ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম

মহান প্রভূর ঘোষণা: ‘নিঃসন্দেহে অবশ্যই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’। ‘আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সুউচ্চে স্থান দিয়েছি’। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ভূয়সী প্রশংসার এমন উচ্চারণগুলো যাঁর প্রসঙ্গে তিনি হলেন আমাদের প্রিয়নবী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল, বিশ্বমানবতার মহান ত্রাণকর্তা বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ (সা.)। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে বিশ্বের প্রতি প্রান্তে অযুত কণ্ঠে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে তাঁর মহিমাগাথা। ১২ রবিউল আউয়াল এই মহান দয়ালু নবীর শুভ জন্মদিবস। তাঁর প্রতি আমাদের শত-সহস্র দরূদ ও সালাম। তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
ঈদ মানেই খুশি, আনন্দ-উৎসব। আর মিলাদুন্নবী মানে নবী করিম (সা.) এঁর জন্মবৃত্তান্ত। কাজেই ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) এর শাব্দিক অর্থ হলো হুজুর পুরনূর (সা.) এঁর এই ধরাতে শুভাগমনকে উপলক্ষ করে আনন্দ-উৎসব উদ্যাপন করা। বিশ্বনবী (সা.) যেদিন যে মুহূর্তে পৃথিবীতে তাশরিফ এনেছিলেন সেদিন ও সে মুহূর্তটি বিশ্বজগতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের দিন। এ জন্যই বলা হয় ঈদে মিলাদুন্নবী তথা নবীজির জন্ম দিবসের আনন্দ। আর প্রিয়নবী (সা.) এঁর তাশরিফ আনায়নকে কেন্দ্র করে খুশি উদ্যাপন বা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করা শুধু বৈধই নয়; বরং তা মহান অল্লাহর নির্দেশও বটে।
মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: ‘(হে রাসুল!) আপনি বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁরই রহমত (দয়া) এবং সেটারই ওপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সব সঞ্চিত ধনদৌলত অপেক্ষা অধিকতর শ্রেয়’। (সুরা ইউনুস, আয়াত ৫৮)। মুফাস্সির সম্রাট হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) উল্লেখিত আয়াতের ‘রহমত’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন, রহমত দ্বারা আমাদের প্রিয়নবীকেই বোঝানো হয়েছে। তাছাড়া এ আয়াতটির গভীরে গেলে নিঃসন্দেহে মেনে নিতে হবে যে, মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর জন্য রাসুল (সা.)-ই সর্বোত্তম অনুগ্রহ ও দয়া, যার শানে আল্লাহ অন্যত্র ইরশাদ করেছেন: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের ওপর বড় অনুগ্রহ করেছেন যে তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৬৪)। তাঁর সম্মানে আরো ইরশাদ হয়েছে: ‘আর আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)।
এ ধরনের আরো অনেক আয়াতে মহানবীকে বিশ্ববাসীর জন্য একটি ‘বিশেষ অনুগ্রহ’ হিসেবে ব্যক্ত করা হয়েছে। সেই অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায়ের জন্য মুসলমানদের প্রতি খুশি উদ্যাপনের নির্দেশ এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন করা সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলারই নির্দেশ। তাই হাদিস শরিফে আমরা দেখি, নবীজি নিজেই তাঁর মিলাদ পালন করেছিলেন। সহিহ মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে, নবীজিকে প্রতি সোমবার রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, ‘এ দিন আমার বেলাদত (জন্ম) হয়েছে এবং এ দিনেই আমার ওপর প্রথম কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে’ (মিশকাত শরিফ, পৃষ্ঠা ১৭৯)।