ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.)-৪

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৩ এএম | আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৩ এএম


ওই সময় তিনি চরম অভাব-অনটনের মধ্যে ছিলেন। তখন তাকে একাধারে তিনদিন পর্যন্ত অভুক্ত থাকতে হয়েছে। সুলতান জালাল উদ্দীন খিলজি তাকে একটি গ্রাম উপহার দিতে চেয়েছিলেন। তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন: আমার ও আমার সঙ্গীদের আপনার দেয়া গ্রাম থেকে সংগ্রহীত আয়ের দরকার নেই। আমার ও তাদের যিনি খোদা, তিনি মহান দাতা এবং তার কাছে প্রভূত জীবনোপকরণ আছে। (সিয়ারুল আওলিয়া)।

এরপর তিনি এত স্বচ্ছলতা অর্জন করেন যে, প্রতিদিন হাজার হাজার লোক তার লঙ্গরখানা থেকে খাবার গ্রহণ করতেন। তবে তখন তিনি লাগাতার রোজা রাখতেন। সেহেরির সময়ও কিছু খেতেন না, এখনো শহরের কিছু লোক না খেয়ে আছে বলে। (ঐ)।

মানুষের প্রতি এমন মমত্ব বিরল। তার হৃদয়ের দুয়ার সবার জন্যই ছিল উন্মুক্ত। দায়গ্রস্ত, সাহায্যপ্রার্থী, বিপদগ্রস্ত মানুষ তার কাছে ছুটে আসতেন। কেউ অর্থের জন্য, কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেন না সে জন্য, কেউ সুলতানের রোষের কবল থেকে উদ্ধারের জন্য, কেউ বা মানসিক অস্থিরতা নিরসনের জন্য তার কাছে আসতেন। তিনি সবার কথা শুনতেন, সবাইকে সাহস, সান্ত¦না ও পরামর্শ দিতেন। এরপর তিনি আল্লাহর দরবারে তাদের সমস্যা সমাধানে দোয়া-মোনাজাত করতেন।

হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার পীর ও মুর্শিদ হযরত খাজা ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর তার জন্য দোয়া করে বলেছিলেন, তিনি যেন এমন মহীরুহ হন, যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ স্বস্তি ও শান্তি খুঁজে পাবে। তার এ নেক দোয়া কবুল হয়েছিল। হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া অর্ধশতাব্দিকাল মানবসেবায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। অন্ন দানের মতো আর কোনো পুণ্য নেই। তার লঙ্গরখানা কখনো বন্ধ হয়নি।

ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, এক শ্রেণীর সুলতান, স¤্রাট বা শাসক সুফী-দরবেশদের জনপ্রিয়তায় ভীত ও উৎকণ্ঠিত হয়েছেন। তাদের অসম্মান করেছেন, অত্যাচার করেছেন, কষ্ট দিয়েছেন। হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়াও সুলতান কুতুবউদ্দীন মুবারক শাহর রোষানলে পড়েন। ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরী প্রসাদ সুলতান মুবারক শাহ সম্পর্কে বলেছেন: ‘সৌভাগ্য মুবারককে অকেজো করে দেয়। তিনি অহংকারী, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অত্যাচারী হয়ে উঠেন। বাড়তি প্রশ্রয় পেয়ে সবচেয়ে খারাপ হয়ে যান। তিনি শালীনতা ও নৈতিকতার প্রতি সকল শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন।’ এমন একজন সুলতানকে হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার পছন্দ করার কোনো কারণ নেই। সুলতানও তাকে অপছন্দ করতেন। বিশেষ করে, তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাবোধ করতেন। রাষ্ট্রক্ষমতা ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রথমে সুলতান হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার খানকা ও লঙ্গরখানায় অর্থ সাহায্য বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন। এতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়ে অন্য পথ ধরেন। এই মর্মে আদেশ জারি করেন যে, হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়াকে প্রতিদিন সুলতানের দরবারে হাজিরা দিতে হবে। হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া ঘৃণাভরে এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর সুলতান আদেশ দেন, প্রতি সপ্তাহে তাকে দরবারে হাজিরা দিতে হবে। তিনি এ আদেশও প্রত্যাখ্যান করেন। শেষে সুলতান এই আদেশ দেন যে, আগামী মাসের প্রথম তারিখে হাজিরা না দিলে তাকে সৈন্য পাঠিয়ে ধরে আনা হবে। স¤্রাটের আমীর-ওমরাহ ও সৈন্যদের অনেকে হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার মুরিদ ছিলেন। তারা তার কাছে এসে বললেন, আমরা সুলতানের আদেশের দাস। যদি সুলতান ওইরূপ আদেশ দেন, তাহলে আমরা কী করবো? আমরা কি আদেশ অমান্য করে জিহাদে শামিল হবো? হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া তাদের শান্ত করে বললেন, তোমাদের কিছুই করতে হবে না। তোমরা সুলতানের আদেশের দাস কিন্তু আমি যার দাস তিনি আমার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

দরবারে হাজির হওয়ার নির্ধারিত দিনের আগের রাতে হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া এই ফারসী কবিতাংশ পাঠ করেন: ‘হে জম্বুক, তুই কোন সাহসে সিংহের সাথে যুদ্ধ করতে আসলি? তোর দুর্দশা হলো।’ অতঃপর ওইদিন প্রত্যুষেই সুলতানের দরবারে পদাঘাত করে আল্লাহতায়ালার দরবারে হাজিরা দিলেন হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া। উল্লেখ করা যেতে পারে, সুলতান মুবারক শাহ সুলতান থাকা অবস্থায় গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

লৌহজংয়ে রাত পোহালে ভোট, ৬১ কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭টা ঝুঁকিপূর্ণ

লৌহজংয়ে রাত পোহালে ভোট, ৬১ কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭টা ঝুঁকিপূর্ণ

দোয়ারাবাাজরে বজ্রপাতে নিহত ২

দোয়ারাবাাজরে বজ্রপাতে নিহত ২

বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সিরিজে আইপিএল নিয়ে ব্যস্ত উইন্ডিজ ক্রিকেটাররা

বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সিরিজে আইপিএল নিয়ে ব্যস্ত উইন্ডিজ ক্রিকেটাররা

কোপার ব্রাজিল দল থেকে ছিটকে গেলেন এদেরসন

কোপার ব্রাজিল দল থেকে ছিটকে গেলেন এদেরসন

সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা

সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা

চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত

চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত

দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী

দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব

রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব

রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি

রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি

আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?

আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?

রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা

রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা

লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই

লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ

নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা

রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ

রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন