আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.)
২০ মার্চ ২০২৫, ১২:২৫ এএম | আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৫, ০১:০৩ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
রচনাবলি : তার রচিত গ্রন্থের মাঝে রয়েছে- ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ’, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সুর’ (১ম ও ২য় খ-) ও ‘জমিয়ত পরিচিতি’; অনুদিত গ্রন্থসমূহের মাঝে রয়েছে- ‘কিতাবুল আদব’, ‘তানভিরুল মিশকাত’ (৫ম ও ৬ষ্ঠ খ-ের টিকাসহ অনুবাদ), হেদায়া (৪র্থ খ-ের ‘কিতাবুল ওসায়া’-এর অনুবাদ) এবং ‘মসজিদের মর্মবাণী’। আর অপ্রকাশিত গ্রন্থাবলির মাঝে রয়েছে ‘রদ্দে মওদুদিয়্যাত’ ও ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সুর’-এর বাকি অংশ।
সমাজের ভেতর-বাইরে : সমাজসেবক হিসেবেও তিনি ছিলেন অন্যতম এক মনীষা। ১৯৭১ সালে যুদ্ধোত্তর ভেঙেপড়া বাঙালি মুসলিম ও ওলামায়ে কেরামের কল্যাণে তার অবদান চির স্মরণীয়। যুদ্ধের পর বাঙালি মুসলিমের এক বিরাট অংশ মনে করলেন, ভারত নিয়ন্ত্রিত সেক্যুলার সরকারের হাতে তাদের ঈমান ও ইসলাম ভূলুণ্ঠিত হবে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তিনি হ্যান্ডমাইক নিয়ে এ দেশের গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে, মসজিদ থেকে মসজিদে ঘুরে বেড়ান। ভেঙেপড়া মুসলমানদের সান্ত¡না দিয়ে বলেছিলেন, ‘মুসলমান! তুমি যদি সত্যিকার মুসলমান হও, তাহলে নজরুল-তাজউদ্দিন সরকার তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রেসিডেন্ট; তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘এ দেশের সাধারণ ওলামায়ে কেরাম স্বাধীনতার বিরোধিতা করেননি। কাজেই তাদের হয়রানি বন্ধ করার নির্দেশ দিন।’ শেখ মুজিব তখন তাকে কথা দিয়েছিলেন।
অধ্যায়ন যাদের কাছে : তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকদের মাঝে ভারতে ছিলেন- শাইখুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.), শাইখুল আদব আল্লামা এজাজ আলি (রহ.), শাইখুল মাকুল আল্লামা ইবরাহিম বিলয়াভি (রহ.), আল্লামা সাইয়্যিদ ফখরুল হাসান (রহ.), আল্লামা কারি তাইয়িব (রহ.), আল্লামা বশির আহমদ খান (রহ.) ও আল্লামা জলিল আহমদ কিরানভি (রহ.) এবং বাংলাদেশে আল্লামা শায়খ তাজাম্মুল আলি (রহ.) [সিলেট], আল্লামা শায়খ কমরউদ্দিন (রহ.) [সিলেট], আল্লামা আশরাফ আলি (রহ.) [ধর্ম-লি]।
পরশ পেয়ে ধন্য যারা : তার উল্লেখযোগ্য ছাত্রের মাঝে রয়েছেন- মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মুফতি ওয়াক্কাস, মুফতি আবদুল্লাহ হরিপুরি, মুফতি নুরুদ্দিন (রহ.) [সাবেক ইমাম ও খতিব, বায়তুল মোকাররম], মাওলানা খলিলুর রহমান বর্ণভি [মৌলভীবাজার], মাওলানা ড. মুশতাক আহমদ, মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদি (রহ.) [সাবেক মহাসচিব, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ], মাওলানা আনোয়ার শাহ (রহ.) [কিশোরগঞ্জ], মাওলানা আবদুল্লাহ জালালাবাদি, মাওলানা নুরুল ইসলাম, মাওলানা ইসহাক ফরিদি (রহ.), মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.), মাওলানা হাফেজ আবদুর রহমান [মোমেনশাহী], মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.), মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ, মাওলানা আবদুল মতিন, মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ, মুফতি মুহাম্মদ আলি, মাওলানা আবদুল আখির, মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল গাফফার, মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন, মাওলানা জুবাইর আহমদ আশরাফ, মাওলানা লোকমান মাজহারি, মাওলানা জামালুদ্দিন, মাওলানা আবদুর রাজ্জাক, মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ, মাওলানা হামেদ জাহেরি, মুফতি আবদুস সালাম ও মাওলানা জাকারিয়া আবদুল্লাহ প্রমুখ।
পরকাল ভাবনা : তিনি সর্বদাই পরকাল নিয়ে ভাবতেন। পরকাল সম্বন্ধে তিনি তার একনিষ্ঠদের বলতেন ‘অস্থির চিত্তে অতীত জীবনকে সম্বোধন করে এ কথাই বলি, আমায় আবার সেই শৈশবে পৌঁছে দাও, ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে এসেছ যেখান থেকে। অজান্তেই চলে যাচ্ছি দুনিয়ার এ মাহফিল থেকে। সবকিছু বিলিয়ে দিয়েও লাভ-লোকসান চিনলাম না।’
উপদেশ : সবার প্রতি ছিল তার অবিস্মরণীয় এ উপদেশ- ‘দুনিয়ার মোহে পড়ে তোমরা নিজেদের ইলম ও দ্বীন বিক্রি করে দিও না’; ‘মুসলিম জাতির বৈশিষ্ট্য হলো, সে যত বেশি আখেরাতমুখী হবে, দুনিয়া তত বেশি তার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে বিজাতির অনুকরণে সে দুনিয়ার দিকে যত বেশি ঝুঁকে পড়বে, দুনিয়া তত বেশি তার থেকে দূরে সরে যাবে। আখেরাতের ধ্বংস তো তার জন্য অবশ্যম্ভাবী।’
