আলাউদ্দীন খিলজি : যুগনায়ক-৩

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০২ এএম

মোঙ্গলরা নিষ্ঠুর। তাদের বর্বরতা সীমা মানে না। উপর্যুপরি আক্রমণে তারা সীমান্ত অঞ্চলের জনজীবনকে করে তুলেছে অতিষ্ট। তারা কাশ্মীর দখল করে ১২৩৫ সালে। সেখানে শাসন-শোষণ করে দীর্ঘদিন। মোঙ্গলরাজ্য চাঘাতাই খানাত লুণ্ঠনের অভিযান বহুবার চালিয়েছে ভারতীয় সীমান্তে; ১২৪১ থেকে ১২৯০ অবধি এই লুণ্ঠনাভিযান চলে। ১২৯০-এর পরে তারা জোরালোভাবে চাইলো ভারত দখল করবে। দিল্লী পদানত করার চেষ্টা চালালো বার বার। সৈন্যাভিযান করলো একে একে ছয় বার। তাদের তুফানের বিপরীতে ভারতের স্বাধীনতা ও জনজীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত হয় আলাউদ্দীন খিলজির বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধে। খিলজি তাদের সামনে রুখে না দাঁড়ালে মধ্যএশিয়ার মতো ধ্বংসের কালি দিয়ে রচিত হতো ভারতের তখনকার ইতিহাস! চাঘাতাই খানাতের শাসক দুয়া ভারত আক্রমণের জন্য ১২৯৭ সালের শীতকালকে বেছে নিলেন। ১ লাখ সৈন্যের বিরাট বাহিনী ধেয়ে এলো। পাঞ্জাব সীমান্ত দিয়ে তারা দিল্লী সালতানাতের ভেতরে প্রবেশ করলো। গ্রাম-জনপদ উজাড় করে আগুনের ভাষায় নিজেদের নির্মমতার গল্প লিখতে থাকলো। কাসুর শহরটি দখল করলো। লুটতরাজ শেষে জ্বালিয়ে দিলো পুরো শহর, বাসিন্দাসমেত।

খবর পেয়েই আলাউদ্দীন প্রতিরোধের জন্য দৃঢ় সংকল্প হলেন। তীরতীব্র গতিতে দিল্লীর বাহিনী এগিয়ে চললো পাঞ্জাবের দিকে। নেতৃত্বে ছিলেন সুলতানের ভাই উলুঘ খান আর প্রখর সেনাপতি জাফর খান। মোঙ্গলরা এত দ্রুত দিল্লীর বাহিনীকে আশা করেনি। তাদের গতিকে ধীর করার জন্য মোঙ্গলরা পথের সাতলুজ বা শতদ্রু নদীর পারাপার ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিল। উদ্যমী বাহিনী সাঁতরে পাড়ি দিল খরস্রোতা বিশাল এই নদী। তারপর উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলো জারান মাঞ্জুর প্রান্তরে। ১২৯৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ যুদ্ধ হলো। নিহত হলো প্রায় বিশ হাজার মোঙ্গল, বন্দি হলো আরো বিশ হাজার। বাকিরা পলায়ন করলো প্রাণ হাতে নিয়ে। যুদ্ধবন্দি মোঙ্গলদের মৃত্যুদ- দিলেন খিলজি। তার প্রতিপত্তি নতুন উচ্চতা স্পর্শ করলো।

১২৯৮ এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে মোঙ্গলদের হাতে আক্রান্ত হলো সিন্ধু সীমান্ত। ছোট্ট শহর সেহওয়ানে ছিলো এক দুর্গ, যাকে বলা হতো কেল্লায়ে শিবিস্তান। আফগানিস্তান থেকে নেগুদেরি গোত্রের মোঙ্গলরা হানা দিলো সেখানে। গোত্রপতি সালদি বা সোগেতেই ছিলো তাদের সেনানায়ক। এলাকাটি দখল করলো এবং নিপীড়ন চালালো তারা। জাফর খানের নেতৃত্বে পাল্টা আক্রমণ করলো দিল্লীর বাহিনী। বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হলেও জয়ী হলো দিল্লী বাহিনী। বন্দি হলো মোঙ্গল সেনাপতি।

আলাউদ্দীন বন্দি মোঙ্গলদের সুযোগ দিতেন আনুগত্যের। যারা ইসলাম গ্রহণ করতো, তাদের স্থান দিতেন সেনাবাহিনীতে। মোঙ্গলরা এই সুযোগ গ্রহণ করতো। এতে সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যা বেড়ে চললো। ১২৯৯ সালে গুজরাট অভিযানে মোঙ্গল সৈন্যরা সীমালঙ্ঘন করে। তারা লুণ্ঠন ও অন্যায় হত্যায় জড়িয়ে পড়ে। এমনকি যুদ্ধলব্ধ মালের এক পঞ্চমাংশ রাজকোষে জমা না দেবার চেষ্টা করে। তারা পড়ে শাস্তির কবলে। ফলে দিল্লীবাহিনীতে হাজার হাজার মোঙ্গল সৈন্য বিদ্রোহ করে। আলাউদ্দীনের এক ভাগ্নেকে হত্যা করে। উলুঘ খানকে আক্রমণ করে। কিন্তু শেষ অবধি বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। পরাজিত মোঙ্গল সেনাপতি মুহাম্মদ শাহ ও কাবরু রণথম্বোরের বাহিনীতে যোগ দেন। রাজা হাম্মির দেবের এই বাহিনী দিল্লীর সালতানাতের জন্য ছিলো হুমকি স্বরূপ। বিদ্রোহের প্রধান দুই সংগঠক ছিলেন ইয়ালহাক ও বুররাক। পালিয়ে গিয়ে তারা যোগ দেন গুজরাটের রাজা কর্ণের বাহিনীতে।

এদিকে চাঘাতাই খানাত প্রস্তুতি নিচ্ছিলো প্রবল আক্রমণের। এবার প্রায় দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে তারা যাত্রা করলো। সময়টা ১২৯৯ সালে মাঝামাঝি। বাহিনীর নেতৃত্বে তরুণ, দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা কুৎলুঘ খাজা। বাহিনীতে ছিলো পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য ও রসদপত্র। স্থানীয়দের পাশে রাখার জন্য এবার তারা গণহত্যা ও দস্যুতা থেকে বিরত থাকলো। মোঙ্গলরা দ্রুত এগুতে থাকলো দিল্লীর দিকে। মুলতান ও সামানে সৈন্যরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও মোঙ্গলরা থামেনি। পাঞ্জাবের ঘুরাম থেকে সেনাপতি জাফর খান কুৎলুঘকে সম্মুখযুদ্ধের চ্যালেঞ্চ করলে সে তা প্রত্যাখ্যান করলো। কোথাও কোনোভাবেই শক্তিক্ষয় করতে চাইলো না তারা। অবশেষে বাহিনীটি দিল্লীর উপকণ্ঠে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরত্বে পৌঁছে গেলো।

চারদিক থেকে লোকেরা ভয়ে ও আতঙ্কে দিল্লীতে ভিড় করলো। জনভোগান্তি চরমে উপনীত হলো। আলাউদ্দীন সিদ্ধান্ত নিলেন মুখোমুখি লড়বেন। যদিও তার উপদেষ্টারা সন্ধির পরামর্শ দিয়েছিলেন। আলাউদ্দীন খিলজি ছিলেন কৌশলী। যুদ্ধের প্রস্তুতি গুছাবার জন্য সময়ক্ষেপণ করছিলেন। এরই মধ্যে জাফর খানের আক্রমণে মোঙ্গলরা জোর ধাক্কা খায়। যদিও এ জন্য জাফরকে শহীদ হতে হয়। তার পুত্র দিলির খানের আরেক হামলা মোঙ্গলদের পেছন থেকে বিধ্বস্ত করে। তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সামন থেকে মোঙ্গলরা হামলা করে আলাউদ্দীনের বাহিনীকে। কিন্তু পাল্টা আঘাতে পিছু হটে। সেনাপতি কুৎলুঘ আহত হন। জাফর খানের নিহত হওয়া ছিলো গুরুতর ক্ষতি। উপদেষ্টারা বিজয়ের আশা করতে পারছিলেন না। কিন্তু আলাউদ্দীন যুদ্ধজয়ের প্রত্যয়ে ছিলেন সুদৃঢ়। মোঙ্গল সেনাপতির আঘাত গুরুতর রূপ নিলো। দুই দিন পরে বাহিনী নিয়ে তিনি পিছু হটলেন। দিল্লী সুরক্ষিত হলো। ধ্বংসযজ্ঞের কবল থেকে রক্ষা পেলো ভারত।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেনা অভিযানে চুরি ওষুধসহ আটক-২

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেনা অভিযানে চুরি ওষুধসহ আটক-২

বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে আমেরিকা শৈলকুপায় সৈয়দ রেজাউল করিম

বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে আমেরিকা শৈলকুপায় সৈয়দ রেজাউল করিম

সেনবাগে যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শাশুড়ী আটক !

সেনবাগে যৌতুকের দাবীতে গৃহবধূ হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শাশুড়ী আটক !

কেশবপুরে গাঁজা সেবনকালে সমন্বয়কসহ ৪ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

কেশবপুরে গাঁজা সেবনকালে সমন্বয়কসহ ৪ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

তৃণমূল বিএনপির মূল শক্তি - আবুল হোসেন আজাদ

তৃণমূল বিএনপির মূল শক্তি - আবুল হোসেন আজাদ

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে ডিএমপির নির্দেশনা

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে ডিএমপির নির্দেশনা

বিবাহ নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

বিবাহ নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

ফরিদপুরে জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি পরিচয়ে আ.লীগকে পুর্নবাসনের অভিযোগ

ফরিদপুরে জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি পরিচয়ে আ.লীগকে পুর্নবাসনের অভিযোগ

কালিয়াকৈরে পেপসি কারখানায় হামলা, ভাংচুরের চেষ্টা

কালিয়াকৈরে পেপসি কারখানায় হামলা, ভাংচুরের চেষ্টা

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপি নেতা হাজী ইদ্রিস গ্রেফতার

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপি নেতা হাজী ইদ্রিস গ্রেফতার

ইবির আরবী বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বিদায় ও সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর

ইবির আরবী বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বিদায় ও সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর

নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে: টিপু

নির্যাতিত নেতাকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে: টিপু

মাশহাদে ১৮তম আন্তর্জাতিক পর্যটন ও হস্তশিল্প মেলা

মাশহাদে ১৮তম আন্তর্জাতিক পর্যটন ও হস্তশিল্প মেলা

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

নতুন পারমাণবিক সাফল্য উন্মোচন করলো ইরান

নতুন পারমাণবিক সাফল্য উন্মোচন করলো ইরান

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শরণখোলায় বিএনপির প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে শরণখোলায় বিএনপির প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত

তুর্কি অ্যারোস্পেসের সিইও’র সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক

তুর্কি অ্যারোস্পেসের সিইও’র সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক

বিচারক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে আইন মন্ত্রণালয়: আইন উপদেষ্টা

বিচারক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে আইন মন্ত্রণালয়: আইন উপদেষ্টা