নাসিরুদ্দীন মাহমুদ : কূটনীতি ও দরবেশীর সালতানাত-১

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

৩১ আগস্ট ২০২৩, ১০:৫৫ পিএম | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০১ এএম

প্রায়ই ভুল করে বলা হয়, সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ ছিলেন শামসুদ্দীন ইলতুতমিশের পুত্র। প্রকৃতপক্ষে ইলতুতমিশের নাতি ছিলেন তিনি। ইলতুতমিশের পুত্র যুবরাজ নাসিরুদ্দীন বাংলায় মারা যান, লাখনৌতিতে। তিনি একটি ছেলে রেখে যান, ছেলেটি তার মৃত্যুর পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবুল কাশেম ফেরেশতা এটাই লিখেছেন। সুলতানের বড় ছেলের নাম ছিল নাসিরুদ্দীন। লাখনৌতিতে তার মৃত্যুর পর এই ছেলে (সুলতান নাসিরুদ্দীন) জন্মগ্রহণ করেন, যিনি ছিলেন যুবরাজ নাসিরুদ্দীনের কনিষ্ঠ পুত্র। ইলতুতমিশ তার মরহুম ছেলের প্রতি ভালোবাসার কারণে নাতিরও একই নাম রেখেছিলেন এবং তার শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। পারিবারিক কারণে, ইলতুতমিশ শিশুটিকে তার নাতি নয় বরং তার পুত্র হিসেবে বিবেচনা করতে চেয়েছিলেন। সারাজীবন তাকে ইলতুতমিশের পুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের অবস্থান আলাদা। মিনহাজুস সিরাজ লিখেছেন, ‘সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ ছিলেন সুলতান আমির-উল-মুমিনীন নাসিরুদ্দীনের পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর তিনি দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।’

ইলতুতমিশ তাকে তার বড় ছেলের ‘নাম’ ও ‘উপাধি’ দেন এবং তাঁর মায়ের জন্য লোনি গ্রামের একটি প্রাসাদ বরাদ্দ করেন, যাতে তিনি সন্তানকে সেখানে লালন-পালন করতে পারেন।
১২২৯ হিজরীতে জন্ম হয় নাসিরুদ্দীনের। বাল্যকালেই তাকে লোনি প্রাসাদ থেকে এনে দৌলতখানায় রাখা হয়। তখন তিনি একটি জেলাও শাসন করতে পারতেন না। পরে তুর্কি নেতারা তাকে দিল্লিতে আসার আমন্ত্রণ জানান। তখন তার বয়স ১৩ কী ১৪ বছর।

তার মা দৌলতখানা থেকে তাকে নিয়ে এলেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, নাসিরুদ্দীন অসুস্থ এবং তাকে চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে না নিয়ে উপায় নেই। দিনের বেলা তিনি তাকে নিজের পালকিতে নিয়ে যেতেন, কিন্তু রাতে ঘোড়ায় চড়াতেন। এভাবে কিছু ঘোড়সওয়ার এবং কয়েকজন পদাতিক সৈন্য নিয়ে তিনি সম্ভাব্য দ্রুত গতিতে দিল্লিতে পৌঁছে যান। তার আগমনের খবর তারাই জানত, যারা নাসিরুদ্দীনকে ক্ষমতায় বসানোর গোপন চেষ্টায় লিপ্ত ছিল।

২৩ মহররম ৬৪৪ হি., ২৭ মে ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। দু’দিন পর তিনি ফিরোজা প্রাসাদের দরবার হলে সভা ডাকেন এবং লোকজনের কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ নেন। সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদকে সাধারণত একজন দরবেশ ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিত্রিত করা হয়, যিনি তার পুরোটা সময় ইবাদত-বন্দেগি করে কাটাতেন। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক বিষয়ে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। এই মতামত তার জীবনের মৌলিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। এসব বিষয় গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, তিনি যদি কেবলই ইবাদত-বন্দেগি নিয়ে থাকতেন, তাহলে তিনি রাজনৈতিক জীবনের উত্তাপ হতে রক্ষা পেতেন। তিনি মূলত তার আদর্শে একজন রাজনৈতিক মানুষ ছিলেন এবং প্রতিকূল উত্তাপের মধ্যেও তিনি বছরের পর বছর মাথা উঁচু করে রেখেছিলেন। এটা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির ছোটখাটো কোন প্রমাণ নয়।

ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর (১২৩৬-৩৭), চারজন যুবরাজকে সিংহাসনে বসানো হয় এবং তাদের পদচ্যুত করে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। এটি ছিল ষোল/সতেরো বছর বয়সী তরুণের জন্য একটি সতর্কতা। প্রভাবশালী শামসি মালিকরা ছিলেন তার সমর্থক এবং তার জন্য বিপদের উৎস। তিনি তাদের পরামর্শ মেনে নিতে বাধ্য ছিলেন, কারণ তার আর কোনো উপায় ছিল না। আবদুল মালিক ইসামী জানান, তিনি সামরিক নেতাদের অনুগ্রহ লাভ করেন এবং তাদের প্রত্যেককে আন্তরিকভাবে শুভেচ্ছা জানান। তিনি তাদের অনুমতি ব্যতীত তার কোনো মতামত প্রকাশ করতেন না এবং তাদের অনুমতি ব্যতীত এক পা-ও নড়াচড়া করতেন না, পানি পান করতেন না বা তাদের না বলে ঘুমাতেন না। এটি খুব সম্ভবত ক্ষমতাগ্রহণের প্রথম বছরগুলোর অবস্থা। এর অন্তত একটি ভালো দিক ছিল। তাকে পূর্ববর্তী যুবরাজদের মতো বিপদে পড়তে হয়নি, বরং একজন নিরাপদ মানুষ হিসেবে শাসন শুরু করেছেন। প্রকৃতপক্ষে শামসি আমির-ওলামাদের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার আগে নাসিরুদ্দীন কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হননি। তিনি সিংহাসনে বসতেন এবং জনগণের সুপারিশকৃত আদেশ কার্যকর করতেন। তবে শাসনামলের প্রায় দুই বছরের মধ্যে একটি সমস্যার সম্মুখীন হন।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা

সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা

চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত

চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত

দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী

দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব

রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব

রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি

রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি

আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?

আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?

রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা

রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা

লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই

লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ

নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা

রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ

রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন

রাইসিকে সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল

রাইসিকে সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল

ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার

ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার

প্রথম ভারতীয় হিসাবে ‘গ্লোবাল ডিসরাপ্টর্স’ তালিকায় দীপিকা

প্রথম ভারতীয় হিসাবে ‘গ্লোবাল ডিসরাপ্টর্স’ তালিকায় দীপিকা

মাগুরায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রকৌশলী তাপস নিহত

মাগুরায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রকৌশলী তাপস নিহত