ইলতুতমিশ, যার হাত ধরে সার্বভৌম সালতানাতের প্রতিষ্ঠা-২

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৬ জুলাই ২০২৩, ১১:৫১ পিএম | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম

আবুল ফজল আরাম শাহকে আইবেকের ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু খলিক আহমদ নেজামী দেখান, তিনি আইবেকের আত্মীয় ছিলেন না। বস্তুত আরাম শাহকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করা হয়েছিল সময় মতো ঘটনাস্থলে আইবেকের অন্য কোনো নিকটজন না থাকার কারণে। আরাম শাহ অল্প সময়ের মধ্যেই তার অদক্ষতা প্রমাণ করলেন। ফলে অভিজাতরা রাষ্ট্ররক্ষার জন্য নতুন শাসকের তালাশ করছিলেন। তারা কুতুবউদ্দিনের জামাতা এবং বাদায়ুনের শাসনকর্তা ইলতুতমিশকে ক্ষমতা গ্রহণের আহবান জানালেন। ইলতুতমিশ এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং দিল্লীর কাছে এক যুদ্ধে আরাম শাহকে পরাস্ত করে দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করলেন।

একদল আমিরের সহায়তায় ক্ষমতা লাভ করলেও ইলতুতমিশের সিংহাসন ছিলো কাঁটায় পরিপূর্ণ। আভ্যন্তরীণ সমস্যা যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো বহিরাগত জটিলতার চোখ রাঙানি। গজনীর শাসক তাজুদ্দিন ইলদুজ নিজেকে ঘুরির উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়াসী ছিলেন। ভারতীয় যেসব এলাকা জয় করেছিলেন ঘুরি, তিনি সে সব স্থানের কর্তৃত্ব চান। মুলতানের শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচা নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করলেন এবং গোটা পাঞ্জাব দখলের অভিযান শুরু করলেন। বাংলার শাসক আলী মর্দান বাংলায় স্বাধীন শাসন শুরু করলেন। গোয়ালিয়র, রণথম্ভোরসহ কয়েকটি রাজপুত রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করলো এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করলো। ইলতুতমিশকে হয় এদের দাবি মেনে নিতে হতো, না হয় তাদের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হতে হতো।

পরিস্থিতির ভয়াবহতার মুখে দৃশ্যত কোনো শক্তিই ইলতুতমিশকে মোকাবেলার পথে পা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করছিলো না। কিন্তু বিদ্রোহগুলোর মোকাবেলা না হলে স্বাধীন রাষ্ট্রটির অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা এই দ্রোহের স্রোত সামলাতে দরকার ছিলো ধৈর্য, বিচক্ষণতা, ক‚টনীতি এবং সামরিক দক্ষতার সুষম সমন্বয়। ইলতুতমিশ কঠিনেরে ভালোবাসিলেন। কিন্তু তার জন্য গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি করলো দিল্লীর আশপাশের কিছু অভিজাতের আনুগত্যহীনতা। তুর্কি এই প্রভাবশালীরা তার অধীনতা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এদের নেতা ছিলেন মুহজি ও কুতবি আমিরগণ। প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে তাদের প্রভাব ছিলো শক্ত। ফলে ক্ষমতাসীন হবার পরপরই দিল্লীর উপকণ্ঠে জুধ নামক স্থানে বিক্ষুদ্ধ মুহজি ও কুতবি আমীরদের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। তুমুল সংঘর্ষে তাদেরকে পরাজিত করে দিল্লী ও পার্শ্ববর্তী অযোধ্যা, বেনারস, বদায়ুন, সিউয়ালিক প্রভৃতি অঞ্চলের উপর তিনি নিজের আধিপত্য সংহত করেন। অপরদিকে ভারতের উত্তর সীমান্তে প্লাবনের মতো এগিয়ে আসছিলো চেঙ্গিস খানের সৈন্যরা। ধ্বংস ও গণহত্যার কাহিনী বিস্তার করে স্বয়ং চেঙ্গিস খান নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের। সঙ্কটের এই সর্বাত্মক ঝড়ে ইলতুতমিশ ভেসে যাবেন, এমনই ধারণা ছিলো অনেকের। কিন্তু তিনি রুখে দাঁড়ালেন সবলে। প্রতিটি সঙ্কটের মোকাবেলা করলেন দক্ষ হাতে। দিল্লীর সালতানাতের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্রোহগুলোকে দমন করতে তার দশ বছর লেগে যায়, ১২১০ থেকে ১২২০ খ্রিস্টাব্দ অবধি ধারাবাহিক প্রয়াসে বিদ্রোহী অঞ্চলগুলোতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নির্বিঘœ হয়। এতে তিনি সামরিক শক্তিপ্রদর্শনে যেমন কসুর করেননি, তেমনি যুদ্ধ এড়াবার প্রয়াসেও কমতি ছিলো না তার।

১২১৪ খ্রিস্টাব্দে খাওয়ারিজমের শাহ আলাউদ্দিন মুহম্মদের অভিযানে বিতাড়িত হয়ে গজনীর শাসক ইলদুজ ভারতে প্রবেশ করেন। পাঞ্জাব থেকে থানেশ্বর পর্যন্ত এক বিরাট এলাকার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মুহম্মদ ঘুরির প্রকৃত উত্তরাধিকারী বলে নিজেকে দাবি করতেন তিনি। ইলতুতমিশকে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানান। ইলতুতমিশ মনে করিয়ে দেন, বংশগত অধিকারের দিন চলে গেছে। এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নতুন সাম্রাজ্য, নতুন নিয়ম। পত্রযোগে এ আলাপের পরে যুদ্ধ ছিলো অবধারিত। ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের সন্নিকটে তরাইনের যুদ্ধে সুলতান ইলদুজকে পরাজিত ও বন্দী করেন। বন্দি অবস্থায় মৃত্যু হয় ইলদুজের। এ বিজয়ের ফলে ইলতুতমিশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্ব›দ্বী ময়দান থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেলেন। গজনী প্রশাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হলেন তিনি। গজনীর তরফ থেকে তার কাছে অধীনতা দাবি করবে, এমন কেউ আর রইলো না।

নাসিরুদ্দীন কুবাচার হুমকি মোকাবিলায় ইলতুতমিশ অগ্রসর হলেন অতঃপর। চেনাব নদীর তীরে মনসুরায় উভয়ের যুদ্ধ হলো ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে। কুবাচা পরাজিত হয়ে পাঞ্জাবে পালালেন। এরপর লাহোর দিল্লীর অধীনে এলেও সিন্ধু অঞ্চলে কুবাচার শাসন টিকে রইলো। ইলতুতমিশের মনোযোগ তখন চেঙ্গিস খানের সম্ভাব্য অভিযানের দিকে। ১২২৭ সালে কুবাচা আবারো বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন ইলতুতমিশ। ১২২৭ সালের শেষ দিকে সিন্ধুর ভাক্কারে উভয়ের যুদ্ধ হয়। এতে ভীষণভাবে পরাজিত হয়ে পলায়নের পথে সম্ভবত সিন্ধুনদে ডুবে প্রাণ হারান কুবাচা। (চলবে)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেনা অভিযানে চুরি ওষুধসহ আটক-২

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেনা অভিযানে চুরি ওষুধসহ আটক-২

বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে আমেরিকা শৈলকুপায় সৈয়দ রেজাউল করিম

বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে আমেরিকা শৈলকুপায় সৈয়দ রেজাউল করিম

সেনবাগে যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শাশুড়ী আটক !

সেনবাগে যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শাশুড়ী আটক !

কেশবপুরে গাঁজা সেবনকালে সমন্বয়কসহ ৪ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

কেশবপুরে গাঁজা সেবনকালে সমন্বয়কসহ ৪ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

তৃণমূল বিএনপির মূল শক্তি - আবুল হোসেন আজাদ

তৃণমূল বিএনপির মূল শক্তি - আবুল হোসেন আজাদ

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে ডিএমপির নির্দেশনা

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে ডিএমপির নির্দেশনা

বিবাহ নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

বিবাহ নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

ফরিদপুরে জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি পরিচয়ে আ.লীগকে পুর্নবাসনের অভিযোগ

ফরিদপুরে জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি পরিচয়ে আ.লীগকে পুর্নবাসনের অভিযোগ

কালিয়াকৈরে পেপসি কারখানায় হামলা, ভাংচুরের চেষ্টা

কালিয়াকৈরে পেপসি কারখানায় হামলা, ভাংচুরের চেষ্টা

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপি নেতা হাজী ইদ্রিস গ্রেফতার

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপি নেতা হাজী ইদ্রিস গ্রেফতার

ইবির আরবী বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বিদায় ও সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর

ইবির আরবী বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বিদায় ও সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর

নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে: টিপু

নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে: টিপু

মাশহাদে ১৮তম আন্তর্জাতিক পর্যটন ও হস্তশিল্প মেলা

মাশহাদে ১৮তম আন্তর্জাতিক পর্যটন ও হস্তশিল্প মেলা

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

নতুন পারমাণবিক সাফল্য উন্মোচন করলো ইরান

নতুন পারমাণবিক সাফল্য উন্মোচন করলো ইরান

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শরণখোলায় বিএনপির প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শরণখোলায় বিএনপির প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

তুর্কি অ্যারোস্পেসের সিইও’র সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক

তুর্কি অ্যারোস্পেসের সিইও’র সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক

বিচারক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে আইন মন্ত্রণালয়: আইন উপদেষ্টা

বিচারক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে আইন মন্ত্রণালয়: আইন উপদেষ্টা