প্রচলিত দ্রুতগতির সালাতুত তারাবিহ ও নবীজির সালাত
২৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০২ এএম

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পসরা সাজিয়ে প্রতিবছর আমাদের কাছে হাজির হয় বরকতের মাস রমজান। এর আগমনে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে যায়, বন্ধ হয়ে যায় সপ্ত নরকদ্বার। শেকল পরানো হয় ইবলিস ও তার প্রেতাত্মাদের পায়ে। বান্দা যাতে পুরোপুরিভাবেই তার রবের পানে মনোনিবেশ করতে পারে তাই এই আয়োজন। ইবলিস যেনো বান্দার প্রার্থনায় বিঘ্ন ঘটাতে না পারে—এমনই চাওয়া স্বয়ং প্রভুর। এতদসত্তে¡ও রমজান এলেই আমরা যেনো প্রভুর সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে দেই! নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মজুদদারি ও বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করাসহ নানা অনৈতিকতার পাঁচফোড়ন না হয় বাদই দিলাম; ইবাদাতের মাসখ্যাত রমজান মাসেই যেনো আমরা খাস ইবাদাত নিয়েও রবের সঙ্গে প্রতারণায় নামি!
পবিত্র এই মাসের সবচেয়ে বড় আমল হলো সিয়াম সাধনা। সিয়াম সাধনার সুন্দরতম দৃশ্য হলো কোরআন মাজিদ তিলাওয়াত এবং সালাতুত তারাবিহ আদায়। আর সালাত হচ্ছে প্রভুর সঙ্গে বান্দার কথোপকথনের সবচেয়ে মোক্ষম মাধ্যম। প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের পারস্পরিক গোপনালাপের নিখুঁত রূপ। স্রষ্টা ও সৃষ্টির পারস্পরিক মেলবন্ধনের অনুপম সুযোগ। মাহে রমজানে তারাবিহ নামাজের মাধ্যমে এই সুযোগ আরও বেশি প্রকটিত হওয়ার কথা; কিন্তু আমরা করি উল্টোটা! যে সালাতকে বান্দার মি‘রাজ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সেই মি‘রাজে গিয়ে আমরা প্রভুকে খুঁজে পাই না; খুঁজে পাই যেনো ইবলিসকেই! কিরআতে আমাদের এমন ৫-জি গতির তাড়াহুড়ো দেখে শয়তানও যেনো লাজে লুকোয় মুখ!
অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত ছিল এক অনন্য রূপের প্রতিচ্ছবি—বিনয়, নম্রতা, খুশু-খুজু, গভীর মনোযোগ ও পরিপূর্ণতায় ভরা। তাঁর সালাত শুধু শরিয়তের বিধান পালনই ছিল না; বরং এটি ছিল আপন রবের প্রতি তাঁর এক অপার ভালোবাসা, ভক্তি ও আত্মনিবেদন। প্রিয় নবীজি যখন সালাত আদায় করতেন, তখন তিনি প্রতিটি হরফকে এমন বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতেন, যেনো প্রতিটি হরফের উচ্চারণস্থল স্পষ্ট হয়ে যায়। (সুনান আবু দাউদ : ৪০০৯)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একাগ্রতার সাথে নামাজ পড়তেন যে, চারপাশের কোনো কিছু তাঁর মনোযোগ নষ্ট করতে পারত না। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবীজি যখন নামাজে দাঁড়াতেন, তখন এমনভাবে মনোযোগী থাকতেন যে, তিনি আমাদের চিন্তাও করতেন না।’ (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)।
একদা এক সাহাবি (রা.) উম্মুল মু‘মিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নবীজির সালাত কেমন ছিলো?’ প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি প্রিয় নবীজির সালাতের সেই অনুপম সৌন্দর্যের কী বয়ান দেবো!’ নবীজি সালাতে দাঁড়ালে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন। এতে তাঁর পা মোবারকে পানি জমে স্ফীত হয়ে যেতো। একদিন আয়েশা সিদ্দিকা আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার তো কোনো গোনাহই নেই। আপনি এভাবে কেনো নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন?’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমালেন, ‘হে আয়েশা! আল্লাহ তো আমাকে সাইয়্যিদুল মুরসালিন বানিয়েছেন, খাতিমুন নাবিয়্যিন করেছেন। তো আমি কি শোকরগুজার বান্দা হবো না!’ (সহিহ বোখারি : ১১৩০)।
তারাবিহ নামাজ মূলত কিয়ামুল লাইলের অন্তর্ভুক্ত, যা রমজান মাসে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাত হিসেবে চালু করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহিন অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আদায় করতেন। পবিত্র কোরআন মাজিদে ইবাদতের ক্ষেত্রে খুশু-খুজু বা বিনম্রতা এবং মনোযোগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর জন্য বিনীতভাবে দাঁড়াও।’ (সূরা আল-বাকারা : ২৩৮)। আল্লাহপাক অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে মু’মিনগণ সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনম্রতা ও একাগ্রতা অবলম্বন করে।’ (সূরা আল-মু’মিনুন : ১-২)। উপর্যুক্ত আয়াতে কারিমায় আল্লাহপাক মু’মিনগণকে তাঁদের নামাজের মধ্যে খুশু-খুজু তথা একাগ্রতা ও বিনম্রতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
