দাম্পত্য জীবন : প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, পরিপূরকতা
০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৩ এএম
মানব সভ্যতার শুরু থেকেই পরিবার ছিল মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিরাপত্তা, প্রেম, ভালোবাসা এবং মনের প্রশান্তি খুঁজতে মানুষ পরিবার গঠন করেছে। ইসলাম একটি জীবনব্যবস্থা, আর এই ইসলামী জীবনব্যবস্থার মূল ভিত্তি পরিবার। যেখানে সুষ্ঠু পারিবারিক কাঠামো অনুপস্থিত, সেখানে সুস্থ জীবন ও পূর্ণাঙ্গ ইসলাম পালন শুধু নিছক কল্পনা বিলাস!
ইসলাম সর্বাত্মকভাবে একটা সুখী ও প্রশান্তচিত্ত পরিবার নির্মাণে তৎপর। শুধু ব্যক্তিগত সৎ কাজ করার নির্দেশ দিয়েই ইসলাম সীমাবদ্ধ থাকেনি। আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর মধ্যেই কোনো মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। বরং যে পরিবারটির নেতৃত্বের ভার তার কাঁধে স্থাপন করেছে সে পরিবারের সদস্যরা যাতে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সাধ্যমত সে শিক্ষা দেওয়াও তার কাজ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও স্বীয় পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) হতে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। সেখানে অত্যন্ত কর্কশ, রূঢ় ও নির্মম স্বভাবের ফেরেশতা নিয়োজিত থাকবে, যারা কখনই আল্লাহর কথা অমান্য করে না এবং নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে।’ (সূরা তাহরীম: ৬)।
এই আয়াতসহ পরিবারকে কেন্দ্র করে কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত অনেক নস পাওয়া যায়। পরিবারবদ্ধ থাকলেই কেবল সে আয়াত ও হাদিসগুলোর আনুগত্য করা সম্ভব, সন্ন্যাসী জীবনে পালন করা কখনোই সম্ভব না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজকের সমাজে পরিবারব্যবস্থা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ছয় ডিজিটের বেতন পাওয়া যে লোকটা আমাদের সংজ্ঞায় সফল, তিনিও ভঙ্গুর পারিবারিক কাঠামোর কারণে নিজেকে ব্যর্থ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছেন নিজের কাছে। শুধু সাধারণ পরিবারই নয়, ধর্মীয় পরিবারগুলোতেও এই সমস্যা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অনেক দ্বীনি ভাই এই অবস্থার জন্য এককভাবে নারীদের মধ্যে সুপ্ত ‘হিজাবী ফেমিনিজম’ মতাদর্শের অভিযোগ করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে খুবই লক্ষ্য করা যাচ্ছে অনেক ভাই পারিবারিক অশান্তিতে হাঁপিয়ে উঠে দুই শব্দের এই বাক্যটাকেই সব দোষ দিয়ে দেন। আসলেই কি সমস্যাটা এখানে হচ্ছে? যদি হয়ে থাকে তাহলে কোন কোন নিয়ামকগুলো এমনটা হতে সহযোগিতা করছে? এর জন্য নারী নাকি পুরুষ দায়ী, নাকি উভয়েই দায়ী তা জেনে আমাদেরকে এখুনি সমাধানের পথে যেতে হবে। কারণ একটা রাষ্ট্র যেমন একটি জাতির মন ও মনন গঠন করে, তেমনি একটি জাতির মতাদর্শ ও চিন্তার ধরনও তার রাষ্ট্র কাঠামোর সার্বিক গতিবিধিকে প্রভাবিত করে। সুতরাং সুন্দর মন ও সুস্থ ধারার রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিনির্মানের জন্য আমাদেরকে এ বিষয়ে কথা বলতেই হবে। ইসলামের সোনালী অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলাম নারীকে জীবন দিয়েছে এবং তাকে মূল্যায়ন করেছে। ইসলাম শুধু নারীদের জীবন্ত কবর দেওয়াই বন্ধ করেনি, বরং তাঁকে জান্নাত প্রাপ্তির নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অপরদিকে রাসূল (সা.) এর নামে মিথ্যাচার করে বানানো হলো, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। (হাদিসের নামে জালিয়াতি, লেখক: ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ., পৃষ্ঠা- ৫০৯)
প্রথম ওহী প্রাপ্তির পর রাসূল (সা.) তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু হযরত আবু বকর (রা.) বা হযরত ওসমান (রা.) কিংবা তাঁকে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া চাচা আবু তালিবের কাছে যাননি। যাননি অন্যান্য ভাই, বন্ধু বা চাচার কাছেও। সর্বপ্রথম তিনি যে মানুষের কাছে যেয়ে ওহী প্রাপ্তির কথা জানিয়ে পরামর্শ করলেন, তিনি একজন নারী! হযরত খাদিজা (রা.)। তিনি রাসূলকে (সা.) পরামর্শ দিলেন ওয়ারাকা বিন নাওফেলের কাছে যেতে। তখন রাসূল (সা.) কোনো আপত্তি না করেই সেখানে গেলেন। আমরা প্রিয় নবীর নবুয়ত প্রাপ্তির সূচনায় একজন নারীর সাথে পরামর্শ করতে দেখি আর আমরা বললাম, ‘নারীদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে’। এই প্রবাদ এনেই ক্ষান্ত না! রাসূল (সা.) এর নামে জাল হাদিস ছড়ানো হলো, “নারীর সাথে পরামর্শ করো, এরপর তারা যা বলবে তার বিপরীত করো।”
বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (সা.) স্ত্রী লোকদের ব্যাপারে বলে গেছেন, ‘তোমাদের উপর তাদের প্রাপ্য হলো তোমরা তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে খাওয়াবে ও পোশাক-পরিচ্ছদ দিবে’। রাসূলের সুন্নত দেখলে দেখা যায়, স্ত্রীর মুখে খাবারের লোকমা তুলে দেওয়া সুন্নাত। আর আমাদের সমাজে একজন স্ত্রী লম্বা সময় নিয়ে মেপে মেপে মসলা দিয়ে লোভাতুরভাবে একটা মুরগী রান্না করেন আর সেটা সর্বপ্রথম খায় বাড়ির পুরুষ ব্যক্তিরা। শাশুড়ি যতœ করে বাড়ির পুরুষদের জন্য, নাতির জন্য মুরগীর রানগুলো আলাদা করে বাটিতে তুলে রাখেন। শিশুকাল থেকেই একটা মেয়ে মুরগীর রানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসে। এরকম ছোট থেকে বড় সব বিষয়ে, শুধু মেয়ে হওয়ার জন্য বঞ্চিত হয়ে, একটা হীনমন্যতায় জান্নাতের পয়গামবাহী মেয়ে শিশুটি একদিন একজন নারী হিসেবে উপনীত হন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে স্বামী বাজারের নানাকিছু খায়, অপরদিকে বাড়ির নিয়ম হলো, স্বামীর আগে স্ত্রীর খাওয়া নিষেধ। যে মানুষটার যতেœ এত সুস্বাদু খাবার প্রস্তুত হয়, সে মানুষটা সবাইকে খাওয়ানোর পর কিছু থাকলে নিজে খায়!
কিছুদিন আগেও পুরুষরা ইসলামের দেওয়া মাসনার (দ্বিতীয় বিয়ে) বিষয়টাকে যেভাবে ঔন করেছে, ঠিক সেভাবে ইসলামের দেওয়া নারীদের অধিকার ও মর্যাদাগুলোকে ধূলিসাৎ করেছে। ইসলামে স্ত্রীকে বলা হয়েছে ঘরের রানী, আর তারা স্ত্রীকে ব্যবহার করেছে চাকরানী হিসেবে। মাসনা শব্দটা শুনলে আমাদের দ্বীনি ভাইদের মুখে যেন ফুল ফুটে যায়। এর পক্ষে কোরআন-হাদিসের যত নস আছে, সবগুলো তাদের মুখস্থ থাকে সবসময়। একজন মুসলিম হিসবে মাসনাকে অস্বীকার করার বা ছোট করার বিন্দুমাত্র সাহস আমার নাই। কিন্তু ঐ ভাইদের যখন বলি, ‘আমার জানামতে, আপনার চেয়ে আপনার দুলাভাই আর্থিকভাবে বেশি সবল, আপনার বাবারও টাকার কম নাই। এই পুরুষদ্বয়কে মাসনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন কেন ভাই?’ তখন পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি! তখন—না, ইয়ে, মানে সামাজিক পরিস্থিতি তো দারুল ইসলামের মতো না ভাই! এই আরকি!
আমাদের দু-এক সিঁড়ি আগেও, নতুন বউ মানে তো যেন ভুল করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এমন একটা ভাব থাকতো বাড়ির সবার মধ্যে। ননদ-শাশুড়ির এমন মনোভাব যেন মেয়েটা এসে ছেলেটাকে কেঁড়ে নিল। একটা মেয়ে শৈশবের সকল স্মৃতিকে ছেড়ে নতুন একটা পরিবেশে যায়, আর সে পরিবেশের মানুষগুলো সরাসরি বা মজার ছলে উঠতে বসতে খোঁটা দিতে থাকে। যৌতুকে বিয়ে দেওয়ার ফলে, বা ঘর সাজিয়ে দেওয়া নামক সুশীল যৌতুকের কারণে, মেয়েটা তার পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, দেনমোহর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মেয়ের ‘দেনমোহর ও পৈত্রিক সম্পত্তি’ যে মেয়ের নিজস্ব সম্পত্তি এটা আমাদের বাহুবল পুরুষরা কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। স্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিল থাকলেও স্ত্রীর ভরনপোষণ যে স্বামীকেই করতে হয় এটা আমাদের বীরবাহু মাসনা আকাঙ্ক্ষিত ভাইদের মানতে অনেক কষ্ট।
একটা নারীর জন্য তার বাবা-মায়ের যতœ করা বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও, সে তার বাবা-মায়ের সেবাযতœ না করে স্বামীর বাবামায়ের সেবাযতœ করার পরও, একজন নারী যখন নিজের আত্মসম্মানের স্বীকৃতি না পায়, তখন এটা তার জন্য নিদারুণ কষ্টের কারণ হয়। নারীরা যে ফিতরাতগত শখ, আহ্লাদের মেজাজে তৈরি সেটা অনেন ভাই চিন্তা করে না। সে যেভাবে কাজ করছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে নারীকে পুরুষালী পাল্লায় বিবেচনা করাকে বেশি পছন্দ করে। কথায় কথায় পরিবারের সকল অর্থের যোগানদাতা হিসেবে নিজেকে মহাবীর হিসেবে উপস্থাপন করতে অনেকে পছন্দ করেন। আর কোরআন-হাদিসের নসগুলোর ভুল উপস্থাপন তো আছেই!
