গিয়াসুদ্দীন বলবন : স্থিতিস্থাপক সুলতান-১

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:২২ পিএম | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম

সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদের প্রধান উজির ছিলেন গিয়াসউদ্দীন বলবন। সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ ২২ বছরের কিছু বেশিদিন সুলতান ছিলেন। তিনি সা¤্রাজ্যের শাসনভার মূলত গিয়াসউদ্দীন বলবনের ওপরই ছেড়ে দেন। গিয়াসউদ্দীন বলবন কার্যত ছিলেন দ্বিতীয় শাসক। ফিরিশতা লিখেছেন: সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ উজির হিসেবে বলবনকে নিয়োগ দিয়ে বলেন, আমি তোমাকে আমার নায়েব বানালাম এবং আল্লাহর মখলুকের শাসক বানালাম। সুতরাং তুমি কখনো এমন কোনো কাজ করবে না, যার ফলে আল্লাহর কাছে আমাকে লজ্জিত হতে হয় এবং জবাব দিতে হয়। গিয়াসউদ্দীন বলবন তার দায়িত্ব পালনকালে একথা অক্ষরে অক্ষরে স্মরণ রাখেন। অত্যন্ত বিশ্বাস ও সক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদের ইন্তেকালের পর তার কোনো সন্তান-সন্ততি না থাকায় গিয়াসউদ্দীন বলবন পরবর্তী সুলতান হন। ব্যক্তিগত সম্পর্কে বলবন ছিলেন সুলতানের শ্বশুর। ৬০ বছর বয়সে গিয়াসউদ্দীন বলবন সুলতান হন এবং ২১ বছর রাজত্ব করেন। তিনি ছিলেন সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম।

গিয়াসউদ্দীন বলবন ছিলেন শামসুদ্দীন ইলতুতমিশের গুলামান-ই-চিহিলগানী বা চল্লিশজন ক্রীতদাসের অন্যতম। তুর্কিস্তানের ইলবারী বংশোদ্ভুত বলবনের বাল্যনাম ছিল বাহাউদ্দিন। কৈশরে মোঙ্গলরা তাকে ধরে এনে বসরার বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করে। প্রভাবশালী বণিক খাজা জামালউদ্দিন হন তার ক্রেতা। বলবনের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা ছিলো প্রশংসনীয়। জামালউদ্দিন তাকে বিশেষভাবে গড়ে তোলেন। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশ তাকে যখন প্রথমবার দেখেন, তখনই তাকে প্রতিভাবান হিসেবে চিনতে পারেন। তিনি তাকে ক্রয় করে নেন। বলবনের দক্ষতা ছিলো, বিশ্বস্ততায়ও কমতি ছিলো না। ইলতুতমিশ তাকে বিখ্যাত ‘তুর্কান-ই-চাহেলগান’-এর সদস্য বানিয়ে নেন। পরে নিজ কন্যার সাথে তার বিয়ে দেন। প্রশাসনে বলবনের প্রতিপত্তি ছিলো প্রশ্নাতীত। রাজিয়ার আমলে তিনি ছিলেন ‘আমির-ই-শিকার’। শুরুতে রাজিয়ার সমর্থক হলেও ইয়াকুতের প্রতি রাজিয়ার মুগ্ধতায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। তার বিরোধিতায় লিপ্ত হন এবং বাহরাম শাহ’কে সুলতান বানাতে প্রধান ভূমিকা রাখেন।

বাহরাম খান সুলতান হয়ে দুই এলাকার জায়গীর দেন তাকে। বেওয়ার ও হানসীর জায়গীর লাভ করে বলবন আরো প্রতিপত্তির দিকে পা বাড়ান। সুলতান মাসুদ শাহ ক্ষমতায় বসলে তিনি হন রাজপ্রসাদের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। মোঙ্গল-নেতা মঙ্গু এসময়ে ভারতের সীমান্তে আক্রমণ করেন। আক্রমণ প্রতিরোধে বলবন প্রধান ভূমিকা রাখেন। সামরিক সক্ষমতা, দৃঢ় মনোবল, কৌশল ও বীরত্ব দিয়ে তিনি নতুন প্রেরণার কাহিনী রচনা করেন। রাজপুতরা বিদ্রোহ করেছিলো। তিনি এদের দমনেও সফল অভিযান পরিচালনা করেন। তখনো বয়সে তিনি তরুণ। কিন্তু অভিজাত চল্লিশচক্রের মধ্যে তার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। নাসিরুদ্দীন মাহমুদের দিল্লির শাসক হওয়ার পেছনে বলবেনের পরিকল্পনা ছিলো। মাসুদ শাহের অপসারণে নেতৃত্ব দেন বলবন। নাসিরুদ্দীন ক্ষমতায় বসলে তিনি হন শাসনযন্ত্রের আসল চালক। সুলতান ছিলেন নাসিরুদ্দীন। কিন্তু শাসক ছিলেন বলবন। এতে তিনি বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রশাসনিক দক্ষতার প্রমাণ রাখেন। বিদ্রোহের জন্য বিখ্যাত খোক্কর দমন করেন, মেওয়াতের উপজাতীয় নৈরাজ্য মোকাবেলা করেন, বাংলার বিদ্রোহ প্রশমিত হয় তার কূটনীতির ফলে, মোঙ্গলদের হানাদারি প্রশমনে হালাকু খানের সাথে চুক্তি করেন। দিল্লির অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ করা ছিলো দুরুহ ও জটিল। সেটা তিনি করেন বল প্রয়োগে ও কৌশলে। ফলে এটা খুব অস্বাভাবিক ছিলো না যে, নাসিরুদ্দীন মাহমুদের পরে তিনি শাসক হতে যাচ্ছেন।

কিন্তু নাসিরুদ্দীনের সন্তান-সন্ততি না থাকলেও ইলতুতমিশের বংশধারা বিদ্যমান ছিলো। ১২৬৬ সালে জীবিত ছিলেন সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদের চার ছেলে: মালিক রুকনুদ্দিন ফিরোজ শাহ, মালিক শিহাবুদ্দিন ফিরোজ শাহ, মালিক শিহাবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ, মালিক তাজুদ্দিন ইবরাহিম শাহ ও মালিক সাইফুদ্দিন বাহরাম শাহ। তাদের মধ্যে যাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিলো, তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয় এবং অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা হয়। রাজবংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন হয়।

ইসামির ভাষ্যমতে, ‘বলবন সিংহাসনে আরোহণ করলে, তুর্কি অভিজাতদের কোমর ভেঙে যায়। তারা অনায়াসে তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।’ সিংহাসনলাভের পর বলবন নানা সঙ্কটের মুখোমুখি হন। তিনি যেসব নীতি ও উপায় অবলম্বন করে ক্ষমতায় এসেছিলেন, নিজেই সেগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেন, যেন অন্য কেউ এগুলোকে অবলম্বন করে তার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। ফলে নিজের অমাত্যদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নতুন করে বিন্যস্ত করতে হয়। মালিক ও আমির-উমারাদের এ কথা জানানো দরকার ছিল, বাদশাহী তাদের বিষয় নয় এবং বাদশাহ ও অভিজাতদের মধ্যে একেবারেই কোনো প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দ্ব চলবে না। দাস অফিসারদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের দীর্ঘ অধ্যায় চলে আসছিলো। সেই দ্বন্দ্বের অংশ ছিলেন তিনিও। এর অবসান ঘটানো জরুরি ছিল। দিল্লির সুলতানের ক্ষমতাকে সুসংহত করা একান্ত জরুরি ছিলো, যেন তার গৌরব ও শান-শওকত প্রতিষ্ঠিত থাকে। ভারতের জন্য, একটি নতুন কিন্তু অল্পমেয়াদী শাসনবিধি ও প্রশাসনব্যবস্থাপনা আইন তৈরি জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।

বলবনের সামনে দ্বিতীয় তাৎক্ষণিক সমস্যা ছিল শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা। ‘নায়েবে মামলাকাত’ পদে থাকাবস্থায় শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার হতে পারে শুধুমাত্র একটি স্থিতিশীল সামরিক বাহিনীর মাধ্যমেই। সেজন্য প্রয়োজন নিয়মিত পুলিশ বাহিনী। আইনশৃঙ্খলারক্ষী বাহিনী গঠনে যখন উদ্যোগ নিলেন, ধেয়ে এলো মঙ্গোল আক্রমণ। কিছু রাজ্যে দেখা দিলো বিদ্রোহ। এ পরিস্থিতির মোকাবেলায় বলবন ছিলেন দৃঢ়চিত্ত। তিনি জানতেন, একজন সুলতান হিসেবে তার অবস্থান কী, সেটা নির্ধারিত হবে শান্তি ও নিরাপত্তা দ্বারা এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে।

বলবনের জন্য অসুবিধার চারটি এলাকা ছিল। দিল্লির শহরতলীতে, দুটি নৌপথে, বাণিজ্যসড়কে এবং বিশেষ করে অযোধ্যা ও কাঠির (রোহিলখন্ড) যাওয়ার পথে ওঁত পেতে থাকতো বিদ্রোহী গোষ্ঠী। প্রথম তিনটি অঞ্চলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছিলো। বলবন তার সমাধানে নিলেন প্রবল পদক্ষেপ। জিয়াউদ্দিন বারানি লিখেছেন, ‘আমি নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে শুনেছি যে, সুলতান বলবন তার শাসনামলের প্রথম বছর ব্যস্ত ছিলেন দিল্লির চারপাশের জঙ্গল কেটে মেও বিদ্রোহকে মোকাবেলার কাজে। শহরের বাইরে গিয়ে তিনি তার সামরিক তাঁবু স্থাপন করেন এবং মেওদের দমনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অভিযান বলে গণ্য করেন।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেনা অভিযানে চুরি ওষুধসহ আটক-২

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেনা অভিযানে চুরি ওষুধসহ আটক-২

বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে আমেরিকা শৈলকুপায় সৈয়দ রেজাউল করিম

বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে আমেরিকা শৈলকুপায় সৈয়দ রেজাউল করিম

সেনবাগে যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শাশুড়ী আটক !

সেনবাগে যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শাশুড়ী আটক !

কেশবপুরে গাঁজা সেবনকালে সমন্বয়কসহ ৪ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

কেশবপুরে গাঁজা সেবনকালে সমন্বয়কসহ ৪ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

তৃণমূল বিএনপির মূল শক্তি - আবুল হোসেন আজাদ

তৃণমূল বিএনপির মূল শক্তি - আবুল হোসেন আজাদ

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে ডিএমপির নির্দেশনা

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে ডিএমপির নির্দেশনা

বিবাহ নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

বিবাহ নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

ফরিদপুরে জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি পরিচয়ে আ.লীগকে পুর্নবাসনের অভিযোগ

ফরিদপুরে জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি পরিচয়ে আ.লীগকে পুর্নবাসনের অভিযোগ

কালিয়াকৈরে পেপসি কারখানায় হামলা, ভাংচুরের চেষ্টা

কালিয়াকৈরে পেপসি কারখানায় হামলা, ভাংচুরের চেষ্টা

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপি নেতা হাজী ইদ্রিস গ্রেফতার

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপি নেতা হাজী ইদ্রিস গ্রেফতার

ইবির আরবী বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বিদায় ও সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর

ইবির আরবী বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বিদায় ও সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর

নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে: টিপু

নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে: টিপু

মাশহাদে ১৮তম আন্তর্জাতিক পর্যটন ও হস্তশিল্প মেলা

মাশহাদে ১৮তম আন্তর্জাতিক পর্যটন ও হস্তশিল্প মেলা

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

নতুন পারমাণবিক সাফল্য উন্মোচন করলো ইরান

নতুন পারমাণবিক সাফল্য উন্মোচন করলো ইরান

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শরণখোলায় বিএনপির প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শরণখোলায় বিএনপির প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

তুর্কি অ্যারোস্পেসের সিইও’র সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক

তুর্কি অ্যারোস্পেসের সিইও’র সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক

বিচারক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে আইন মন্ত্রণালয়: আইন উপদেষ্টা

বিচারক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে আইন মন্ত্রণালয়: আইন উপদেষ্টা