ঈদের দর্শন
২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:০৮ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:৫৭ এএম
ঈদ আরবী শব্দ। এ শব্দটি সাধারণত খুশি, উৎসব, আনন্দ, উল্লাস প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রকৃত অর্থে ঈদ শব্দটি ‘আউদুন’ শব্দ থেকে নির্গত, যার অর্থ ফিরে আসা। যেহেতু ঈদ বছর বছর নতুন আনন্দ ও উৎসব নিয়ে মু’মিন মুসলমানের ঘরে ফিরে আসে, তাই একে ঈদ বলা হয়। ঈদ মুসলিম মিল্লাতের সবচেয়ে বড় উৎসব।
মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে আনন্দ, উৎসবপ্রিয়। পৃথিবীর প্রতিটি জাতি তাদের নিজ নিজ ঐতিহ্য অনুযায়ী তাদের আনন্দ, উৎসব পালন করে থাকে এবং এ জন্য তাদের নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা আছে। এ সমস্ত অনুষ্ঠানাদি পালনের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কোনো কোনো জাতি শুধুমাত্র রং তামাশা ও আমোদ প্রমোদের জন্যই উৎসব পালন করে থাকে। এর কোনো দার্শনিক ও নৈতিক ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। উপরন্ত এই সব উৎসবের ভিন্ন স্বাদ ও মাত্রা যোগ করার জন্য এর সাথে বিভিন্ন নগ্নতা, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনাকে জুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু মুসলমানদের ঈদের দার্শনিক ও নৈতিক ভিত্তি রয়েছে। এর মাধ্যমে মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, আকিদাহ-বিশ্বাস এবং নৈতিক প্রাণশক্তির প্রতিফলন ঘটে থাকে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এবং ইসলামই হলো, আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থা কুরআন ও হাদিসের আলোকে পরিচালিত হয়। এটি পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামে কোনো কিছুই অন্যের থেকে ধার করে আনার কোনো প্রয়োজন নেই। ফলে ইসলাম অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠি ও সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক সংস্কৃতির প্রতিপালন করে থাকে। শুধুমাত্র সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নয়, জীবনের প্রতিটি অঙ্গনেই ইসলামের একটা স্বাতন্ত্র রয়েছে। রাসুল সা. ইসলামের সাধারণ হুকুমের বেলায়ও অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির আচার-আচরণ ও আনুষ্ঠানিকতার সাথে পার্থক্য নিরূপণের জন্য আল্লাহরই নির্দেশক্রমে কিছুটা ভিন্ন রূপদান করতেন। আর এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা মুসলিমকে শ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদায় আসীন করেছেন। আবহমান কাল ধরে মুসলিম জাতি পৃথিবীর এ শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন হয়ে আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে। (সুরা আল ইমরান-১১০)।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতিই তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে থাকে তাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে। যে জাতি নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, ও তাহযীব-তমুদ্দনের প্রতি বেশি যতœবান সে জাতি ততবেশি উন্নত। ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখা একটি উন্নত জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। যখনই কোনো জাতি তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সাথে অন্যান্য জাতির বৈশিষ্ট্যকে অংশীদার করেছে তখনই জগাখিচুড়ি পাকিয়ে একটি হ-য-ব-র-ল মেরুদ-হীন জাতিতে পরিণত হয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মুসলিম জাতি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। কারণ, মুসলিম জাতির রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনাচরণ। যারা আল্লাহকে ভয় করতে চায়, তাদের পৃথিবীতে নিশ্চিন্তে পথ চলার একমাত্র উত্তম গাইড হলো আল-কুরআন। যারা এ মহা গ্রন্থকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র নির্দেশিকা হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছে, তারা প্রকৃত পক্ষেই একটি মজবুত অবলম্বন ধারণ করেছে। তাই প্রতিটি মুসলিমের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন, চাল-চলন ও সমাজ-সংস্কৃতি তথা প্রতিটি কাজ ও আচরণই হতে হবে আল-কুরআনের পূর্ণ অনুসরণে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের এ দেশে যেখানকার অধিকাংশ অধিবাসী ইসলামকে পছন্দ করে, ইসলাম অনুযায়ী নিজেদের সকল কিছু পরিচালনা করার ইচ্ছা পোষণ করে। অথচ, গুটিকয় পরগাছা, মুসলিম নামের কলঙ্ক, যারা বিদেশিদের দালাল হিসেবে পরিচয় দিতে নিজেদের গর্ববোধ করে, তারা তাদের দখলে থাকা মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামী অনুষ্ঠানগুলোকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে দেশ ও জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। বিশেষ করে, মুসলমানদের দুটি বৃহৎ পবিত্র উৎসব ঈদ তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার ওপর এদের কালো থাবাটা অত্যন্ত মারাত্মক। তারা পবিত্র ঈদকে আজ বিজাতীয় সংস্কৃতির দ্বারা এমনভাবে সাজিয়েছে যে, এর প্রকৃতরূপ জাতি এখন প্রায় হারাতে বসেছে। এর প্রভাব এতটাই কার্যকর হয়েছে যে, ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত ইসলামের পবিত্র ও সুস্থ এ সংস্কৃতির বিকৃতি সাধনে তৎপর। মনে হয়, পবিত্র এ উৎসবের সাথে অসংখ্য বিজাতীয় ও অপবিত্র উৎসবের সংযোজন না ঘটালে ঈদের প্রকৃত আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল। ঈদ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রগুলো এমন সব উদ্ভট অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করে, যা দেখলে দৃষ্টির বিভ্রাট ঘটে। মনে করতে পারি না যে, এটি কি আসলে ৯০% মুসলমানের দেশের রাষ্ট্রীয় যন্ত্র? এটি কি কোনো মুসলমানের ঈদ উৎসব? না কি ভিনদেশের ভিন জাতির কোনো উৎসব? পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠিকে তাদের বড় কোনো উৎসবের অনুষ্ঠানমালায় আমাদের মতো এ ধরনের মিশ্র উৎসব করতে তেমন একটা দেখা যায় না। হিন্দু জাতির বড় উৎসব হলো দুর্গা উৎসব। কই কোথাও তো দেখা যায় না যে তারা আমাদের মত মিশ্রণপ্রিয় মুসলমানদের ন্যায় কিছু মুসলিম সংস্কৃতি, কিছু পশ্চিমা বা কিছু অন্যান্য জাতির সংস্কৃতি থেকে ধার করে নিয়ে এক জগাখিচুড়ি উৎসব পালন করছে।
জাহেলিয়াত যুগে ইবাদাতের সাথে মুশরিকী ও জাহেলী ক্রিয়াকর্মের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তা পালন করা হতো। বিশেষ করে, হজ অনুষ্ঠানটি। মেলা, সকল প্রকার তামাশা, উৎসব ও উলঙ্গপনাসহ পালিত হতো। আমরা এগুলো থেকে কি কোনো অংশে পিছিয়ে আছি? আমরা বরং তার চেয়েও আগ বাড়িয়ে এমন কিছু রসম-রেওয়াজ প্রবর্তন করেছি, যেগুলো জাহেলিয়াতের প্রচলিত কুসংস্কারকেও হার মানায়। একটি মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাক্ওয়া অর্জনের কি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলাম? উচিত ছিল সিয়াম সাধনার মাধ্যমে এমন শক্তি অর্জন করবো, যাকে তাক্ওয়া বা তাক্ওয়ার শক্তি বলা হয়। সে শক্তির মাধ্যমে জীবন চলার বাঁকে বাঁেক শয়তান কর্র্তৃক পেতে রাখা অতি লোভনীয় বস্তুকে বর্জন করে ভালো কাজের জন্য অগ্রসর হতে পারবো। ২/৩ দিন ঈদ উৎসবের নামে যে পাগলামী শুরু হয়, তা দেখে শয়তানও মুছকি হাসে। শয়তান হয়ত অনেকটা চ্যালেঞ্জের সুরে এমনটি বলতে পারে যে, একটি মাস আমাকে বন্দি করে রাখা হলেও আমি আমার এমন অসংখ্য যোগ্য প্রতিনিধি তৈরি করে এসেছি, যারা পুরো রমযানসহ ঈদ উৎসবে এমন সব উদ্ভট বিষয়ের প্রদর্শন বা উপস্থাপন করবে, যা দেখে অনুভব করতে পারবে রমযানের রোযা কতজনকে তাক্ওয়ার গুণের অধিকারী করতে পেরেছে। আল্লাহর রাসুল সা. এ জন্যই বলেছেন: ‘কতক রোযাদার এমন রয়েছেন যাদের রোযা শুধু ক্ষুধা ছাড়া কিছুই দেয় না, কতক রাত্রি জাগরণকারী এমন রয়েছেন যাদের রাত্রি জাগরণ শুধু জাগরণ ছাড়া আর কিছুই পায় না।’ রাসুল সা. আরো বলেছেন, ‘কেউ যদি মিথ্যা কথা বলা ও তদনুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’
আমাদের ঈদ উৎসব দেখে রাসুল সা. এ হাদীসটিই বেশি বেশি মনে পড়ে। রমযানের রোযার আগে যেখানে ছিলাম সেখানেই তো রয়ে গেলাম। বরং রমযানে অতিরিক্ত কিছু কুকাজ বেশি সংঘঠিত হয়েছে মাত্র। ঈদ উৎসব পালনের নামে আরো কিছু কুকাজ ও আচরণ দেখা যাবে। অথচ, আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘যে পন্থা আল্লাহ তোমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, ঠিক তদনুযায়ী আল্লাহর স্মরণ কর যদিও এর পূর্বে তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে।’ (সুরা বাকারা: ১৯৮)
এমনটি হওয়ার প্রকৃত কারণ হলো, আমরা সিয়াম সাধনায় মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে পিছনে ঠেলে দিয়ে গতানুগতিক বা ¯্রফে একটি অনুষ্ঠানই পালন করে এসেছি। ফলে এ লক্ষ্যহীন রোযা কোনো কাজে আসেনি। যেমন লক্ষ্যহীন নামায খারাপ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারছে না, লক্ষ্যহীন যাকাত পবিত্রতা দান করতে পারছে না, তেমনি লক্ষ্যহীন রোযাও তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছে না। ইসলামী সংস্কৃৃতি কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী জীবনাদর্শের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু আমাদের মুসলিম নামদারী কিছু কিছু লোক ভোগবাদী জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে এ দেশের ইসলামের পবিত্র অনুষ্ঠানগুলোকে চরমভাবে কুলষিত করছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ২ কমিটি গঠন
কনস্টাসকে ধাক্কা দেওয়ার শাস্তি পেলেন কোহলি
আটঘরিয়ায় ফসলী জমিতে চলছে পুকুর খনন আশঙ্কাজনক হারে কমছে জমি
পাইকগাছায় অসুস্থ গরীবদের জন্য জিয়া প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টারের দিনব্যাপী ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প
কেশবপুর উপজেলা মৎসলীগের সভাপতি ও সুফলাকাঠী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম মুনজুর রহমান ডিবি পুলিশের হাতে আটক
মাদারীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মাদ্রাসার শিক্ষকের প্রান গেল
বিদেশি নাগরিকদের বৈধতা অর্জনের সময়সীমা বেঁধে দিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
কুলাউড়ায় মোবাইল চুরির অপবাদ সইতে না পেরে যুবকের আত্মহত্যা
মাদারীপুরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের মানববন্ধন
তারাকান্দায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত-৬
আওয়ামীলীগ লাশের ওপর নৃত্য করে ফ্যাসিস্ট ইতিহাস তৈরি করেছিল : ড. রেজাউল করিম
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নীলফামারী ছাড়লেন আসিফ মাহমুদ
ডিমলায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার
ফায়ার ফাইটার নয়নের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া
কচুয়ার একাধিক মামলার আসামি বাবু দুমকীতে গ্রেফতার
পূর্বাচলের সরকারি প্লটে অনিয়ম: হাসিনা-রেহানার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
ধামরাইয়ে ২ সন্তানের জননীর আত্মহত্যা স্বামী আটক
দৌলতদিয়ায় বয়স্ক যৌনকর্মীদের শীতবস্ত্র ও শিশুদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
যারা নির্বাচনকে বিতর্কিত করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত: বদিউল আলম
নাচোল পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মুসা মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত