ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ঈদে আমাদের প্রার্থনা

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:০৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:১৮ পিএম

বর্ষ পরিক্রমায় বিশ্ব মুসলিমের দরজায় সাম্য ও মৈত্রীর বাণী নিয়ে আসে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। মাহে রমজানের শেষ সূর্য ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসান ঘটে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার। পশ্চিমাকাশে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ বিশ্ব মুসলিমের ঘরে ঘরে ঘোষণা করে এক অনির্বচনীয় আনন্দের বার্তা। অনাবিল ও অনাড়ম্বর এক আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে মুসলিম বিশ্ব। ঈদ-উল-ফিতর একই সঙ্গে সিয়াম সাধনার সাফল্যের প্রতীক ও নির্মল আনন্দের দ্যোতক। আশীর্বাদ, ক্ষমা এবং মুক্তির মাস মাহে রমজান। রমজানের বিদায় লগ্নে ক্ষমা, নাজাত ও মুক্তির আনন্দ নিয়ে আসে ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দ কেবল তাদের জন্য যাঁরা কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রমজানের দিনগুলোতে পানাহার বর্জন করে, রিপু সংযত রাখে এবং রোজার নিয়মকানুন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে থাকে। পক্ষান্তরে যারা রোজা পালন করে না, রমজানের মর্যাদা ও পবিত্রতা মান্য করে না, বরং আল্লাহর নাফরমানী করে, তাদের জন্য ঈদ-উল-ফিতর দুঃসংবাদের বার্তাবহ। মহানবী (সা.) এ সম্পর্কে পরিষ্কার বলেছেন, রমজানের যাবতীয় কর্মসূচিকে যে পালন করে, ঈদের আনন্দ তার জন্য। মহানবীর (সা.) এ কথার পর ঈদ-উল-ফিতরের তাৎপর্য আর অননুধাবনীয় থাকে না।

ঈদ-উল-ফিতর প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে রোজাদার মুসলমানের জন্য দিনের বেলা পানাহার ২৬০ গ্রহণের এক বিশেষ আমন্ত্রণ। তাই যে ব্যক্তি মাহে রমজানের দিনের বেলা পানাহার করে থাকে অথচ এর পেছনে শরিয়ত সম্মত কোনও কারণ থাকে না, তার জন্য ঈদ-উল-ফিতরের আগের দিন এবং ঈদের দিনের মধ্যে কেবল মাত্র পোশাক আর প্রসাধনী পার্থক্য ছাড়া অন্য কোনও পার্থক্য নেই। ঈদ-উল-ফিতরের দিন একজন রোজাদার মুসলমানের জন্য সত্যিই খুশির দিন।

কেননা, দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশক্রমে যাবতীয় পানাহার, যৌন সম্ভোগ হতে সে বিরত থাকে। ঈদের দিন সে আল্লাহর নির্দেশে পানাহার গ্রহণ করে। দিনের বেলা যে খাদ্য তার জন্য নিষেধ থাকে, সে খাদ্যই তার জন্য ঈদের দিন হালাল করে দেওয়া হয়েছে। পানাহার ও যৌনাচার ত্যাগ এবং গ্রহণ উভয় ক্ষেত্রেই সে আল্লাহর হুকুম মেনে চলে। তাই কোনও ভয় বা আশঙ্কা নেই তার, আল্লাহর দরবারে সে আমন্ত্রিত মেহমান, তাঁর হাসি-খুশি ও আনন্দের মধ্যে কৃত্রিমতার বা অনুমান সর্বস্বতার কোনও ছাপ থাকতে পারে না ।

আমরা দেখতে পাই, সত্যিকার অর্থে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য থেকে আমরা অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ প্রতিটি মানুষের মনে বিরাজমান। গোটা সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতির পঙ্কিলে। তাই ঈদ নামে মাত্র আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। যেখানে কৃত্রিমতাই সব, সেখানে আর যাই হোক নির্মল আনন্দ দুর্লভ। তবুও আমরা সবাই সোনার হরিণের পিছু কেবল ছুটছি তো ছুটছি। যে দেশে অর্থনৈতিক ভিত্তি এত নড়বড়ে যে সেখানে বছরে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে সে দেশবাসী বিশেষত আমাদের মতো শহুরে মানুষের দিকে তাকিয়ে তাই মনে হয় আমরা আমাদের নৈতিকতা, বিবেক-বুদ্ধি সবই বিকিয়ে দিয়েছি। তাই সমাজের সর্বস্তরে কৃচ্ছ্রতা সাধনের নামে চলছে অপব্যয়ের খেলা। অথচ মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, অপব্যয়ীরা শয়তানের ভাই।

