ফিরোজ শাহ তুঘলক : সুলতানী যুগের দ্য গ্রেট-৪

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

তিনি বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য অগ্রসর ও সক্ষম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দিল্লীতে একটি ‘কর্মসংস্থান সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিলো শক্তিমান একটি ইন্সস্টিটিউট। কর্মসক্ষম প্রজাদের তথ্য সংগ্রহ, বেকারদের রেকর্ড সংরক্ষণ, বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও কর্মসৃষ্টিতে নিয়োজিত ছিলো এই প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে সাম্রাজ্যব্যাপী বেকার ও যোগ্য ব্যক্তিদের চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
দরিদ্রদের চিকিৎসার জন্য ‘দার-উশ শিফা’ নামে দাতব্য চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা হয়। এখানে দক্ষ ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দরিদ্র রোগীদের রাষ্ট্রীয় খরচে ঔষধ দেয়া হতো।
দরিদ্র বিধবা নারী এবং বিবাহযোগ্য কন্যাদের বিয়ের জন্য অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করেন তিনি। এজন্য চালু করা হয় ‘দেওয়ান-ই-খায়রাত’ নামে স্বতন্ত্র এক দাতব্য বিভাগ।
যোগ্য ব্যক্তিদের আত্মপ্রতিষ্ঠায় সহায়তার জন্য চালু করা হয় বিশেষ প্রকল্প। তাদের অর্থ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এজন্য কাজ করতো দেওয়ান-ই-ইস্তিহাক।
ফিরোজ শাহ একজন বড় নির্মাতা ছিলেন। তিনি অনেকগুলো শহর ও মসজিদ নির্মাণ করেন। দিল্লীর কাছে একটি নতুন শহর নির্মাণ করে সুলতান এর নাম দেন ‘ফিরোজাবাদ’। এছাড়া তিনি ফতেহাবাদ, জৌনপুর, ফিরোজপুর প্রভৃতি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এসব শহরে তিনি অসংখ্য প্রাসাদ, মসজিদ, সরাইখানা, পুকুর, বাগান, সমাধিসৌধ, পুল ইত্যাদি নির্মাণ করেন। ৩০টি রাজপ্রাসাদ, ২০০ পান্থ’শালা, ৫টি হাসপাতাল, ১০০টি সেতু নির্মাণ করেন তিনি। দিল্লীল উপকণ্ঠে তিনি ১২০০ বাগান নির্মাণ করেছিলেন। তার আমলেই দিল্লীর আশেপাশে প্রায় ৩০০ গ্রামের গোড়াপত্তন হয়। শহর থেকে শহরে অনেকগুলো রাজপথও তৈরি করা হয়। সেগুলোতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য নিরাপত্তা ও সেনাচৌকি স্থাপন করা হয় নির্দিষ্ট দূরত্বে। ‘দিওয়ান-ই-বন্দেগান’ নামে একটি বিভাগ চালু করা হয়, যা দাসদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় কাজে তাদের অংশগ্রহণের তদারকি করতো। রাষ্ট্রীয় কাজে তখন প্রায় ১,৮০,০০০ ক্রীতদাস নিয়োজিত ছিল। তাদের সুষ্ঠুভাবে ভরণ-পোষণ করা হতো। তিনি তার রাজ্যে পিতার বদলে পুত্র প্রথা চালু করেন। সেনাবাহিনী কিংবা রাজকীয় প্রশাসনে পিতার অনুপস্থিতিতে পুত্রকে দায়িত্ব দেওয়া হতো। এজন্য পুত্রকে দক্ষতা নিশ্চিত করতে হতো। তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি করেন এবং হাত কেটে ফেলা, গর্দান নেওয়াসহ সমস্ত প্রকার কঠোর শাস্তি বন্ধ করেন।
ফিরোজ শাহ বিদ্যোৎসাহী সুলতান ছিলেন। জনগণের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় মানের তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ফিরোজশাহ। তার তৈরি বৃহৎ শিক্ষাগারের সংখ্যা ছিলো ত্রিশ। শিক্ষার্থীদের অনুদান ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পন্ডিত আনার ব্যবস্থা করেন তিনি। তাঁর দরবারে জ্ঞানী-গুণীর সমাদর ছিল। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানী ও শামস-ই-সিরাজ আফিফ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের গ্রন্থগুলো রচনা করেন। সুলতান নিজেও একজন ভালো লেখক ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘ফতুহা-ই-ফিরোজশাহী’ সুধীজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতানের মৃত্যু হয়।
মায়ের দিক থেকে হিন্দু রাজরক্তধারা বহন করছিলেন ফিরোজ শাহ। তার মা ছিলেন দীপালপুরের একজন হিন্দু রাজকন্যা এবং পিতার নাম ছিলো রজব, যিনি ছিলেন গিয়াসউদ্দিন তুগলকের ছোট ভাই ও দীপালপুরের সিপাহসাহলার। ফিরোজ শাহের বেড়ে উঠার পথ তৈরি হয় বিজ্ঞ আলেম ও সুফিদের পরিচর্যায়। বহুমুখী দক্ষতাকে আত্মীকরণ করে শাসনকর্মে তিনি গভীরতা ও প্রশস্ততা নিশ্চিত করেন। ঐতিহাসিকদের কলম তাকে মহিমান্বিত করেছে। তার সময়ের জিয়াউদ্দীন বারানী বা আফিফ থেকে নিয়ে আধুনিক ইতিহাসবিদ ইলিয়ট, এলফিনস্টোন, মোরল্যান্ড কিংবা শ্রীবাস্তবও ফিরোজ শাহের দক্ষতা, প্রজাকল্যাণ ও সুশাসনের সত্যকে উচ্চারণ করেছেন, যার যার ভাষা ও ভাষ্যে। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইরানকে সাহায্যের জন্য রাশিয়া সবকিছু করতে প্রস্তুত রয়েছে: পুতিন

ইরানকে সাহায্যের জন্য রাশিয়া সবকিছু করতে প্রস্তুত রয়েছে: পুতিন

গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু ২ বাইক আরোহীর, রচনা লেখার শর্তে জামিন চালককে

গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু ২ বাইক আরোহীর, রচনা লেখার শর্তে জামিন চালককে

হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ, সম্পাদক পদে বসতে পারবেন না ডিপজল

হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ, সম্পাদক পদে বসতে পারবেন না ডিপজল

রাত পোহালে কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছানে হলো নির্বাচনী সরঞ্জাম

রাত পোহালে কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছানে হলো নির্বাচনী সরঞ্জাম

মিরপুরে অটোরিকশা চালকদের বিরুদ্ধে ৪ মামলা

মিরপুরে অটোরিকশা চালকদের বিরুদ্ধে ৪ মামলা

মৃত্যু যখন দোরগোড়ায়… রাইসির শেষ ভিডিও প্রকাশ করল ইরান

মৃত্যু যখন দোরগোড়ায়… রাইসির শেষ ভিডিও প্রকাশ করল ইরান

চোর সন্দেহে ঝালকাঠিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

চোর সন্দেহে ঝালকাঠিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট কে এই মোহাম্মদ মোখবার?

ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট কে এই মোহাম্মদ মোখবার?

বিলাস বহুল পাজেরো স্পোর্ট কারে মিলল ৭লাখ ইয়াবা,চার মাদক কারবারি আটক

বিলাস বহুল পাজেরো স্পোর্ট কারে মিলল ৭লাখ ইয়াবা,চার মাদক কারবারি আটক

রাইসির মৃত্যুতে 'ইসরাইল জড়িত নয়', দাবি এক কর্মকর্তার

রাইসির মৃত্যুতে 'ইসরাইল জড়িত নয়', দাবি এক কর্মকর্তার

আজ মৌমাছি দিবস, এর যে সাতটি বৈশিষ্ট্য খুবই চমকপ্রদ

আজ মৌমাছি দিবস, এর যে সাতটি বৈশিষ্ট্য খুবই চমকপ্রদ

লৌহজংয়ে রাত পোহালে ভোট, ৬১ কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭টা ঝুঁকিপূর্ণ

লৌহজংয়ে রাত পোহালে ভোট, ৬১ কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭টা ঝুঁকিপূর্ণ

দোয়ারাবাাজরে বজ্রপাতে নিহত ২

দোয়ারাবাাজরে বজ্রপাতে নিহত ২

বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সিরিজে আইপিএল নিয়ে ব্যস্ত উইন্ডিজ ক্রিকেটাররা

বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সিরিজে আইপিএল নিয়ে ব্যস্ত উইন্ডিজ ক্রিকেটাররা

কোপার ব্রাজিল দল থেকে ছিটকে গেলেন এদেরসন

কোপার ব্রাজিল দল থেকে ছিটকে গেলেন এদেরসন

সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা

সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা

চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত

চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত

দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী

দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা