ঈদের সংস্কৃতি
২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:০০ পিএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৩, ১২:১৪ এএম
বসন্তে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ঢেলে দেয়। এই সৌন্দর্য বাইরে থেকে আসে না। আসে ভেতর থেকে। ফুলের মুকুল-পাপড়ি, উদ্ভিদের অঙ্কুর-কিশলয় যখন ভেতরকার রূপমাধুরি উগরে দেয়, যখন প্রকৃতির আসরে মেলে ধরে তখন বসন্তের সমারোহ আসে। প্রকৃতির ন্যায় মানব জীবনেও এই পরিবর্তন লক্ষনীয়। মানুষের মন ও চিন্তার গহীনে লুকায়িত সৌন্দর্র্য যখন বিকশিত হয়, তখন স্বভাব ও চরিত্রে তার রূপায়ন দেখা যায়।
চরিত্রের এই জৌলুস ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ক্রমে উপচে পড়ে ঐশ^র্য ছড়িয়ে দেয় সমাজে। চারদিক আলোড়িত আমোদিত হয়। সমাজ জেগে উঠে নতুন রূপে, মেধা, প্রতিভা মননশীলতার জয়গানে মুখরিত হয়। মানব সমাজের এই জাগরনি রূপকে বলে সংস্কৃতি।
বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় সংস্কৃতির সুন্দর প্রতিচ্ছবি হচ্ছে ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরে আমাদের ব্যক্তি ও সমষ্টির সৌন্দর্যগুলো সমহিমায় আত্মপ্রকাশ করে, প্রস্ফুটিত হয়। এর একটি নমুনা, মানুষে মানুষে প্রেম-প্রীতি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাতাবরণ। কারণ, মুসলামানদের মধ্যে জাতপাতের বাছবিচার নেই। সবাই আল্লাহর বান্দা, এক সমান। আল্লাহর কাছে সম্মানের তারতম্য হয় তাকওয়ার নিক্তিতে। ঈদের মাঠে এই সাম্য সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের প্রদর্শনী হয় যখন নওয়াব-নফর, বাদশাহ-ফকির, ছোটবড় এক সারিতে আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়। পরস্পর গলাগলি বুকে বুক মিলানোর মধ্য দিয়ে জাতপাতের বৈষম্য পায়ে দলে নির্বাসনে পাঠায়। এ কারণেই বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বা বর্ণগত বৈষম্য নেই।
রমজানে এক মাস মুসলমানরা নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। খারাপ চিন্তা, আজেবাজে কথা ও কাজ থেকে মুখ ও হাতকে সংযত করতে টানা একমাস সাধনা করে। এতে খারাপ কথা-কাজ থেকে বিরত থাকার গুণটা মজ্জাগত হয়ে অভ্যাসে পরিণত হয়। অন্যদিকে পরিশুদ্ধ চিন্তা ও সৎ সুন্দর গুণাবলীতে মন সজ্জিত হয়। তার রূপ ফুটে ওঠে বাহ্যিক অবয়বে। কৃচ্ছ্রসাধনায় ভেতরকে সাজানোর পর শরীরের বাহিরকে সাজানোর অজানা তাগাদা অনুভব করে। ঈদে নতুন জামা নতুন জুতোর সংস্কৃতির উৎপত্তি এখান থেকেই। এই সংস্কৃতিতে জেগে উঠে ধনী দরিদ্র সবাই, গোটা সমাজ, লোকালয়।
উৎসব অন্য সমাজ সভ্যতা বা জাতির মধ্যেও আছে। সেই উৎসব কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠী কিংবা উপলক্ষ ও সময়কালের আওতায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু ঈদ? ঈদের সংস্কৃতির প্রভাব প্রকৃতিতে বসন্তের মতো। সমাজের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। প্রতিটি মানুষের জীবনকে ছোঁয়া দেয়।
রমজানে ধনীদের উপর ফরজ গরীবদের মাঝে জাকাত বিলানো। ঈদের দিন পরিবারের প্রত্যেকের পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করতে হয় সামর্থ্যবানদের। এটি ধর্মীয় বিধান। ফিতরার অর্থ পেয়ে গরীবরাও ঈদের আনন্দে অংশীদার হওয়ার সুযোগ পায়। এভাবে ঈদের সংস্কৃতি ধনী-গরীব সবার তরে নিয়ে আসে আনন্দের সওগাত।
বিশে^র দিকে দিকে আনন্দ উৎসবে নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলার সংবাদ আসে মিডিয়ায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গলদগর্ম হতে হয়। এরপরও চরিত্র হনন, বস্ত্র হরণ ও খুনাখুনির মতো ঘটনা ঘটে। ঈদের সংস্কৃতিতে এসবের অস্তিত্ব নেই। ঈদের আনন্দে আগাগোড়াই থাকে পবিত্রতার ছোঁয়া। ভালোবাসা, প্রীতি বিলানোর আবহ আমেজ।
বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা জানেন, মানুষ যোগাড় করা আর ব্যবস্থাপনার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালতে হয়। যার অনেকটাই অপচয়। ঈদের সংস্কৃতিতে কোনো ধরনের অপচয় নেই। জাতীয় ঈদগাহে যে প্যান্ডেল করা হয়, তাও শরীয়তের মেজাযের পরিপন্থী। ঈদের নামায হবে ফজরের পর সূর্য তেতে ওঠার আগে খোলা ময়দানে। নবীজি জীবনে অতিবৃষ্টির কারণে একবার মসজিদে ঈদের নামায পড়েছেন। সবসময় পড়েছেন খোলা আকাশের নিচে। এটিই ঈদের ইসলামী সংস্কৃতি। ঈদ সংস্কৃতিতে প্যান্ডেলের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় না। ঈদের সংস্কৃতি আগাগোড়াই নির্মল।
ঈদে আপ্যায়নের জন্য ঘরে ঘরে শিরনি-ফিরনির যে সংস্কৃতি কিংবা নতুন জামা-জুতা কেনার যে রেওয়াজ তার কোনটাই ফেলনা নয়। অপচয় নেই। আহারে ব্যবহারে সবটাই কাজে লাগে।
নৈতিক শুদ্ধি ও পাপমুক্ত জীবনের জন্য অন্য ধর্মেও সাধনা আছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের মধ্যে সংসার বিরাগী জীবনের যে সংস্কৃতি তার মূলে আছে দুনিয়া বর্জন করে আত্মিক শুদ্ধি অর্জনের চেষ্টা। এর জন্য সমাজের একটি শ্রেণীকে সংসার ছেড়ে বৈরাগি সাজতে হয়। বিয়ে-শাদী করলে তাদের সাধনা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ইসলামের সাধন সংস্কৃতির সৌন্দর্য সম্পূর্ণ ভিন্নতর। বিশেষ শ্রেণি বা যোগী সন্যাসীরাই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষকে একটানা একমাস কৃচ্ছ্রসাধনা করতে হয় দিনের বেলা পানাহার ও যৌনসংসর্গ বর্জন করে।
রমজান ও ঈদের এই সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে সর্বজনীন। এখানে দুনিয়াকে সম্পূর্ণ বর্জন করার শিক্ষা নেই। বরং দুনিয়ার প্রতি লোভ মোহকে দমন করে মনের উপর রূহের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চর্চা করা হয়। বিয়ে-শাদী বর্জন, যোগী-সন্যাসীর জীবন মানব প্রকৃতির বিরোধী। ইসলাম দিয়েছে এক ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতিসম্মত সংসারি, সংযমি জীবনের দর্শন।
বিশে^র বিভিন্ন জাতির নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ আছে। ইহুদী-খ্রিস্টানদের ধর্মগন্থ তাওরাত-ইঞ্জিলের সামষ্টিক রূপ বাইবেলকে গবেষকরা আল্লাহর অক্ষত বাণী বলতে নারাজ। তাদের মতে, বাইবেলে ঈশ^রের কথা, যীশুর কথা ও তার শিষ্যদের কথা এককার হয়ে জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে। হিন্দুদের বেদকেও ঈশ^রের বাণী বলতে পারবেন না। বৌদ্ধরা তো খোদার অস্তিত্বেই বিশ^াস করে না। এরপরও কথা হলো, তারা যে ধর্মগ্রন্থকে মানে তা নিয়ে কতখানি চর্চা করে? ধর্মগ্রন্থ চর্চার যে সংস্কৃতি মুসলমানদের মধ্যে চালু আছে, সারাদিন রোজা রেখে ক্লান্ত শরীরে রাতের আঁধারে পবিত্রাবস্থায় নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন মজীদের বিশুদ্ধ পাঠ শোনার সংস্কৃতি, তার উদাহরণ কি অন্য কোনো ধর্মে বা সভ্যতায় আছে। তাই কুরআন মুখস্থ করেছে এমন হাফেজের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ হলেও অন্য ধর্ম গ্রন্থ মুখস্ত করেছে সমগ্র বিশে^ এমন একটি উদাহরণও নেই। সত্যিই রমজানের সাংস্কৃতিক আবহ জ্ঞানচর্চার সর্বজনীন পরিবেশ চিন্তাশীল মানুষের সামনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমার প্রমাণ।
রমজানের সাধনা মূলত ঈমান ও ইসলাম অনুসরণের বাস্তব অনুশীলন ও পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আনন্দ উৎসব ঈদুল ফিতর। একমাস ট্রেনিং শেষে সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের সাথে তুলনা করা যায় নফসের বিরুদ্ধে রূহের যুদ্ধ জয়ের কুচকাওয়াজ ঈদুল ফিতরকে।
