ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-২

Daily Inqilab ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

সেমায় (আধ্যাত্মিক গীতি) নিমগ্ন হয়ে তিনি চিশতিয়া তরিকার ঐতিহ্যকে আরো সমৃদ্ধ করেন খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.। ২৭ নভেম্বর ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি শায়খ আলী সানজারীর খানাকায় একটি সেমা মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে কবি আহমদ-এ-জাম নিম্নোক্ত পঙক্তিটি গেয়ে শুনান:
‘কুশতাগানে খঞ্জর তাসলিম রা
হার যমাঁ আয গায়েব জানে দিগর আস্ত’
অর্থাৎ ‘যারা আত্মসমর্পণের খঞ্জরে নিহত হয়েছে,
অদৃশ্য থেকে তাঁরা প্রতিনিয়ত নবজীবন প্রাপ্ত হয়।’
খাজা বখতিয়ার কাকী এই আধ্যাত্মিক পঙক্তি দ্বারা এতটাই পরমানন্দ লাভ করেন যে, তিনি তৎক্ষণাৎ সংবিৎ হারিয়ে ফেলেন। ওই আধ্যাত্মিক পরমানন্দের মাঝেই পাঁচদিন পর ৫০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। খাজা মইনউদ্দীন চিশতি রহ.-এর ইন্তেকালের পর ৬ বছর তিনি জীবিত ছিলেন। (সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, তারিখে দাওয়াত ওয়া আযীমত, ৩খ-, করাচী, ১৯৮৩, পৃ.৩৬)।

খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-এর পাপমুক্ত জীবনের একটি উপাখ্যান পুরো ভারতবর্ষে লোকমুখে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এর তথ্যসূত্র উদ্ঘাটন করা যায়নি। খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী মৃত্যুর আগে তার সন্তান ও খলিফাদের ওসিয়ত করেন যে, আমার মৃত্যুর পর জানাযা যে ব্যক্তি পড়াবেন; তার মধ্যে ৪টি গুণ থাকতে হবে। খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. এর শর্তগুলো হলো: যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন তাকবিরে উলা ব্যতীত নামাজ পড়েনি; এমন ব্যক্তি। যার জীবনে একদিনও তাহাজ্জুদ কাজা হয়নি; এমন ব্যক্তি। যে ব্যক্তি তার চোখের দ্বারা পরনারী দেখে কখনো গোনাহের কল্পনা করেনি। যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন আছরের সুন্নাতও কাজা করেনি। খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. মৃত্যুবরণ করলেন। মৃত্যুবরণের পর তাকে জানাযার জন্য প্রস্তুত করে মাঠে নেয়া হলো। সেখানে উল্লিখিত ৪টি শর্ত উল্লেখ করে ঘোষণা করা হলো- যিনি বা যারা এ গুণগুলোর অধিকারী; তিনি খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. এর জানাযা পড়ানোর জন্য সামনে আসুন। মাঠ ভর্তি মানুষ। কোনো সাড়া শব্দ নেই। এতো অনেক বড় গুণের কথা। এ গুণ অর্জন করা সহজ ব্যাপার নয়। সারা মাঠের লোকগুলো মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো। নিজেদের অপরাধী মনে করে নিরবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। মাঠ থেকে কোনো প্রতি উত্তর না আসায় খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-এর ছেলে, খলিফা, ছাত্রসহ শুভাকাক্সক্ষীরা চিন্তায় পড়ে গেলেন। সন্তান ও খলিফারা লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এমন সময় সামনের কাতার থেকে একজন লোক কদম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘থামো!’ কফিনে হাত লাগিয়ে বললেন, ‘আমি জানাযা পড়াব। এ ব্যক্তি আলেম নন, তবে সাধারণ মানুষও নন; তিনি হলেন দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ। দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ কফিনের সামনে গিয়ে কাফন সরিয়ে খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-এর কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘ওগো আল্লাহর ওলি! সারা জীবন নিজে আমল করে করে; তোমার আমল গোপন করে তুমি চলে গেলে; আর আজকের এ ময়দানে আমার আমলগুলোকে প্রকাশ করে দিলে। আমি ভয় করি; আমার আমলগুলো প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় না জানি আমি ধ্বংস হয়ে যাই।’ এরপর দিল্লীতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

১১৯৩ সালে সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবেক পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে দিল্লী অধিকার করার অব্যাবহতি পর একটি মিনার নির্মাণ কাজে হাত দেন। বিখ্যাত সুফি-দরবেশ হযরত কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-এর নামে এ মিনারের নামকরণ করা হয়। ২৩৮ ফুট উঁচু এ মিনারের শীর্ষদেশ হতে মুয়াজ্জিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য আযান দিতেন। সুলতান ইলতুৎমিশ ১২২৫ সালে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বের আঙ্গিনার সাথে এ মিনারটিকে সংযুক্ত করে দেন। কুতুব মিনারের বহিরাবরণের ওপর পবিত্র কুরআনের আয়াত উৎকীর্ণ রয়েছে। মিনারটি ১১৯৯-১২২০ সালের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল। ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পাওয়া কুতুব মিনার কেবল ভারতীয় উপমহাদেশেরই নয়, দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপনা হিসেবে গণ্য। কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু করেন দিল্লীর শাসক কুতুবউদ্দীন আইবেক। কিন্তু তার আমলে কেবল এর নিচতলাটিই নির্মিত হয়। তার উত্তরাধিকারী ইলতুৎমিশ আরো কয়েক তলা নির্মাণ করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক তৈরি করেন এর পঞ্চম ও সর্বশেষ তলাটি। কুতুবউদ্দীন আইবেক থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলক পর্যন্ত এর স্থাপত্য রীতিতে ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যের যথাযথ ছাপ অঙ্কিত হয়েছে। তাছাড়া এর নির্মাণপদ্ধতি ও নির্মাণকর্মে ব্যবহৃত মাল-মসলাও ভিন্নতর। মধ্য এশিয়া থেকে আগত ক্যালিওগ্রাফারদের হাতে তৈরি হওয়া সর্পিল বক্ররেখা ও পরিশীলিত জ্যামিতিক নিদর্শন কুতুব মিনারকে অনন্য করে তোলে। ১৩৬৮ সালে বজ্রাঘাতে কুতুব মিনারটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফিরোজ শাহ তুঘলক মিনারের পঞ্চম তলাটি মেরামত করেন, কিন্তু এরপরেও মিনারটির অবকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে ৫তলা বিশিষ্ট কুতুব মিনারের দরজা পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তার কারণে। মিনার গাত্রে বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। কুতুব মিনার ভারতের স্থাপত্যিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে।

কুতুবুল আকতাব হযরত খাজা সাইয়েদ মুহম্মদ কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য আল্লাহ তায়ালার অশেষ নিয়ামত। তাঁর মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের জীবনে পরিশুদ্ধি আসে। বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ ভারতে সম্প্রীতি ও সহবস্থানের বাতাবরণ তৈরি করতে চিশতি তরিকার মাধ্যমে তাঁর অবদান ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেনা অভিযানে চুরি ওষুধসহ আটক-২

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেনা অভিযানে চুরি ওষুধসহ আটক-২

বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে আমেরিকা শৈলকুপায় সৈয়দ রেজাউল করিম

বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে আমেরিকা শৈলকুপায় সৈয়দ রেজাউল করিম

সেনবাগে যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শাশুড়ী আটক !

সেনবাগে যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শাশুড়ী আটক !

কেশবপুরে গাঁজা সেবনকালে সমন্বয়কসহ ৪ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

কেশবপুরে গাঁজা সেবনকালে সমন্বয়কসহ ৪ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

তৃণমূল বিএনপির মূল শক্তি - আবুল হোসেন আজাদ

তৃণমূল বিএনপির মূল শক্তি - আবুল হোসেন আজাদ

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে ডিএমপির নির্দেশনা

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে ডিএমপির নির্দেশনা

বিবাহ নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

বিবাহ নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

ফরিদপুরে জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি পরিচয়ে আ.লীগকে পুর্নবাসনের অভিযোগ

ফরিদপুরে জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি পরিচয়ে আ.লীগকে পুর্নবাসনের অভিযোগ

কালিয়াকৈরে পেপসি কারখানায় হামলা, ভাংচুরের চেষ্টা

কালিয়াকৈরে পেপসি কারখানায় হামলা, ভাংচুরের চেষ্টা

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপি নেতা হাজী ইদ্রিস গ্রেফতার

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপি নেতা হাজী ইদ্রিস গ্রেফতার

ইবির আরবী বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বিদায় ও সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর

ইবির আরবী বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বিদায় ও সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর

নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে: টিপু

নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে: টিপু

মাশহাদে ১৮তম আন্তর্জাতিক পর্যটন ও হস্তশিল্প মেলা

মাশহাদে ১৮তম আন্তর্জাতিক পর্যটন ও হস্তশিল্প মেলা

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

নতুন পারমাণবিক সাফল্য উন্মোচন করলো ইরান

নতুন পারমাণবিক সাফল্য উন্মোচন করলো ইরান

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শরণখোলায় বিএনপির প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শরণখোলায় বিএনপির প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

তুর্কি অ্যারোস্পেসের সিইও’র সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক

তুর্কি অ্যারোস্পেসের সিইও’র সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক

বিচারক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে আইন মন্ত্রণালয়: আইন উপদেষ্টা

বিচারক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে আইন মন্ত্রণালয়: আইন উপদেষ্টা