গিয়াসুদ্দীন বলবন : স্থিতিস্থাপক সুলতান-৪

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০২ এএম

সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠন করতে গিয়ে বলবন ‘ইকতা’ ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটান। ইলতুৎমিশের আমলে দোয়াব অঞ্চলে প্রায় দু-হাজার সেনাকে ‘ইকতা’ হিসেবে জমি দেওয়া হয়েছিল। ‘ইকতা’ ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল:

(১) দক্ষ সৈনিকদের সেবার পুরস্কার হিসেবে নির্দিষ্ট ভ‚খÐ ইকতা হিসেবে প্রদান করে তার সম্মান ও কর্মপ্রেরণা বৃদ্ধি করা এবং (২) দিল্লির দূরবর্তী অঞ্চলে ইকতাদারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বলবৎ রাখা। এ ছাড়া ইকতার উদ্বৃত্ত রাজস্ব রাজকোষে জমা দেওয়া এবং সুলতানের প্রয়োজনে সামরিক সাহায্য দেওয়াও ইকতাদারদের অবশ্য কর্তব্য ছিল। কিন্তু ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পরে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে ‘ইকতা’ ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। ইকতাদারদের মধ্যে স্বাধীনতাস্পৃহা এবং দিল্লির কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কেন্দ্রীয় শক্তিকে সুদৃঢ় করার জন্য যে ইকতা-প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল, সেটাই বিচ্ছিন্নতার কারণে পরিণত হয়েছিল। বলবন অনুসন্ধান করে দেখেন যে, ইতোমধ্যে বহু ইকতাদার মারা গেছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা তখন অতিবৃদ্ধ। তাই বলবন সিদ্ধান্ত নেন, ‘যেহেতু সামরিক সেবার বিনিময়ে ইকতা প্রদান করা হয়েছিল, তাই যেখানে সামরিক সেবা পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে ইকতা অনুদান বাতিল বলে গণ্য হওয়া উচিত।’

দেশব্যাপী অনুসন্ধান করে এক নির্দেশ জারি করেন বলবন। এর মাধ্যমে সমস্ত ইকতা প্রত্যাহার করা হয়। বিনিময়ে বৃদ্ধ ইকতাদারদের ২০/৩০ টাকা ভাতাদানের ব্যবস্থা করেন এবং সক্ষম ব্যক্তিদের নগদ বেতনের শর্তে নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে নেন। সুলতানের এই সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট ইকতাদারদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বারাণী লিখেছেন: ‘তাদের অনুরোধে দিল্লির প্রখ্যাত কোতোয়াল মালিক ফখরুদ্দীন সুলতানের কাছে ওকালতি করেন এবং ফখরুদ্দীনের যুক্তিতে প্রভাবিত হয়ে বলবন ওই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেন।’ অবশ্য হাবিবউল্লাহ লিখেছেন: ‘এই সময় বলবন কেবলমাত্র বৃদ্ধ ও অশক্ত ব্যক্তিদের ওপর থেকে নির্দেশ প্রত্যাহার করেন; অন্যান্যদের জন্য তা বলবৎ ছিল।’

বলবন মনে করতেন, সামরিক বাহিনী যেমন সুলতানের শক্ত বাহু, তেমনি দক্ষ গুপ্তচরবাহিনী সুলতানের প্রখর দৃষ্টিশক্তি বিশেষ। এই দু-এর মিলিত শক্তি স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। তাই তিনি দক্ষ গুপ্তচরবাহিনী গঠন করেন। ‘বারিদ’ নামে পরিচিতি এই গুপ্তচরবাহিনীতে শুধুমাত্র সৎ, দায়িত্ববান এবং মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারভুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হতো। এদের মাধ্যমে রাজ্যের ঘটনাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সর্বদা সুলতানের গোচরে থাকত। সুলতানের আত্মীয় পরিজন, উচ্চপদস্থ কর্মচারীবৃন্দ, আমির মালিকগণ, এমনকি সুলতানের প্রিয় পুত্ররাও ‘বারিদ’ এর তীক্ষè দৃষ্টি এড়িয়ে কিছু করতে পারত না। স্ট্যানলি লেনপুল লিখেছেন: ‘বলবনের রাজ্যে এমন কিছুই ছিল না যার খবর বারিদরা রাখত না।’ তবে নিয়োগকর্তার সাথে গুপ্তচরদের প্রকাশ্য যোগাযোগকে বলবন প্রশাসনের পক্ষে শুভ মনে করতেন না।

রাজতান্ত্রিক আদর্শের পরিপূরক হিসেবে বলবন দরবারি আদব-কায়দা ঢেলে সাজান। দরবারি পেশাক হবে সুসজ্জিত। তিনি যখনই বের হবেন, উন্মুক্ত তরবারি হতে বিশেষ রাজকীয় বাহিনী থাকবে তার চারপাশে। দরবারে থাকবে ভীতিপূর্ণ সমীহ। না চলবে কোনো চপলতা, না কোনো পরিহাস।সোনা-রূপার পাত্র, বিচিত্র অলঙ্কার, সুগন্ধি ও উন্নত পোশাক, রাজকীয় বিলাসিতা ও ক্ষমতার প্রদর্শনী বিশেষ মাত্রা লাভ করতো তার দরবারে। বিচিত্র অনুষ্ঠান হতো কিছু দিন পরপর। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তো ঐশ্বর্যের গল্প। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা তার দরবারে এলে হতবাক হয়ে যেত। সুলতান যখন বের হতেন, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং মহিমার প্রতীক হিসেবে সৈন্যরা শ্লোগানে মুখর করতো চারপাশ।

ধনরতœ চারদিকে, কর আদায় হচ্ছে যথাযথভাবে। বাণিজ্যপরিস্থিতি উন্নত। পথঘাট নিরাপদ। কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি বা মজুতদারির সুযোগ নেই। দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা হলো। মদ্যপান নিষিদ্ধ হলো। রাজকীয় কর্তাদের উপর কঠোর নজরদারি চালু হলো। রাজ্যের বিভিন্ন প্রশাসনিক এলাকা থেকে অফিসারদের কর্মতৎপরতার রিপোর্ট নিয়মিত হাজির হতো। রাজকীয় তথ্যদাতা অফিসারবৃন্দ তাকে সবসময় প্রকৃত পরিস্থিতি অবহিত করতেন। যে অফিসার তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কোন প্রকার অবহেলা করতেন, তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হতো। এমনকি দায়িত্বে অবহেলা করায় একজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার দেহ প্রকাশ্য চত্বরে প্রদর্শন করা হয়।

 

 


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রাইসির মৃত্যুতে ইরানে ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

রাইসির মৃত্যুতে ইরানে ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

বিকাশ-বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এবছরের বই পড়া কর্মসূচির উদ্বোধন বরিশালে

বিকাশ-বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এবছরের বই পড়া কর্মসূচির উদ্বোধন বরিশালে

ইরানের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানি

ইরানের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানি

এয়ারলাইন এবং শিপিং ইন্ডাস্ট্রির সাথে পার্টনারশিপ উদ্‌যাপন করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

এয়ারলাইন এবং শিপিং ইন্ডাস্ট্রির সাথে পার্টনারশিপ উদ্‌যাপন করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

নীতি সহায়তার অভাবে বিকশিত হচ্ছে না কসমেটিকস শিল্প

নীতি সহায়তার অভাবে বিকশিত হচ্ছে না কসমেটিকস শিল্প

রাইসির নিহত হওয়ার খবরে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া

রাইসির নিহত হওয়ার খবরে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ

গণতন্ত্রকামীরা কারাগারে আর ঋণখেলাপী-পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য চরমে: রিজভী

গণতন্ত্রকামীরা কারাগারে আর ঋণখেলাপী-পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য চরমে: রিজভী

পিকে হালদারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিচ্ছে দুদক

পিকে হালদারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিচ্ছে দুদক

ক্যাপিটাল গেইনে কর আরোপ না করার অনুরোধ ডিএসইর

ক্যাপিটাল গেইনে কর আরোপ না করার অনুরোধ ডিএসইর

৩০ মে ময়মনসিংহ নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডে দোয়া-মাহফিল করবে বিএনপি

৩০ মে ময়মনসিংহ নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডে দোয়া-মাহফিল করবে বিএনপি

অটোরিকশাচালকদের ওপর সরকার স্টিম রোলার চালাচ্ছে: রিজভী

অটোরিকশাচালকদের ওপর সরকার স্টিম রোলার চালাচ্ছে: রিজভী

আঞ্চলিক কেন্দ্রসমূহে আইসিটি ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত

আঞ্চলিক কেন্দ্রসমূহে আইসিটি ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত

বিএনপি নেতা ইশরাকের মুক্তির দাবিতে নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ

বিএনপি নেতা ইশরাকের মুক্তির দাবিতে নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ

যশোরে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ভ্যান চালক নিহত

যশোরে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ভ্যান চালক নিহত

ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বাংলাদেশের জনগণও শোকাহত বিভিন্ন ইসলামী দলের গভীর শোক

ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বাংলাদেশের জনগণও শোকাহত বিভিন্ন ইসলামী দলের গভীর শোক

আগাম নির্বাচনের আগে রাইসি’র স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন মোহাম্মদ মোখবার

আগাম নির্বাচনের আগে রাইসি’র স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন মোহাম্মদ মোখবার

‘অপো এ৬০ লাখ টাকা ক্যাম্পেইন’ বিজয়ীর নাম ঘোষণা

‘অপো এ৬০ লাখ টাকা ক্যাম্পেইন’ বিজয়ীর নাম ঘোষণা

রাইসি’র মৃত্যুতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ‘গভীর শোকাহত’

রাইসি’র মৃত্যুতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ‘গভীর শোকাহত’

তাপপ্রবাহ চলাকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মাউশি’র ৯ নির্দেশনা

তাপপ্রবাহ চলাকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মাউশি’র ৯ নির্দেশনা