একাডেমির সম্মিলিত কাজ”।

৮. ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য: আবুল হাসান আলী নদভি সবসময় একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর মতে ‘শিক্ষা একটি সমাজের মূল লক্ষ্য হতে পারে না, বরং শিক্ষা হচ্ছে মূল লক্ষ্য পর্যন্ত উপনীত হওয়ার একটি বিশেষ মাধ্যম বা ওসিলাহ’। তিনি বলেন, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য এক কথায় প্রকাশ করা যায়; আর তা হচ্ছে আল্লাহর পথের দায়ী তৈরি করা, যারা ইলমের গভীরতা, ফিকহ ও বাসিরাতের সাথে এবং দ্বীনের ইলম ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিতির মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করার যোগ্যতা রাখে।

এই উদ্দেশ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্কিত সকল কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকা উচিত, অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠানের জন্যে যা কিছুই করা হোক না কেন এই লক্ষ্য যেন সামনে রেখেই তা করা হয়”। নদভি রাহ. মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে একটি সিলেবাস প্রস্তাব করেন। তার সেই প্রস্তাবের মধ্যে ছিল: “কুরআন, সুন্নাহ, সিরাতে-রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সিরাতের ব্যাপারে মুসতাশরিকিনদের মিথ্যা দাবী সম্পর্কে ধারণা দান, ইসলামি শরিয়াতের মাকাসিদ, শরিয়াতের দর্শন, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান উদাহরণ হিসাবে, অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্মের ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, ফিকির, দাওয়াহ ও ইসলামের ইতিহাস। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপারে তিনি বলেন এই ক্ষেত্রে ইমাম গাজালি ও ইবনু তাইমিয়াহ রা. এর মতো তাদের যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতো পারদর্শিতা অর্জন করতে না পারলেও এমন পর্যায়ের ধারণা অর্জন করা উচিত যাতে এই যুগের মানুষের সাথে খিতাব করতে পারেন”। তাঁর মতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এমন হওয়া উচিত যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন তাদের বুকে মজবুত ইমান থাকবে অন্যদিকে তাদের চিন্তায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য ও তত্ত্ব বিরাজ করবে। তাঁর মতে শিক্ষার বিষয়টি হচ্ছে উম্মতের জন্যে বাঁচা-মরার মতো একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। যদি ইমান-আকিদা নিয়ে দুনিয়ায় ইজ্জতের সাথে টিকে থাকতে হয় তাহলে শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামিকরণ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। (সমাপ্ত)

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক ।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আল্লাহ ছাড়া কোন আশ্রয়স্থল নাই
মাইজভা-ার শরিফ : ঐশ প্রেক্ষিত
খাঁটি তাওবার শর্তাবলী
ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কারে নামাজ ও রোজা রমজানের ভূমিকা
ইসলামের দৃষ্টিতে রোজার উপকারিতা
আরও
X

আরও পড়ুন

ফরিদপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ৫ আহত ৩৫

ফরিদপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ৫ আহত ৩৫

ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ৯ মাসে ৩০ হাজারের বেশি অভিবাসী যুক্তরাজ্যে

ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ৯ মাসে ৩০ হাজারের বেশি অভিবাসী যুক্তরাজ্যে

শেষ পর্যন্ত লড়াই চালানোর ঘোষণা: ট্রাম্পের হুমকির জবাব দিলো চীন

শেষ পর্যন্ত লড়াই চালানোর ঘোষণা: ট্রাম্পের হুমকির জবাব দিলো চীন

কারিনা সুবিধার মেয়ে নয়,যা করবে, ভেবেচিন্তে কোরো

কারিনা সুবিধার মেয়ে নয়,যা করবে, ভেবেচিন্তে কোরো

দাউদকান্দিতে শিক্ষার মানউন্নয়ন বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত

দাউদকান্দিতে শিক্ষার মানউন্নয়ন বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত

দাউদকান্দিতে মাছ ধরা নিয়ে সংঘর্ষ গুলিবিদ্ধ -৩

দাউদকান্দিতে মাছ ধরা নিয়ে সংঘর্ষ গুলিবিদ্ধ -৩

সার্বজনীন স্বাস্থ্য-কল্যাণে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান: অধ্যাপক সায়েদুর রহমান

সার্বজনীন স্বাস্থ্য-কল্যাণে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান: অধ্যাপক সায়েদুর রহমান

গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে দৌলতখানে ছাত্রদলের অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিল

গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে দৌলতখানে ছাত্রদলের অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিল

ব্যাংকিং সেবার আধুনিকায়নে বাংলাদেশ ও দ. কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানের চুক্তি

ব্যাংকিং সেবার আধুনিকায়নে বাংলাদেশ ও দ. কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানের চুক্তি

কঙ্গোর উত্তেজনার মধ্যে রুয়ান্ডায় গণহত্যার ৩১তম বার্ষিকী পালিত

কঙ্গোর উত্তেজনার মধ্যে রুয়ান্ডায় গণহত্যার ৩১তম বার্ষিকী পালিত

কিশোরগঞ্জে ভাড়া বাসা থেকে পুলিশ সদস্যের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

কিশোরগঞ্জে ভাড়া বাসা থেকে পুলিশ সদস্যের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

আড়াইহাজারে সুইডিশ কোম্পানির কারখানা স্থাপনে সমঝোতা সই

আড়াইহাজারে সুইডিশ কোম্পানির কারখানা স্থাপনে সমঝোতা সই

ফেসবুকে লুট করা জুতা বিক্রির পোস্ট, সিলেটে আটক ১৪

ফেসবুকে লুট করা জুতা বিক্রির পোস্ট, সিলেটে আটক ১৪

নারায়ণগঞ্জে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে বিনিয়োগকারীরা

নারায়ণগঞ্জে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে বিনিয়োগকারীরা

সারাদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৪৯

সারাদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৪৯

প্রবাসীদের ভোটের সুযোগ খুব সহজ নয় : সিইসি

প্রবাসীদের ভোটের সুযোগ খুব সহজ নয় : সিইসি

তেল আবিব-লোহিত সাগরে মার্কিন নৌবহরে হামলার দাবি হুথিদের

তেল আবিব-লোহিত সাগরে মার্কিন নৌবহরে হামলার দাবি হুথিদের

বিচ্ছেদকে প্রাঙ্ক বলে ঢাকার চেষ্টা,প্রাক্তনের সম্মান রক্ষার্থে অভিনেতার মিথ্যার আশ্রয়

বিচ্ছেদকে প্রাঙ্ক বলে ঢাকার চেষ্টা,প্রাক্তনের সম্মান রক্ষার্থে অভিনেতার মিথ্যার আশ্রয়

গাজাবাসীকে অন্য দেশে পাঠাতে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু বৈঠক

গাজাবাসীকে অন্য দেশে পাঠাতে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু বৈঠক

আপাতত স্বাধীনতা কনসার্ট হচ্ছে না

আপাতত স্বাধীনতা কনসার্ট হচ্ছে না