ইসলাম থেকে যেভাবে একটি পরিবারে প্রেসক্রিপশন আসে, আমাদের দু’এক সিঁড়ি আগেও অধিকাংশ পরিবার ব্যবস্থায় সে ছিটেফোঁটাও ছিল না; ছিল ভালোমন্দ সামাজিক মূল্যবোধ মিশ্রিত ইসলামী পরিবার। আরও ভয়ঙ্কর বিষয়, সে পরিবারটাতেই এসব সিস্টেমে ব্যঘাত ঘটলে ইসলামী মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে সেগুলোকে জায়েজ করত। নারীদের গায়ে হাত তোলার মতো কাপুরুষোচিত কাজ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অর্থাৎ একটা পরিবারে যেমন একে অপরের প্রতি মারহামতপূর্ণ (দয়ার্দ্র) আচরণ থাকা দরকার, সেটা অনেকক্ষেত্রেই বিদ্যমান ছিল না। এহেন অবস্থায় একজন নারীর প্রথম বন্ধু হয়ে আবির্ভূত হয় তার সন্তান। তার কন্যা সন্তান যখন মায়ের উপর চলে আসা এসব কিছু দীর্ঘদিন যাবৎ দেখে আসে, তখন তার মধ্যে একটা জেদ চেপে বসে। ইসলামের নামে একটি পরিবার ব্যবস্থা, যেটিতে ইসলামী মূল্যবোধের ছিটেফোঁটাও নেই, সেটার ব্যপারে তাদেরকে বিতৃষ্ণ করে তোলে। সঠিক ইসলামী পরিবারের পরিচয় না পেয়ে সে নারীরা সহজেই অন্য একটি মহল, যারা শুধুমাত্র সুন্দরী নারীদেরকে নিয়ে কাজ করে, তাদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছে কিছুকাল। এরপর থেকে তারা নিজেরা কিছু করার চেষ্টা করে। সে দলে যোগ দেয় হিজাব-নিকাব করা বোনরাও। ধীরে ধীরে তাদের কাছে পর্দার সঙ্গা শুধু হিজাব-নিকাবে সীমাবদ্ধ হতে শুরু করে। পুরুষকে পরিপূরক ভাবার চেয়ে তারা সচেতন অথবা অবচেতন মস্তিষ্কে পুরুষকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়েছেন। (চলবে)
লেখক: শিক্ষার্থী, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ, টাঙ্গাইল।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নির্বাচনের রোড ম্যাপ দেন অতিসত্বর : আবুল কালাম আজাদ
উত্তর কোরিয়ায় নিষিদ্ধ করা হল ‘হট ডগ’
সিংগাইরে ১ সপ্তাহে আত্মহত্যা-৬
মির্জাপুরের অবৈধ সেই ৭ ইটভাটা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে
সীমান্তে সাহসী বাংলাদেশিরা, অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে পুরো দেশকে
দাবানলে পুড়ছে প্যারিস হিলটন, অ্যান্টনি হপকিন্সের কোটি টাকার বাড়ি
‘অতিথি দেবতার মতো’, এই নীতিতে হাসিনার ভিসার মেয়াদ বাড়ালো ভারত
ভূরুঙ্গামারী মহিলা কলেজের গভর্ণিং বডির সদস্য নির্বাচনে মনোনয়ন পত্রের মূল্য ১০ হাজার টাকা
গোয়ালন্দে পাখিদের নিরাপদ আবাসনে গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি বসাচ্ছেন একদল যুবক
নভোএয়ার এর ১২ বছরের সাফল্য উদযাপন
ফরিদপুরে বিল্ডিংয়ের দরজার পাশে পড়েছিল কেয়ারটেকারের হাত-পা বাঁধা মরদেহ
ডিএমপির ১২ ডিসিকে বদলি
আবারও অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে স্মিথ
‘৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়া ২২৭ জনের বেশিরভাগই চাকরিতে যোগ দিতে পারবে’
বিএনপির ২২৭৬ নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে
ভোটার এবার আগের মত ভোট হবে না-মৌলভীবাজারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন
ইহুদি খ্রিস্টানদের স্বর্গরাজ্য পুড়ে ছাই হচ্ছে!
জালিয়াতির প্রশ্ন তুলে শিরোপা হারালেন মিস ইউনিভার্স
‘হাসিনা জানুয়ারিতে দেশে আসবেন দাবি সঠিক নয়’
বকশীবাজারে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়: মামলার বিচারক