ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১০

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৮ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম


প্রত্যেক বিভাগের নির্বাহীদের দেওয়া হতো স্বর্ণের তৈরী বাণ বা পরিচয়পত্র, যারা যে বিভাগের আওতায় থাকতেন, প্রত্যেকের তালিকা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ সংরক্ষণ করা হতো। শ্রেণী বিভাজনের এই খাতে সমস্যা হতো প্রায়ই। অনেকেই একই সাথে আহলে দাওলাহ ও আহলে সায়াদাতে স্থান পেতেন। কারণ, তারা পণ্ডিত হিসেবে যেমন ছিলেন স্বীকৃত ও বরেণ্য, তেমনি ছিলেন সেনা বা প্রশাসনিক কর্তা। বস্তুত এমনতরো শ্রেণী বিন্যাস প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য খুব একটা সহায়ক ছিলো না।

হুমায়ুন চেয়েছিলেন শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণ। দিল্লি, আগ্রা, জৌনপুর, লাহোর, কনৌজ ইত্যাদি স্থানে শাসনকেন্দ্র গড়ার উদ্যোগ নেন তিনি। সেখানে যোগ্য এবং অভিজ্ঞ আমিরদের নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। নিজের কাছে ১২ হাজারের বেশি সৈন্য থাকবে না, এটা ছিলো তার সিদ্ধান্ত। তার সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি সহসা মৃত্যুর ফলে।

তিনি এক চলমান বাজার প্রচলন করেছিলেন, যেটাকে বলা হতো নৌকাবাজার। এই বাজারে থাকতো প্রয়োজনীয় সকল কিছু। তরকারি থেকে নিয়ে যুদ্ধের সরঞ্জাম, সবকিছু। ভ্রাম্যমাণ এই বাজার থেকে দূর-দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জের নাগরিকরাও উপকৃত হতেন। একই সাথে তিনি প্রচলন করেন নৌকা উদ্যান, চলমান সেতু, এমনকি চলমান রাজপ্রাসাদও।

ন্যায়বিচার ছিলো হুমায়ুনের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। কোনো বিচারপ্রার্থী যেন ন্যায় থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো সময় যে কোনো বিচারপ্রার্থী হুমায়ুনের দরবারে প্রবেশ করতে পারতো। দরবারের পাশেই ছিলো বড় এক ঢোলক। এর নাম ছিলো তবলায়ে আদালত। ন্যায়বিচারের ঢোলক। নিজের উপর অবিচার হচ্ছে মনে হলে যে কেউই এসে এই তবলা বাজাতে পারতো।

এই তবলা বাজানোর আবার নির্দিষ্ট নিয়ম ছিলো। সাধারণ অভিযোগ হলে তবলা একবার বাজাতে হতো, বেতন না পেলে দুবার, সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ হলে তিনবার আর খুনোখুনির অভিযোগে চারবার তবলা বাজানোর নিয়ম ছিলো। হুমায়ুন দ্রুত বিচারে বিশ্বাসী ছিলেন। কোনো মজলুমের ফরিয়াদ আকাশে পৌঁছার আগেই তার বিচারকে গ্রহণ করতে হবে।

পারস্য থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় হুমায়ুন মীর সৈয়দ আলী এবং খাজা আব্দুস সামাদকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় মুঘল চিত্রকলার শুভ সূচনা হয়েছিল। ইরান থেকে আনা কলাতত্ত্বের সঙ্গে ভারতীয় কলাতত্ত্বের মিশ্রণে মোগল-কলার সৃষ্টি করেছিলেন হুমায়ুন। তার রাজত্বকালে মুঘল স্থাপত্য ও চিত্রকলার উৎকর্ষ সাধিত হয়। ‘হুমায়ুনের মকবরা থেকে মোগল আমলের বাস্তুকলার বাস্তবিক ইতিহাস শুরু হয়। মোগল কলাতত্ত্ব মানেই ইরানীয় প্রভাব। ইরানি প্রভাব থাকলেও তা হয়ে উঠল সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় মোগল কলাতত্ত্বের ইমারত। হুমায়ুনের ইমারত নির্মাণে খুব আগ্রহ ছিল। সময় ও সুযোগ পেলেই তিনি ইমারত নির্মাণের আদেশ দিতেন।’

হিন্দি ঐতিহাসবিদ ডক্টর হরিশঙ্কর শ্রীবাস্তব ছিলেন হুমায়ুন প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ গবেষক। তার অসাধারণ গ্রন্থ ‘মোগল সম্রাট হুমায়ুন’ এর ভূমিকা লিখেন ডক্টর তারাচাঁদ। এতে অল্পকথায় হুমায়ুনকে তিনি চিত্রিত করেছেন এভাবে, ‘হুমায়ুন তৈমুরী বংশের এক বিচিত্র রত্ন ছিলেন। ওই বংশে অদ্ভুত সব বিভূতিরা জন্ম নিয়েছেন, যাঁদের ধারাবাহিকতা তৈমুর থেকে নিয়ে আওরঙ্গজেবÑ দশ-বারো পুরুষ অবধি চলতে থাকে। এমন রাজবংশ জগতে অতি দুর্লভ, যে বংশে এমন ওজস্বী নায়কদের আবির্ভাব ঘটেছে। হুমায়ুন এই সুদীর্ঘ সোনালি শৃঙ্খলে এক অমূল্য সংযোজন ছিলেন। তাঁর চরিত্রে দোষে-গুণের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল, যা তাঁকে একদিকে হিন্দুস্তানের বাদশাহ, অন্যদিকে নির্বাসিত বাদশাহ রূপে ইরানের বাদশাহের অনুগ্রহের পাত্র বানিয়ে দেয়। এক সময় যিনি দিল্লির সম্রাট ছিলেন, যাঁর সামনে রাজা ও নবাবগণ অবনতমস্তক হতেন, আর সেই হুমায়ুন বাদশাহ রাজস্থানের মরুভূমিতে নির্ধন, অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি সকল অবস্থাতেই খুশি ছিলেন, দুঃখ-দুর্দশায় তিনি হতাশ হতেন না, আবার জয়-পরাজয়ে বিহ্বল হতেন না।’ (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা