মুহম্মদ বিন তুঘলক : কালের চেয়ে অগ্রসর-৬

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম

সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক সাধারণ সুলতান ছিলেন না। শুধুমাত্র সিংহাসনে বসে রাজ্য শাসন করা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। তিনি তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা নিয়ে রাজতন্ত্রকে গঠনের চেষ্টা করেন। জ্ঞান বুদ্ধি, মানসিক উৎকর্ষ, আদর্শ ও প্রতিভার দিক দিয়ে আপন কালে শুধু ভারতে নয়, বরং তিন মহাদেশে ছিলো তার খ্যাতি। তিনি তাঁর শাসনকালের গোড়ার দিকে খলিফার প্রতি আনুগত্য দেখাননি। কর্মচারী নিয়োগের প্রধান শর্ত ছিল যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন। বংশ-কৌলিন্যের পরিবর্তে তিনি বুদ্ধি-কৌলিন্য যোগ্যতাকেই গুরুত্ব দেন। ধর্মান্তরিত মুসলিম এবং হিন্দু ধর্মীয় পরিবার থেকে তিনি যোগ্য মানুষদের বাছাই করে উচ্চপদে নিযুক্ত করতেন। ইবনে বতুতার মতে, সুলতান ঘোড়ার ডাক এবং ডাক হরকরা নামক দুটি ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। ঘোড়ার ডাকের জন্য প্রতি চার মাইল এবং ডাক হরকরার জন্য প্রতি মাইলে তিনটি ডাকঘর ছিলো। ডাক হরকরার সাথে ঘণ্টা থাকত এবং ঘণ্টা ধ্বনি দিয়েই তারা তাদের আগমনবার্তা প্রকাশ করত। এই ব্যবস্থা নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রচলিত ছিলো বিগত শতকের নব্বই দশক অবধি। কৃষক ও কৃষির উন্নতির জন্য তিনি আমিরে কোহীর তত্ত্বাবধানে ‘দিওয়ানে কোহী’ নামক একটি স্বতন্ত্র কৃষি বিভাগ চালু করেন। এ বিভাগ কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণে বহুমুখী প্রকল্প পরিচালনা করতো। পতিত ও অনাবাদী জমি চাষের অধীনে আনার জন্য কৃষকদের উৎসাহ প্রদান করত। তার শাসনামলে এমনতরো কল্যাণী প্রয়াসের নজির অনেক, যা প্রমাণ করে তাঁর প্রাজ্ঞতা, দক্ষতা, প্রজাকল্যাণ ও অগ্রসর চিন্তা-চেতনা।
সুলতানের শেষ জীবন কেটেছে যুদ্ধ ও বিদ্রোহ দমনের ব্যস্ততায়। বিদ্রোহী শক্তি মাথা তোলে দিকে দিকে। বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে নানা অঞ্চল। একের পর এক নৈরাজ্য গর্জন করতে থাকে কাছে ও দূরে। স্বাধীন বিজয়নগর, বাংলা ও বাহমনী রাজ্যের জন্ম হয়। তুঘলকের চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়তে থাকে সাম্রাজ্য। এই ভাঙ্গন রোধে তিনি অভিযানের পর অভিযান পরিচালনা করেন। উল্কার মতো এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে ছুটে বেড়াতে থাকেন। শেষ অবধি ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুর থাট্টায় সুমরু গোষ্ঠীর বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত সুলতান মৃত্যুর কবলে ঢেলে পড়েন।
বারানি এই মৃত্যুকে যেন উদযাপন করেছেন। তার ভাষায়, ‘মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তুঘলক তার অবাধ্য প্রজাকুলের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলেন; প্রজাকুলও তুঘলকের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বাঁচলো।’ তুঘলকের প্রতি নির্মম হয়েও বারানি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘তুঘলক ছিলেন সৃষ্টির এক অপূর্ব বিস্ময় এবং তার কর্মদক্ষতা প্লেটো ও এরিস্টটলের ন্যায় জ্ঞানীদেরকেও বিস্ময়াভিভূত করতে পারত।’ ড. ঈশ্বরী প্রসাদের মতে, ‘নিঃসন্দেহে মুহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় শাসক।’
ন্যায়বিচারে তিনি ছিলেন অনন্য। ইবনে বতুতা তার নামে বহু গালগল্প প্রচার করলেও এ সত্য স্বীকার করেন যে, ‘সকল মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাধিক ন্যায়বিচারপ্রিয়। অপরাধীদের তিনি কঠোর দ- দিতেন। অমুসলিম প্রজাদের প্রতিও তিনি ইনসাফ করতেন।’ (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা

সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা

চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত

চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত

দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী

দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব

রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব

রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি

রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি

আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?

আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?

রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা

রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা

লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই

লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ

নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা

রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ

রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন

রাইসিকে সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল

রাইসিকে সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল

ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার

ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার

প্রথম ভারতীয় হিসাবে ‘গ্লোবাল ডিসরাপ্টর্স’ তালিকায় দীপিকা

প্রথম ভারতীয় হিসাবে ‘গ্লোবাল ডিসরাপ্টর্স’ তালিকায় দীপিকা

মাগুরায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রকৌশলী তাপস নিহত

মাগুরায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রকৌশলী তাপস নিহত