হাদিস শরিফেও ধীর-স্থিরতার সাথে সালাত আদায় করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অনেক নামাজ আদায়কারী নামাজ শেষ করে, অথচ তার জন্য কখনো দশভাগের একভাগ, কখনো নয়ভাগের একভাগ, কখনো আটভাগের একভাগ, এমনকি কখনো অর্ধেকও লেখা হয় না!’ (সুনান আবু দাউদ : ৭৯৬)। এই হাদিসের ভিত্তিতে বলা যায়, যদি দ্রæতগতির কারণে নামাজের খুশু-খুজু বিনষ্ট হয়, তবে তা পরিপূর্ণ নামাজ হিসেবে গণ্য হবে না। হজরত হুযাইফা (রা.) বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক রাকআতে সূরা আল-বাকারা, সূরা আলে ইমরান ও সূরা আন-নিসা তিলাওয়াত করেছেন এবং দীর্ঘ কিয়াম, রুকু ও সিজদা করেছেন। (সহিহ মুসলিম : ৭৭২)। এর মর্মার্থ হলো, তারাবিহ নামাজ ধীরস্থিরভাবে আদায় করাই সুন্নাত।
কিরআত হচ্ছে নামাজের প্রাণস্বরূপ। প্রাণহীন দেহ যেমন মূল্যহীন, তেমনি বিশুদ্ধ ও যথাযথ কিরআত ছাড়া নামাজও প্রাণহীন। আর এই প্রাণহীন নামাজ কখনোই বান্দার মি‘রাজ হতে পারে না। নামাজ আদায়কারীর নামাজ ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নাত-নফল—যা-ই হোক না কেনো, নামাজে বিশুদ্ধ কিরআত পড়া কিন্তু ফরজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘আর আপনি কোরআন তিলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে এবং সুস্পষ্টভাবে।’ (সূরা মুঝ্ঝাম্মিল : ০৪)। এই আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি অতি দ্রæত গতিতে নামাজে কিরআত পড়ার ফলে কোরআনের উচ্চারণ বিকৃত হয় বা অর্থ হারায়, তবে নামাজও ফাসিদ হয়ে যাবে। নবীজি তাঁর এক সাহাবিকে নামাজ শিখিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘নামাজে দাঁড়িয়ে তাকবির বলো, কোরআন পড়ো, রুকু করো এবং তাতে প্রশান্তি পাও; সোজা দাঁড়াও, সেজদা করো এবং তাতে প্রশান্তি পাও; তারপর বসো এবং তাতেও প্রশান্তি পাও।’ (সহিহ বোখারি : ৭৯৩; সহিহ মুসলিম : ৩৯৭)।
উপর্যুক্ত হাদিসের আলোকে এটি প্রণিধানযোগ্য যে, দ্রæতগতিতে তারাবিহ পড়লে যদি রুকু, সিজদা ও অন্যান্য ফরজ রুকন যথাযথভাবে আদায় না হয়, তবে নামাজ শুদ্ধ হবে না। রমজানে তারাবিহ পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। এ উপলক্ষে খতমে তারাবিহও সুন্নাত। তবে ফরজ বা ওয়াজিব নয়। অর্থাৎ তারাবিহ পড়লেই খতমে তারাবিহ পড়তে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সূরা তারাবিহ পড়লেও সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। তবে খতমে তারাবিহ পড়তে গিয়ে বেশিরভাগ প্রচলিত দ্রæতগতির কিরআত সহকারে তারাবিহ পড়লে সুন্নাত আদায় হওয়া তো দূরের কথা, তাতে নামাজও আদায় হবে না। বরং তা লোক দেখানো নামাজ ছাড়া আর কিছুই হবে না। কেননা এমন দ্রæতগতির তিলাওয়াতে কিরআতের পরিপূর্ণ হক আদায় হয় না।
নামাজে কিরআতের পরিপূর্ণ হক আদায় করে কোরআন তিলাওয়াত করা অত্যাবশ্যক। এ সম্পর্কে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘যাদেরকে আমি কিতাব (এবং এর জ্ঞান) দিয়েছি, তারা সেই কিতাবের পরিপূর্ণ হক আদায় করেই তিলাওয়াত করে।’ (সূরা বাকারা : ১২০)। আর নামাজে এমন তাড়াহুড়ো করা মূলত মুনাফিকদেরই বৈশিষ্ট্য। মুনাফিকদের এমন গর্হিত চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘আর তারা (মুনাফিকরা) যখন নামাজে দাঁড়ায়, তারা অলসভাবেই দাঁড়ায়, কেবল মানুষকে দেখানোর জন্যই (যে তারা নামাজ পড়ে!), আর তারা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে।’ (সূরা নিসা : ১৪২)। আল্লাহপাক আমাদের এই মুনাফিকি চরিত্র থেকে হেফাজত করুন। প্রয়োজনে এমন দ্রæতগতির খতমে তারাবিহ বর্জন করে বরং সূরা তারাবিহ আদায় করাই প্রকৃত বুদ্ধিমান ইমানদারের কাজ হবে।
নামাজ তো হৃদয়ের খোঁজে সৃষ্টিকর্তার দরবারে নিবেদন, সেখানে দ্রæতগতির এক দৌড় প্রতিযোগিতা কেনো? আজকাল কিছু মানুষ তারাবিহকে যেনো ১০০ মিটারের স্প্রিন্ট মনে করে—ইমামের তেলাওয়াত বজ্রপাতের গতিতে ছুটছে, আর মুক্তাদিগণ রুকু-সিজদার খেলায় মেতে উঠেছে! অথচ নামাজ তো আত্মার প্রশান্তি, খুশু-খুজুর সমাহার, যেখানে প্রতিটি আয়াত যেনো এক ঝরনাধারা, প্রতিটি রুকু-সিজদা যেনো এক গভীর আত্মনিবেদন। ধীরস্থির, শুদ্ধ উচ্চারণে তেলাওয়াত শুনে অন্তর কাঁপবে, চোখ ভিজে যাবে, হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে উঠবে—এটাই তো প্রকৃত সালাত। আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর এই সুযোগ কি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা? যদি তাড়াহুড়ো করতেই হয়, তবে দুনিয়ার কাজে করা উচিত, নামাজে নয়। কারণ নামাজ তো শুধু একটি কর্তব্য নয়; বরং এটি প্রেমের গভীরতম প্রকাশ!
লেখক : ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

হবিগঞ্জের বাহুবলে ১২ গ্রামের সংঘর্ষ, পুলিশসহ আহত অর্ধশত

ইসরাইলের কাছে বড় ধরনের অস্ত্র বিক্রি বন্ধে মার্কিন কংগ্রেসে বিল

যুক্তরাষ্ট্রের রণতরীতে আবারও হামলা ইয়ামেনের

কাল থাইল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

বরিশালের উজিরপুরে যুবক-যুবতিকে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন

মিয়ানমারে ভূমিকম্পে নিহত ২৭০০ ছাড়াল

৩২ শহীদ পরিবারের সঙ্গে জামায়াত আমিরের ঈদ উদযাপন

ঘিবলি ট্রেন্ডে গা ভাসিয়েছেন? দেখুন কোন বিপদ ডেকে এনেছেন আপনি!

জাপানে মেগা ভূমিকম্পের শঙ্কা, ৩ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা

গাজীপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাইভেটকার চালকের মৃত্যু

লোহাগড়ায় ১০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ

পাকিস্তানকে উড়িয়ে সিরিজ নিউজিল্যান্ডের

মির্জাপুরে মসজিদের ইমামের রাজকীয় বিদায়

মধ্যপ্রাচ্যে আরও বিমানবাহী রণতরী পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, উত্তেজনা বাড়ছে

লোহাগাড়ায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বেড়ে ১০

বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে যা ছিলো

ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন প্রস্তাব মানছে না রাশিয়া

লিবিয়ায় অপহৃত ২৩ বাংলাদেশি উদ্ধার, দুই অপহরণকারী গ্রেপ্তার

পাক-বাংলা সম্পর্ক এবং রুনা লায়লাকে নিয়ে কি বললেন শাহবাজ শরিফ!

রাজশাহীতে ঈদ জামাতে ভেদাভেদ ভুলে সম্প্রীতির জন্য দোয়া