নববর্ষ ও বাংলা সন
১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১০ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১৭ পিএম

আজ পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষকে আমরা আমাদের হৃদয়ের সকল উষ্ণতা দিয়ে স্বাগত জানাই। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, বাংলাদেশের নববর্ষ পালনের ঐতিহ্য আছে। অনেক জাতির ‘নববর্ষ’ বলে সুনির্দিষ্ট কোনো দিন নেই। তারা নববর্ষ পালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশের বাঙালির নববর্ষ আছে, আছে একটি নিজস্ব সন, বাংলাসন। বাংলাসন মানে বাংলাপঞ্জিকা।
বাংলাসনের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে মুঘল স¤্রাট আকবরের নাম জড়িত। ঐতিহাসিকদের মতে, তৎকালে হিজরিসন প্রচলিত ছিল। কিন্তু হিজরি চান্দ্রসন হওয়ায় ঋতুর সঙ্গে মাসগুলোর স্থিরতা ছিল না। ফলে রাজস্ব আদায়ে কয়েক বছর পর পরই জটিলতা দেখা দিত। তখন ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হতো। ফলে রাজস্ব আদায়ে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করা কঠিন হতো। এই অসুবিধা ও জটিলতা নিরসনের জন্য স¤্রাট আকবর খ্যাতিমান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে দায়িত্ব দেন নতুন সন উদ্ভাবনের জন্য। ফতেহ উল্লাহ সিরাজী প্রচলিত হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে বাংলাসন প্রণয়ন করেন। হিজরি চান্দ্রসন হলেও বাংলাসন গঠিত হয় সৌরসনের আদলে। বাংলাসনের অনুসঙ্গী হয়ে আরো বেশ কিছু সনের উদ্ভব হয়। এগুলো ফসলি সন হিসেবে গণ্য।
স¤্রাট আকবরের নির্দেশে আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী হিজরিসনকে ভিত্তি ধরে সৌরসনের অবয়বে বাংলাসন প্রণয়ন করেন, এটাই ঐতিহাসিকদের সুচিন্তিত অভিমত। বাংলা সনের স্থলে ‘বঙ্গাব্দের’ ব্যবহার দেখে অনেকের ধারণা, বাংলাসনের চেয়ে বঙ্গাব্দ হয়তো আরো প্রাচীন। কেউ কেউ রাজা শশাংককে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক মনে করেন। কারো কারো মতে, বাংলার সুলতানী আমলে বাংলাসনের উদ্ভব হয়। কিন্তু এ সব দাবির সপক্ষে পর্যাপ্ত নথিতথ্য পাওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘এটা পরিষ্কার যে, আকবরের রাজত্বের আগে বাংলাসন ব্যবহারের কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ও আলোচিত তথ্যাদি আকবরের আমলের চান্দ্র-হিজরির অব্দ সংস্কারের মাধ্যমেই বঙ্গাব্দের সূচনা ইঙ্গিত করে।’ পশ্চিমবঙ্গেরই পলাশবরন পাল নামের আরেকজন ইতিহাসবিদ বলেছেন: “কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দটার চল ছিল না, আগে বলা হতো ‘সাল’ বা ‘সন’।... এখানে মনে রাখতে হবে, সাল কথাটা ফারসি, সন শব্দটা আরবি। এ থেকে মনে হয়, হিজরি ক্যালেন্ডার থেকেই কোনোভাবে উদ্ভূত আমাদের ‘বাংলা অব্দ’ বা ‘বাংলা সাল’।”
বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক মুহম্মদ আবূ তালিব বলেছেন: ‘আইন-ই-আকবরী’ থেকে জানা যায়, স¤্রাট আকবর এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌরসনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্যই আদর্শ হবে। বাংলাসনের মাধ্যমে তার সে আকাক্সক্ষা পূরণ হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে। কেননা, বাংলাসন যেমন ‘হিজরিসন’ নয়, তেমনি এটি ‘এলাহীসন’ থেকেও ভিন্ন। হিজরিসনের ওপর ভিত্তি করা হলেও এর গঠন পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের মতো। অথচ, এটি শকাব্দেরও সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকু যে, এর মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে। মুহম্মদ আবূ তালিবের এ অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বোঝা যায়, বাংলাসন একটি আলাদা বা স্বতন্ত্র সন। অভিনব বললেও অত্যুক্তি হবে না।
মানুষ সূর্য ও চন্দ্রের পরিক্রমাকে সামনে রেখে দিন, মাস, বছর ইত্যাদি গণনার রীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: ‘সূর্য, চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে’। আল্লাহপাক দিন ও রাত্রিকে নিদর্শন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এই নিদর্শনের একটি বিশেষ লক্ষ্য হলো, বর্ষ সংখ্যা ও হিসাব স্থির করা। সূর্যের নিজ কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। অন্যদিকে চন্দ্র তার কক্ষপথে ঘুরে আসতে সময় নেয় ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। সূর্য ও চন্দ্রভিত্তিক বর্ষ গণনা কবে কোথায় সূচিত হয়েছিল তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মিসরে প্রথম বর্ষ গণনার রীতি প্রবর্তিত হয়। সেটা প্রায় ৬ হাজার বছর আগে। সম্ভবত শুরুতে এটা ছিল চন্দ্রভিত্তিক গণনা। আবার ওই মিসরেই প্রথম চন্দ্রভিত্তিক গণনার স্থলে সূর্যভিত্তিক গণনার প্রচলন হয়। কৃষি সভ্যতার উৎপত্তিস্থল হিসেবে মিসর খ্যাত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঋতুর আবর্তনের সঙ্গে ফসল বোনা, আবাদ, পরিচর্যা ও কর্তনের অনিবার্য সম্পর্ক থাকার প্রেক্ষাপটে চন্দ্রভিত্তিক বর্ষ গণনার স্থলে সূর্যভিত্তিক বর্ষ গণনা প্রাধান্য লাভ করে। উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর হিজরিসন প্রচলিত হলেও প্রয়োজনে বাংলাসনের মতো অনেক সৌরসনও চালু হয়। আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী বাংলাসনকে ৩৬৫ দিন ধরে হিসাব নির্ধারণ করেন। তিনি এর সঙ্গে শকাব্দের মাস, দিন ইত্যাদির নাম যেমন বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, শনি, রবি প্রভৃতি যুক্ত করেন। সেই সঙ্গে এই সনের সঙ্গে সংযুক্ত হয় চন্দ্রভিত্তিক ৩০টি তিথি। তিথিগুলো দুই পক্ষে বিভক্ত। যথা- শুক্ল পক্ষ, কৃষ্ণ পক্ষ।
বাংলাসন বাংলাদেশের জাতীয় সন। এর পাশাপাশি হিজরিসন ও খ্রিস্টীয়সনও চালু আছে। একটি দেশে একই সঙ্গে তিনটি সনের অনুসরণ খুব কমই দেখা যায়। এই তিন সনের মধ্যে হিজরি সবচেয়ে প্রাচীন। তারপর বাংলা। সর্বশেষ অবস্থানে খ্রিস্টীয়সন। বাংলায় মুসলিম শাসন সূচিত হয় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে। অনুমিত হয়, তখনই হিজরিসন কার্যকর হয়। দিল্লিভিত্তিক এবং মুসলিম শাসন ও অন্যান্য সালতানাতেও হিজরি সন অনুসরিত হয়। বাংলাদেশে ধর্মীয় বিভিন্ন দিন-তারিখ হিজরিসন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। যেমন- রমজান, শবে মেরাজ, শবে কদর, শবে বরাত, মুহররম, দুই ঈদ ইত্যাদি। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি ও এবাদত-উৎসব হিজরিসন অনুসারে হয়ে থাকে। বলা যায়, ধর্মীয় জীবন নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় হিজরিসন মোতাবেক।
যেহেতু বাংলাসন ফসলিসন হিসেবে প্রণীত, সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না, কৃষির সঙ্গেই এর বিশেষ সম্পর্ক। কৃষিজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনকর্মের প্রতিফলন রয়েছে এই সনে। ফসল বোনা থেকে শুরু করে ফসল ওঠা পর্যন্ত যাবতীয় কর্মপ্রবাহ পরিচালিত হয় এই সনের দিন-তারিখ অনুযায়ী। ব্যক্তি জীবন, যেমন- জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ইত্যাদি এবং পারিবারিক কর্মাদি এই সন মাফিক হয়ে থাকে। বিভিন্ন উৎসব-আয়োজন, সাংস্কৃতিক কর্মকা- এবং ক্রীড়া প্রদর্শন ইত্যাদি বাংলাসন অনুযায়ীই হয়। চৈত্র সংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখের মেলা বিনোদন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটা বড় ধরনের উপলক্ষ হিসেবে বিবেচিত। এখন গ্রামাঞ্চলে এসব অনেকটাই কমে গেছে। শহরাঞ্চলে ভিন্নভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে এর কিছু কিছু অনুসৃতি লক্ষ করা যায়। শহরে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় নববর্ষ।
প্রথম বাংলায় এবং পরে গোটা উপমহাদেশ কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসনামলে দৌর্দ- প্রতাপ ছিল খ্রিস্টীয়সনের। ব্রিটিশ শাসকদের যাবতীয় কার্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ইত্যাদি খ্রিস্টীয়সন অনুসারে পরিচালিত হতো। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলত এই সন অনুযায়ী। ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর প্রায় পৌনে এক শতাব্দীকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমাদের রাষ্ট্রীয় ও শাহুরিক জনজীবনে খ্রিস্টীয়সনের ব্যাপক প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। এখনো আমাদের অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে খ্রিস্টীয়সন অনুসরণ করে। আমাদের অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস ও অনুষ্ঠানাদি খ্রিস্টীয় সন-তারিখ অনুযায়ী পালিত হয়। খ্রিস্টীয়সন এভাবে টিকে থাকার একটি বড় কারণ, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই সনটিই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। মোট কথা, বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয়, আর্থসাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক জীবনকর্ম পৃথক তিনটি সন অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এই তিনটি সনের নির্বিরোধ সহাবস্থান এখানে লক্ষ করা যায়।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ইরাকের শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার হয়নি

আশুলিয়ায় যাত্রীবাহী লেগুনা সড়কের পাশের খোলা ড্রেনে পরে নিহত ২

সিংগাইরে তেলের লড়িতে অগ্নিকান্ডে লড়ি ও মোটরসাইকেল ভস্মীভূত

বাংলা নববর্ষের র্যালিতে উপস্থিত না থাকায় ইবির হলে খাবার বন্ধ

প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠিতে যা বলেছে বিএনপি

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় স্বর্ণের দাম

লামায় দ্রুতগামী পিকআপ থেঁতলে দিল শিশুর পা
আচমকাই ডাউন হোয়াটস অ্যাপ, গ্রুপে যাচ্ছে না মেসেজ!

কসবায় বিদ্যুৎস্পর্শে দুই চাচাতো ভাইয়ের মৃত্যু!

সরিষার তেল ভেজাল না খাঁটি? জেনে নিন এই গোপন উপায়ে

সিকৃবিতে আন্ত: লেভেল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ২৬ তম ব্যাচ

নোয়াখালীতে ব্রান্ডের নকল বস্তায় চাউল প্যাকেট করে বিক্রি ;ভোক্তা অধিকারের ১ লক্ষ টাকা জরিমানা

ইমরান খান-বুশরা বিবির বিয়ের অজানা অধ্যায় প্রকাশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে সেরাটা দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ: নিগার

কূট-কৌশলে ভিআইপিদের টার্গেট করতেন মেঘনা আলম চক্র

সুন্নত নামাজে ভুল করে নামাজ শেষ করে ফেলা প্রসঙ্গে?

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে প্রজ্ঞাপন জারি

টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় ড. ইউনূস

গাজায় মানবিক সহায়তা নিষিদ্ধ ঘোষণা ইসরায়েলের, সংকট তীব্র

উইন্ডিজকে হারালেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