মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয়-৪
০৯ জুন ২০২৩, ১১:৪৩ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম
এর মানে পরিষ্কার। দুর্গের চরিত্রে পরিবেষ্টিত, দুর্গের আকৃতিতে তৈরি ও সজ্জিত মঠের ভেতরে প্রবেশ করতে প্রতিরোধের সম্মুখীন হন বিন বখতিয়ার। ফলে যুদ্ধ হয়। তিনি জয়ী হন এবং ভেতরে প্রবেশ করে যখন দেখলেন বহু গ্রন্থ। তখন এর পাঠোদ্ধার করে বুঝতে পারলেন এটি জ্ঞানাগার, সেনানিবাস নয়। তিনি ভুল বুঝতে পারলেন।
কিন্তু কথা এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বিন বখতিয়ার যে ওদন্তপুরী আক্রমণ করেছিলেন, এটাও সংশয়পরিকীর্ণ। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার (১৯০৭-১৯৮৪) দেখিয়েছেন, ওদন্তপুরী বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। বিভিন্ন গবেষকের মতে, ১১৯১-৯৩ সময়কালে। কিন্তু বিন বখতিয়ারের বঙ্গজয়ের পরের ঘটনা। বস্তুত মুসলিম বিজয়ের আগে বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধবিহারসমূহ প্রচ- প্রতিকূলতার কবলে ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্মমতায় বিহারগুলো এক ধরনের মৃত্যুদশায় উপনীত হয়েছিল। আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া লিখেন, ‘সে সময় ভারতের প্রায় সর্বত্র বৌদ্ধধর্ম এক রকম নিঃশেষ হয়ে আসছিল। বাংলাদেশে যে তখন বৌদ্ধধর্ম ছিল না, সেটি অনুমান করতে কষ্ট হয় না। যদিও লক্ষণ সেনের দ্বিতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রদত্ত তর্পণদীঘি তাম্র শাসনের ভূমির সীমানা উল্লেখ করতে গিয়ে প্রদত্ত ভূমির একপ্রান্তে একটি বিহারের উল্লেখ দেখা যায়, সে বিহারটি আদতে পরিত্যক্ত বিহার ছিল কি না, বলা কঠিন। পরিত্যক্ত না হলেও তা যে নামেমাত্র ও একটি নিষ্প্রাণ বৌদ্ধবিহার ছিল, এ অনুমান যুক্তিসিদ্ধ।
বর্তমান বিহার অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে সে সময় হয়তো বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব ছিল। নামেমাত্র রাজা হলেও পাল বংশের শেষ নৃপতি গোবিন্দ পালদেব অথবা পাল পালদেব একটি ক্ষুদ্রায়তনের রাজ্য নিয়ে কোনো রকমে টিকে ছিলেন বলে ধারণা করা যায়। তাদের প্রভাবেই হয়তো সে অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম কোনো রকমে টিকে ছিল ও আলোচ্য ওদন্তপুরী বিহার বোধ হয় তাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। (তবকাত-ই-নাসিরি, মিনহাজ ই সিরাজ, আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি ঢাকা-১৯৮৩, পৃষ্ঠা-১৯)। মৃতপ্রায় এই বিহার একদা যদিও ছিল গৌরবের তুঙ্গে, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈরিতার অব্যাহত ছোবল যুগ যুগ ধরে তার প্রাণশক্তিকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। বিহারের শেষ পাল রাজারা এর গৌরবের স্মৃতিচিহ্নকেই ধরে রাখছিলেন তখন। বিজয়ী সেনাপতি বিহারের এক কোণে গিয়ে বইয়ের মোলাকাত লাভ করলেন, যা বিহারের দুর্দশাকেই ব্যক্ত করে।
আগেই বলেছি, বিন বখতিয়ারের লাইব্রেরি ধ্বংসের গল্প আগাগোড়া মিনহাজের বয়ানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০) স্বীকার করেছেন, ‘খিলজির বাংলা জয় প্রশ্নে যত কাহিনী ও মতবাদ বাজারে চাউর আছে, সবই মিনহাজের ভাষ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ, এ সম্পর্কে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় নাই।’ রিচার্ড এম ইটন (১৯৬১-২০১৩) লিখেন, ১২০৪ সালে মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের সেন রাজধানী দখলের প্রায় সমসাময়িক একমাত্র বর্ণনা হচ্ছে মিনহাজের তবকাত-ই নাসিরি। ফলে সে বইটিকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন ভালো বিষয়। কিন্তু বইয়ে যা নেই, তা বইয়ে আছে বলে দাবি করাটা বিভ্রান্তিকর। বইয়ে লাইব্রেরি ধ্বংসের কোনো তথ্য নেই। মিনহাজের ওপর ভর করে যারাই বিন বখতিয়ারের লাইব্রেরি ধ্বংসের গল্প রটনা করেন, তারা হয় ভুল করেন, নয় সচেতনভাবে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকবার আক্রান্ত হয় বহিরাগতদের দ্বারা। চরম বৌদ্ধবৈরী মিহিরাকুলের দ্বারা আক্রান্ত হয় স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.)। ঘটে গণহত্যা। স্কন্দগুপ্ত ও তার স্থলবর্তীদের হাতে নালন্দা ঘুরে দাঁড়ালেও রাজা শশাঙ্ক মগধে প্রবেশ করে নালন্দা ধ্বংস করেন। চড়াও হন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোর ওপর। বিনষ্ট করেন বুদ্ধের পদচিহ্ন। শশাঙ্কের বিনাশযজ্ঞের বিবরণ পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের (৬০২-৬৬৪) সফরনামায়। রাজা জাতবর্মা সোমপুর মহাবিহার আক্রমণ করে ধ্বংস করেন। মঠাধ্যক্ষ্য করুণাশ্রী মিত্রকে হত্যা করেন আগুনে পুড়িয়ে। হিন্দু রাজা ভোজবর্মার বেলাবলিপিতে রয়েছে তার বিবরণ।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি এখানে কী করলেন? ভারতের রাজ্যসভায় ২০১৪ সালে কংগ্রেস সদস্য করণ সিং ও সিপিএম সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে নালন্দার ধ্বংস নিয়ে তর্ক হয়। করণ সিং জোরগলায় দাবি করেন বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস হয়। সেটা কবে? ভারতের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ জানাচ্ছে, ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে বিন বখতিয়ার আক্রমণ করেন। স্যার উলসলি হেগের মতে, বিন বখতিয়ার ওদন্তপুরী আক্রমণ করেন ১১৯৩ সালে। স্যার যদুনাথ সরকারের (১৮৭০-১৯৫৮) মতে, ১১৯৯ সালে। কিন্তু বিন বখতিয়ারের বঙ্গে আগমনের ঘটনা ঘটে ১২০৪ সালে! তাহলে কি বাংলায় আসার আগ থেকেই তিনি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস শুরু করেছিলেন? অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। কিন্তু তখনো বিন বখতিয়ারের আগমনই ঘটেনি। যদুনাথ সরকার অবশ্য তার আগমনকে ১২০৪ থেকে পিছিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, তিনি এসেছিলেন ১১৯৯ সালে। কিন্তু তাতেও ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংসের দায় তার ওপর চাপে না। (সমাপ্ত)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
টুঙ্গিপাড়ায় কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন
বিমানযাত্রীর পকেটে মিলল জ্যান্ত সাপ
ডেঙ্গু সচেতনতা সৃষ্টিতে কাউন্সিলররা পাবেন ৫০ হাজার টাকা
হামলা আসন্ন, নাগরিকদের রাফা ছাড়তে বলল ইসরায়েল
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিতে দেশটির পতাকা উত্তোলন ছাত্রলীগের
মিল্টন সমাদ্দার মাদকসেবী, তার টর্চার সেলে অত্যাচারের মাত্রা অমানবিক: ডিবি
সম্পদ অর্জনে এমপিদের চেয়ে চেয়ারম্যানরা এগিয়ে : টিআইবি
দেখতে ঢেউটিনের মতো মনে হলেও এটা ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক!
বিএনপির ভাবনায় ক্লান্ত ওবায়দুল কাদের: রিজভী
ইউপি চেয়ারম্যানকে ‘ডিও লেটার’ বন্ধের হুমকি এমপি একরামের স্ত্রীর
মাগুরায় বিএনপির উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান
২৫ বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্ম জয়ন্তী
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও ইজরায়েলের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় পদযাত্রা
বরগুনায় 'গণমাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা' শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত
আসছে ঘূর্ণিঝড়, দেশজুড়ে কালবৈশাখীর সতর্কতা
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ২ ইউনিয়নে প্রখর রোদ আর তীব্র গরম।।দুর্বিষহ চরবাসীর জীবন
বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর প্রাণী অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছে ব্রিটেনে
পিরিয়ডে হেভি ফ্লো নিয়ে হ্যাসেল-ফ্রি থাকতে, কী করবেন
নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন চেয়ারম্যান পদে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা
বিশ্বে অস্থিরতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে চীন