ইদানিং ঈদে আমরা দেখতে পাই অসহনীয় প্রতিযোগিতা। কে কার চেয়ে অধিক মূল্যবান পোশাক-আশাকে সুসজ্জিত হয়ে সবার দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। আমরা ঈদের ন্যায় একটি অতি পবিত্র ও মহিমান্বিত উৎসবকে কলুষিত করি নানাভাবে। ইসলাম কখনও বৈরাগ্যের কথা বলেনি তবে ইসলামে অপব্যয়, অকারণ জৌলুস ও বাড়াবাড়িকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ঈদ-উল-ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য এই যে, এর যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা পরস্পরের মধ্যে শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক সংহত করার লক্ষ্যে পরিচালিত মুসলিম জাহানের প্রতিটি মানুষ যাতে ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারে সে জন্য এ মাসে বেশি দান-খয়রাত করা, যাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ঈদ-উল-ফিতরের অর্থনৈতিক তাৎপর্য এটাই। ইসলাম সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের যে শিক্ষাদান করেছে, ঈদ-উল-ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেও তার প্রকাশ লক্ষণীয়। ধনী-গরিব, সাদা-কালো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল মানুষের এক কাতারে সামিল হওয়ার ঘটনা মানবতা ও সাম্যের এক অনন্য নিদর্শন ।

প্রসঙ্গত, একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এক ঈদের দিনে অন্যরা যখন আনন্দে উল্লাসে মত্ত, তখন হঠাৎ দেখা গেল, খলিফাতুল মুসলিমুন হজরত ওমর ফারুক ঘরের মধ্যে ক্রন্দনরত। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আমীরুল মুমিনিন, আজ তো খুশির দিন, আমরা সকলেই হাসি-খুশি করছি আর আপনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ক্রন্দনরত, ব্যাপার কী? আমীরুল মুমিনিন বললেন, যদি তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে থাকে যে, যাদের সিয়াম সাধনা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়েছে তাহলে তারা আনন্দ উল্লাস করতে পারে। আমার তো জানা নেই। রমজানের সিয়াম সাধনা কবুলের মধ্যেই পবিত্র ঈদের আনন্দ নিহিত, আর এ আনন্দের সওগাত কোনও এক মুসলিম একা ভোগ করতে পারে না। কারণ, ঈদের তাৎপর্য অনেক অনেক মহিমান্বিত। প্রথমেই আমাদের জানা দরকার ঈদ-উল-ফিতরের অর্থ কী? ঈদ অর্থ খুশি আর ফিতর শব্দের অর্থ হচ্ছে ভঙ্গ করা। অতএব, ঈদ-উল-ফিতরের অর্থ দাঁড়ায় রোজা ভঙ্গের ঈদ। যাকাত বা ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও নির্ধনের মধ্যেকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয় এবং তা সাম্য ও মৈত্রীর ভিত্তি। সুনির্মল এই শিক্ষাই ঈদের মূল শিক্ষা আর এতেই মুসলিম হৃদয় আনন্দে হয় উদ্বেলিত।

আজকের মুসলিম সমাজে ইসলামে মানবতাকে স্থান দেওয়া হয়েছে সবার উপরে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’, ইসলাম ধর্ম এ নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু আমরা একটিবারও কি ফিরে তাকাই ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খাওয়া মানুষের দিকে? আজ সেদিন এসেছে, আমাদের ভেবে দেখতে হবে কেবল মুখে নয়, কথা ও কাজে তা প্রমাণ করে দেখাতে হবে।

দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন, হতাশা, যাতনা নিপীড়ন, সন্ত্রাস প্রতারণায় যখন আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে, যখন বেকারত্ব, ক্ষুধার জ্বালা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তখন ঈদ এসেছে আমাদের কাছে। তবু ঈদের এ আনন্দকে আমাদের ভাগ করে নিতে হবে ।

জাতীয় জীবনের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও বিরাজ করছে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। ব্যক্তি, সমাজ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জুলুম, নির্যাতন ও অনাচার নির্বিচারে চলছে, বিচারের নামে চলছে প্রহসন। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, সমাজে সমাজে এবং জাতিতে জাতিতে বিসম্বাদ বিশ্বকে গ্রাস করছে। এ অবস্থায় যথার্থ ঈদ পালন করতে হলে সকল অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ঈদের দিনে আমাদের ঐকান্তিক মোনাজাত হোক দেশের সমাজ জীবন হতে যাবতীয় অসঙ্গতি দূর, হাইজ্যাক, খুন-খারাবি, বিবাদ- বিশৃঙ্খলার অবসান।

তাই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের যথার্থ শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত করে এ ধরাধামকে শান্তির সাম্রাজ্যে পরিণত করতে হবে। লাখো কোটি মুসলিম ভাইকে ভুখা-নাঙ্গা অবস্থায় রেখে যে ঈদ প্রকৃত অর্থে সমগ্র মুসলিম জাতির আন্তর্জাতিক আনন্দ উৎসব সে ঈদ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে না। তাই আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা হবে আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ আমাদের যেন তেমন ঈদের দিন দান করেন যেদিন এ জাতির প্রতিটি সদস্য এ উৎসবে মুখর হয়ে উঠতে পারবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা