সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম রাখার প্রয়োজনীয়তা
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম

আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফে বিভিন্ন নবী রাসূলকে তাদের নাম নিয়ে ডাক দিয়েছেন। কুরআনের যে আয়াত সর্বপ্রথম নাযিল করা হয়েছে, সেখানেও আল্লাহপাক নামের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন- পড়, তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। হযরত আবু দারদা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন-কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতার নামে। অতএব, তোমাদের নামগুলো সুন্দর করে রাখো( আবু দাউদ, বায়হাকী)। উক্ত কুরআন-হাদীসের আলোকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, নামকরণ দ্বারা মানুষের পরিচয়, শনাক্তকরণ ছাড়াও ইহকাল ও পরকালে নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই সন্তানের নামকরণ যেমন উত্তম হতে হবে, তেমনি তা হতে হবে ইসলামী ভাবধারায় পরিপূর্ণ, যাতে নামের দ্বারাই বুঝা যায় যে লোকটি মুসলমান। মুসলমানদের জন্যে আরবি নামের প্রয়োজনীয়তা : আল্লাহ্ তাআলা সকল ভাষারই মর্যাদা দান করেছেন। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে একের উপর অন্যেক মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহ্ বলেন- ‘‘আমি তোমাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’’ মানুষের মধ্যে একের উপর অন্যের যেমন শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তদ্রƒপ ভাষার ক্ষেত্রেও আরবি ভাষার মর্যাদার সর্বাধিক এবং আরবি ভাষাকে আল্লাহ্ তায়ালা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন, তিনটি কারণে তোমরা আরবিকে ভালোবাসবে। তা হচ্ছে কুরআনের ভাষা, জান্নাতের ভাষা এবং আমার ভাষা আরবি। আল্লাহ্ তাআলা বলেন-‘‘এরূপেই আমি কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়।’’ প্রকৃত মুসলিম হতে হলে এবং ইবাদতের প্রয়োজনে আরবি জানতেই হবে। আরবি ভাষার মাধ্যমে গড়ে উঠে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব। মুসলিম বিশ্বের যে কোনো দেশে যে কোনো অঞ্চলেই বাস করুন না কেন, তার নাম শুনেই বুঝা যায় সে মুসলমান। আরবি নাম গ্রহণের জন্যেই তিনি পরিচিত হন মুসলিম হিসেবে এবং এরই বদৌলতে মযবুত হয় বিশ্ব মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাকৃত্ববোধ। পিতার নামেই সন্তানের পরিচয় : পিতাই সন্তানের প্রকৃত হকদার, তাই সন্তান পরিচিত লাভ করবে পিতার নামে এটাই স্বাভাবিক। তা ইসলামের নির্দেশ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘ তোমরা তাদেরকে তাদের পিতার নামেই ডাক, এটাই আল্লাহর নিকট ন্যায়সংগত’’ । (আহযাব : ৫)। হযরত আবু দারদা (রা.) হতে বর্ণিত; রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘‘কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতার নামে। অতএব, তোমাদের নামগুলো সুন্দর করে রাখো।’’ সন্তানের নামের সাথে পিতার নাম সংযুক্ত থাকলে শনাক্তকরণে সুবিধা। এক্ষেত্রে ব্যক্তির নামের সাথে যদি পিতার নাম সংযুক্ত থাকে তাহলে তাকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। অধিকাংশ সাহাবীর নামের সাথে পিতার নাম সংযুক্ত ছিল। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.)। ভালো নাম রাখা পিতার উপর সন্তানের হক : সন্তানের জন্যে ভালো নাম রাখা এটা ইসলামের দেয়া পিতার উপর এক আমানত। পিতার উচিত সে আমানতের খিয়ানত না করে তা সুন্দরভাবে পালন করা। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলূল্লাহ (সা.) বলেছেন- যার সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সে যেন তার সন্তানের নাম সুন্দর করে রাখে এবং তাকে উত্তম আদব কায়দা শিক্ষা দেয়। অর্থবোধক, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন ইসলামী নামকরণের দ্বারা মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতার উন্নতি ঘটে। ভালো নামের বদৌলতে সন্তানের অনাগত দিনগুলো বয়ে আনতে পারে মঙ্গল ও কল্যাণ। তাই সন্তানের জন্যে ভালো এবং অর্থবহ নাম রাখা উচিত এবং এটা হচ্ছে পিতার কর্তব্য। সন্তানের নামকরণের সময়কাল : সন্তান জন্ম্রে সপ্তম দিনে সন্তানের নামকরণ করা সুন্নাত। আবার কেউ কেউ সন্তানের নামকরণের বিলম্ব না করে সন্তান জন্মের পরই সন্তানের নামকরণ করা উত্তম বলে মত ব্যক্ত করেছেন। হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত- রাসুলূল্লাহ (সা.) হযরত হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.)-এর আকীকা করলেন জন্মের সপ্তম দিনে এবং তাদের দুই জনের নাম রাখলেন। (ইবনে হিব্বান ও আল মুস্তাদরেকে হাকেম)। হযরত আমীর ইবনে শুয়াইব তাঁর পিতার সূত্রে, দাদা হতে বর্ণনা করেন, রাসুলূল্লাহ (সা.) আমাকে সন্তান জন্মের সপ্তম দিন তার নামকরণ করতে আদেশ দিয়েছেন (তিরমিযী) । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত-সাতটি কাজ সুন্নাত : ১. জন্মের সপ্তম দিনে সন্তানের নামকরণ করা, ২. খাতনা করা, ৩. সন্তানের শরীরের ময়লা দূর করা, ৪. সন্তানের নামে আকীকা করা, ৫, তার মাথা মুগুন করা, ৬, চুলের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ বা রৌপ্য সাদকাহ করা, ৭. জন্মের সাথে সাথে ডাক কানে আজান ও বাম কানে ইকামত শুনানো। শিরক ও আপত্তিকর নাম : ১. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুুর নামের সাথে আবদ যুক্ত করে নামকরণ করা এক প্রকার শিরক। কারণ আবদ শব্দটি কেবলমাত্র আল্লাহ পাকের নামের সাথেই যুক্ত হতে পারে। মানুষ একমাত্র আল্লাহরই গোলাম, সুতরাং গায়রুল্লাহর সাথে আবদ সংযুক্ত নাম অবশ্যই পরিহার করা দরকার। ২. হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের সাথেও আবদ সংযুক্ত করে নামকলন করা শিরক। মুহাম্মদ (সা.) নিজেই নিজেকে আল্লাহর গোলাম বলে স্বীকার করেছেন, কাজেই কেউ গোলামের গোলাম হতে পারে না। ৩. ইসলামের ইতিহাসে ঘৃণিত নামসমূহ পরিত্যাগ করা উচিত। যেমন ফিরাউন, নমরূদ, শয়তান, শাদ্দাদ, কারুন, আবু জাহিল, আবু লাহাব ইত্যাদি। ৪. যে সকল নাম শুনে যায় না যে, সে মুলিম না অমুসলিম, ছেলে না মেয়ে, মানুষ বা পশু, সে সকল নামও পরিহার করা উচিত। শিশুদের একাধিক নামকরণ : আমাদের দেশে অনেকেই শিশুদের একাধিক নাম রাখেন, আবার অনেকের প্রশ্ন একাধিক নাম রাখা যায় কিনা? আমরা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলার একাধিক নাম দেখতে পাই, যেমন রাহমান, রাহীম ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা বলেন- আল্লাহর অনেক সুন্দর নাম রয়েছে, তোমরা সে নামগুলোতে তাঁকে ডাক ( আরাফ : ১৮০)। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এরও একাধিক গুণাবাচক নাম পবিত্র কুরআন শরীফে পাওয়া যায়, যেমন আহমদ, মুহাম্মদ, আলআমীন, আস সাদিক, মুযাম্মিল, মুদ্দাসসির ইত্যাদি। তাই কোনো শিশুর একাধিক নামে নামকরণ করা যেতে পারে, কিন্তু শর্ত হলো আসল বা ডাক নাম উভয়ই অর্থবহ ইসলামী নাম হতে হবে। ভালো নামের সুফল : মানব জীবনে নাম ও নামের অর্থ গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ভালো নাম জীবনকে যেমন সুন্দর করে, অন্যদিকে খারাপ নাম মানব জীবনে অনেক ক্ষেত্রে বয়ে আনে দু:খ, দুর্দশা ও অশুভ পরিণতি। ভালো নামের বদৌলতে অনেক সময় মানুষের চরিত্র, চালচলন ও আচার-ব্যবহার হয় উন্নত । একটি ঘটনায় উল্লেখ আছে, একদা প্রিয় নবী (সা.) একটি দুগ্ধবতী ছাগল দোহন করার জন্যে বললেন, কে এটাকে দোহন করবে?এক ব্যক্তি দ-ায়মান হয়ে বললেন, আমি, হুজুর (সা.)!তৎক্ষণাৎ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?সে উত্তর দিল মুররাহ (তিক্ত)। তিনি তাকে বললেন, বসো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলেণ, কে এটাকে দোহন করবে? অপর এক ব্যক্তি দাঁড়াল। তাকে নাম জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিল, হারব (যুদ্ধ-বিগ্রহ)। তাকে বললেন, বসো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কে এটাকে দোহন করবে? এক ব্যক্তি দাঁড়াল। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? সে উত্তর দিল, ইয়ায়ীষ (সে বাঁচবে) রাসূল (সা.) তাকে দুগ্ধ দোহনের অনুমতি দিলেন। মন্দ নামের পরিণতি : মন্দ নাম মানব জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে আনে এর একটি ঘনটা উল্লেখ রয়েছে ইমাম মালেক (র.)-এর মুয়াত্তা নামক গ্রন্থে। হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?সে বলল, জামরাত (অগ্নিস্ফুলিঙ্গ)। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার ছেলে? সে উত্তর দিল, ইবনে শিহাব (অগ্নিশিখার পুত্র)। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ি কোথায়? সে উত্তর দিল, বাহরুন নার (অগ্নিগর্ভে) । তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কোন অংশে? সে উত্তর দিল, বিযাতিল লাযা (শিখাময় অংশে)। হযরত উমর (রা.) তাকে বললেন, যাও, তোমার গোত্রের লোকদের নিকট গিয়ে দেখ, তারা ভস্মীভূত হয়েছে। লোকটি বলেন, তাদের কাছে এসে দেখলাম যে, সত্যিই তারা ভস্মীভূত হয়েছে। নাম পরিবর্তন করা যায় কি না? : নাম যদি ভালো, সুন্দর ও অর্থসহ না হয়, তাহলে তা অবশ্যই পরিবর্তন করে ইসলামী নাম রাখা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম পছন্দ করতেন। কেউ তাঁর নিকট আসলে তিনি তার নাম জিজ্ঞেস করতেন। নাম পছন্দ হলে তিনি খুশী হতেন। আর অপছন্দ ও অর্থহীন হলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে নাম পরিবর্তন করে দিতেন। রায়তা বিনতে মুসলিম তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তার পিতা বলেন, হুনায়নের যুদ্ধে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলে বললাম, গুরাব (কাক)। তিনি বললেন, না; তুমি মুসলিম। হিজরতের পূর্বে মদীনার নাম ছিল ইয়াসবির (দোষ দেয়া)। রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরত করে মদীনায় আসার পর এর নাম রাখা হয় মদীনাতুন নবী অর্থাৎ নবীর শহর। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে যেন সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম রাখার তৌফিক দান করেন। আমীন।
লেখক: চিকিৎসক-কলামিস্ট
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

দুইবার লিড নিলেও আত্মঘাতী গোলে ম্যানসিটির ড্রয়ের হতাশা

ব্যাংককে নির্মাণাধীন এক্সপ্রেসওয়ে ধসে নিহত ৫

কুরস্ক মুক্ত করছে রাশিয়া

সংসদে যান সেখানেই হবে মূল সংস্কার : নাহিদকে ফারুক

ইতিমধ্যে বাজারে ছেড়েছে ৪০ লাখ টাকা

ইউরোপে অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ কমেছে ২৫ ভাগ

আইন শৃঙ্খলার উন্নতিতে আরো কঠোর হতে হবে খেলাফত মজলিস

আড়াইহাজারে আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ

ছাত্রদল নেতার উদ্যোগে ঢাবিতে কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতা

ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাই সমাজকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারে

গণমিছিল স্থগিত করেছে বামপন্থী সংগঠনগুলো

‘রমজান আসে কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে মানুষকে পরিশীলিত করতে’

বন্দরে গার্মেন্টসে ডাকাতির ঘটনায় বিএনপি নেতার গাড়ি চালক গ্রেফতার

পাঁচবিবিতে ট্রেনে কাটা পড়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর মাঝে ইবি ছাত্রদলের গণইফতার

গাবতলীর কাগইল ইউনিয়ন বিএনপির ইফতার মাহফিলে মোরশেদ মিল্টন

আইনের শাসন বিশ্বাস করি বলেই আমরা আওয়ামী লীগকে বিতাড়িত করতে পেরেছি

সুনামগঞ্জ সীমান্তে ৬ লাখ টাকার ভারতীয় গরু জব্দ

পাকিস্তানে কেন হামলা চালাচ্ছে বালোচ লিবারেশন আর্মি?

বরিশালে ১৪ লাখ শিশুকে সাফল্যজনক ভাবে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হল