ঈদ আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। দেশকে এগিয়ে নেয়। এটি ঈদ সংস্কৃতির আরেকটি রূপ। শরীর সুস্থ রাখতে হলে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক থাকতে হবে। দেহে রক্ত চলাচলের মতো অর্থনীতির শরীরেও রক্ত সঞ্চালন বলবৎ থাকতে হবে। অনেক টাকা আছে, ব্যাংকে অলস পড়ে আছে। অথবা টাকা বাড়িতে জমানো। এমন হলে দেশের অর্থনীতি রসাতলে যাবে। তাই লেনদেন, বেচাকেনা সরগরম থাকা দেশের উন্নতি ও সুস্থ অর্থনীতির নিয়ামক। রমজান ও ঈদের সংস্কৃতি ঠিক এ কাজটিই আঞ্জাম দেয়। ঈদ উপলক্ষে কেনাবেচার ধুম পড়ে। অর্থনীতি সচল ও প্রাণবন্ত হয়।
যে কোনো সামাজিক আন্দোলনের মূল শ্লোগান বা প্রতিপাদ্য থাকে। তাকে কেন্দ্র করে সকল কর্মকান্ড আবর্তিত হয়। সেই শ্লোগান বা প্রতিপাদ্য দেখে আঁচ করা যায় আন্দোলনটির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কী এবং দেশ ও সমাজ তার কাছ থেকে কী পেতে পারে। ঈদের যে শ্লোগান সর্বত্র ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় তা আমাদের অতি পরিচিত একটি অভিবাদন বাক্য: ‘ঈদ মোবারক আসসলাম।’ সবার জন্য সালাম-সম্প্রীতির পয়গাম। প্রাত্যহিক নামায শেষেও মুসলমানরা ডান ও বাম পাশে মুখ ফিরিয়ে সালাম দেয়। এই সালামের একটি লক্ষ্য মানুষে মানুষে যেন প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসার বাতাবরণ তৈরি হয়। পারস্পরিক সমতা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এর চেয়ে সুন্দর শিক্ষা কি কল্পনা করা যায়?
সত্যিই আমরা সৌভাগ্যবান, রমজান ও ঈদের মতো একটি সুন্দর, সুস্থ, নির্মল পবিত্র আনন্দের উপলক্ষ আমাদের ভাগ্যে জুটেছে। ঈদের সংস্কৃতিতে দেশ, অঞ্চল বা সম্প্রদায় ছাড়িয়ে বিশ^মুসলিমের সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ পাই। এই আনন্দ আমাদের জৈবিক কামনা বাসনার বাধনমুক্ত করে, আল্লাহ ও রাসূলের পথ দেখায়।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার নিহতের ঘটনায় মামলা
সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের সময় বাড়ল
মেহেরপুর জেলা বিএনপির নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে কেএমপিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে; কেএমপি কমিশনার
মির্জাপুরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত
বাগেরহাটে ষড়যন্দ্রমূলক মিথ্যা মামলা ও হুমকির প্রতিবাদে প্রবাসীর সংবাদ সম্মেলন
পদবঞ্চিতদের আড়ালে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, জবি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতায় বিবৃতি
টিকেটে ছাড়াই তারকা খেলোয়াড়দের খেলা দেখার সুযোগ পাবে সিলেটবাসী
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ২ কমিটি গঠন
কনস্টাসকে ধাক্কা দেওয়ার শাস্তি পেলেন কোহলি
আটঘরিয়ায় ফসলী জমিতে চলছে পুকুর খনন আশঙ্কাজনক হারে কমছে জমি
পাইকগাছায় অসুস্থ গরীবদের জন্য জিয়া প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টারের দিনব্যাপী ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প
কেশবপুর উপজেলা মৎসলীগের সভাপতি ও সুফলাকাঠী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম মুনজুর রহমান ডিবি পুলিশের হাতে আটক
মাদারীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মাদ্রাসার শিক্ষকের প্রান গেল
বিদেশি নাগরিকদের বৈধতা অর্জনের সময়সীমা বেঁধে দিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
কুলাউড়ায় মোবাইল চুরির অপবাদ সইতে না পেরে যুবকের আত্মহত্যা
মাদারীপুরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের মানববন্ধন
তারাকান্দায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত-৬
আওয়ামীলীগ লাশের ওপর নৃত্য করে ফ্যাসিস্ট ইতিহাস তৈরি করেছিল : ড. রেজাউল করিম
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নীলফামারী ছাড়লেন আসিফ মাহমুদ