অন্তিম কথা : মৃত্যুর কয়েক মাস আগে হঠাৎ আহলে হাদিস নামধারী কিছু অসাধু ধর্মালম্বী তার বরাত দিয়ে কিছু দ্বীনি কথার নামে ভ-ামি তুলে ধরার চেষ্টা করে। তখন তারই ¯েœহভাজন জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের মুহাদ্দিস ও জামিয়াতুল আসআদের প্রিন্সিপাল মুফতি হাফিজুদ্দিন তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। তখন তিনি একটি অসিয়তনামা লিখে দেন; যা-ই ছিল এ মুসলিম উম্মাহর জন্য তার শেষ কথা। সে অমীয় বাণীয় হচ্ছে, ‘আমি কাজী মুতাসিম বিল্লাহ [পিতা : মাওলানা কাজী সাখাওয়াত হুসাইন (রহ.) ঝুমঝুমপুর, কোতয়ালি, যশোর] সজ্ঞানে দ্বীনি আমানত হিসেবে আমার ছাত্র, মুতাআল্লিকিন, মুহিব্বিন ও সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে এ মর্মে অসিয়ত করছি যে, আমার মৃত্যুর পর আমার কোনো কথা ও লেখা দ্বারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত তথা দেওবন্দি আকাবিরের চিন্তা-চেতনার পরিপন্থি ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই। সকল বাতিল ফিরকা বিশেষ করে মওদুদি-জামায়াত, শিরক, বিদআত ও মিলাদ-কিয়াম সম্পর্কে দেওবন্দি আকাবিরের যেই মতামত, আমারও সেই মত। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও আদর্শগতভাবে আমি আমার উস্তাদ ও মুরশিদ শাইখুল ইসলাম হজরত মাদানি (রহ.)-এর অনুসারী। এতে কারও কোনো আপত্তি আমার কাছে গ্রহণীয় নয়। অতএব, কেউ যদি আমার দিকে ভিন্ন কোনো মতাদর্শ সম্পর্কিত করেন, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। আমার ছাত্র, ভক্ত-অনুরক্ত ও সকল মুসলমানকে আমি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের আকিদার অনুসারী হওয়ার আবেদন করছি।’
কবর দেশে : ২০১৩ সালের ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) দুপুর আড়াইটায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় দেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীনসহ সর্বস্তরের লোকের ঢল নামে। রাজধানীর খিলগাঁও উচ্চবিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজার আগে স্থানীয় ওলামায়ে কেরামসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম ও রাজনীতিবিদ বক্তব্য রাখেন। জানাজাপূর্ব বক্তৃতায় তখনকার আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ বলেন, ‘আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বুজুর্গ ও আলেম। আমরা তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। এ জাতি তার ভালো মানুষের মাঝে আজ একজনকে হারাল। সত্যিই তার অভাব পূরণ নিঃসন্দেহে অসম্ভব।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র মির্জা আব্বাস বলেন, ‘হুজুরের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিন ওঠাবসা করার সুযোগ হয়েছে। হুজুরের মতো এত ভালো মানুষ এবং দ্বীনের জন্য এমন নিঃস্বার্থ লোক এ দেশে বিরল। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, যেন আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচ্চ আসনে আসীন করেন।’ ইসলাহুল মুসলিমীন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইকরা বাংলাদেশ পরিচালক এবং মাসিক পাথেয় সম্পাদক মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘তিনি ছিলেন আমার অন্যতম মুরব্বি। তাকে হারিয়ে আমি আজ অভিভাবকহারা হলাম। আমাদের জীবনে তার অভাব সত্যিই অপূরণীয়।’ বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদি (রহ.) বলেন, ‘আমরা হুজুরকে হারিয়ে আজ জাতির একজন অন্যতম দ্বীনের সেবক হারালাম। মেধা-মননে, আচার-ব্যবহারে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তিনি দ্বীনের জন্য বহু কাজ করে গেছেন। স্বাধীনতার সময় এ জাতির জন্য তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন দ্বীনের এক নির্ভীক সৈনিক, তেমনি আরেকদিকে ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক। হক কথা বলতে কখনও তিনি কাউকে ভয় করতেন না। আমরা তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।’ এ ছাড়া দেশের অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য শেষে দুপুর আড়াইটায় মৃতের অন্তিম ইচ্ছেনুযায়ী তারই শাগরিদ মোমেনশাহীর ইত্তেফাকুল ওলামার সভাপতি মাওলানা আবদুর রহমান হাফেজ্জির ইমামতিতে তার জানাজা আদায় করা হয়। জানাজা শেষে অসংখ্য শ্রদ্ধা-প্রীতি ও ভালোবাসায় সিক্ত করে রাজধানীর শাহজাহানপুর পারিবারিক কবরস্থানে চিরদিনের জন্য তাকে সমাহিত করা হয়। (সমাপ্ত)
লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

চট্টগ্রামে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মহিলার মৃত্যু

রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের দাবি মোটরসাইকেল চালকদের