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনের বৈধতা প্রসঙ্গে আরো একটি হাদিস উল্লেখ করছি, যেখানে বিশ্ববিখ্যাত হাদিসবিশারদ আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামি মক্কী (রহ.) নিজ সনদে খোলাফায়ে রাশেদিন কর্তৃক মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপনের গুরুত্বারোপের কথা বর্ণনা করেছেন। হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিলাদ শরিফ পাঠ করার জন্য এক দিরহাম পরিমাণ খরচ করবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।’ হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল, সে যেন দ্বীন ইসলামকেই জীবিত করল।’ হযরত ওসমান গণি (রা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম অর্থ ব্যয় করল, সে যেন বদর ও হুনায়নের মতো কঠিন যুদ্ধে শরিক হলো।’ হযরত মওলা আলী (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবীকে সম্মান প্রদর্শন করবে এবং তা উদ্যাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে, সে দুনিয়া থেকে ঈমানের সঙ্গে বিদায় নেবে এবং বিনা হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করবে।’ খায়রুত তাবেঈন হযরত হাসান বসরি (রা.) বলেন, ‘আমার যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও থাকত তবে আমি তার সবটুকুই মিলাদুন্নবী উদ্যাপনে ব্যয় করে ফেলতাম’ (আন-নি’মাতুল কুবরা আলাল আলম, পৃষ্ঠা ৭-৮)। আর জশনে জুলুস অর্থাৎ আনন্দ-র্যালি বের করে খুশি উদ্যাপন করা তথা নবীজির শুভাগমনকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ প্রকাশ করার পুণ্য কত বেশি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কোরআন ও হাদিসের অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত হলেও কিছু ভ্রান্ত মতাবলম্বী ঈদে মিলাদুন্নবীকে ‘ঈদ’ হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। তারা শুধু দুই ঈদকেই শরিয়তসম্মত মনে করে। তৃতীয় আর কোনো ঈদ আছে বলে তাদের জানা নেই। অথচ, আমরা কোরআন ও হাদিসে আরো অনেক ঈদ উদ্যাপনের সন্ধান পাই। হযরত ঈসা (আ.) আসমানি খাদ্য প্রেরণ করার জন্য আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, হে আমাদের প্রতিপালক! আকাশ থেকে আমাদের জন্য একটি খাদ্য-খাঞ্চা অবতরণ করুন, যা আমাদের জন্য ঈদ (আনন্দোৎসব) হবে। আর ঈদ হবে আমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সবার জন্যও’। (সুরা মায়েদা, আয়াত ১১৪)।
মহানবী (সা.) জুমাবার ও আরাফাত দিবসকে যথাক্রমে ‘সাইয়্যেদুল আইয়্যাম’ এবং ‘ঈদ’ বলে অভিহিত করেছেন। এ রকম আরো অনেক ঈদের সন্ধান পাওয়া যায় কোরআন-হাদিসে। হযরত ঈসা (আ.) এর দোয়ার বদৌলতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসমানি খাদ্য প্রেরণ যদি হযরত ঈসা (আ.) এর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সবার জন্য ‘ঈদ’ হয়, তাহলে যে নবীকে সৃষ্টি না করলে বিশ্বজগত তো বটেই; হযরত আদম থেকে ঈসা (আ.) পর্যন্ত কোনো নবীকেই সৃষ্টি করা হতো না, এমনকি মহান আল্লাহ তাঁর একত্ববাদ প্রকাশ করতেন না; সেই মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবীর পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে এই ধরাতে শুভাগমন কেন ‘ঈদ’ হিসেবে বিবেচিত হবে না?
আমাদের প্রিয়নবী তিনি ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’। নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের অসীম করুণার আধার। বিশ্বের বিস্ময়। সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তো বটেই, অহংকারও তিনি। যাঁর গুণ-কীর্তনে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এমনকি কমিউনিস্ট-নাস্তিকরা পর্যন্ত পঞ্চমুখ; মক্কার কাফির-মুশরিক ও জানের দুশমনরাও যাঁকে ‘আল আমিন’ বা মহাবিশ্বাসী গুণে গুণান্বিত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি; যাঁর আবির্ভাবে কিসরা ও কায়সারের গগনচুম্বী রাজপ্রাসাদে ফাটল ধরেছিল; পারস্যের অনির্বাণ অগ্নিকুণ্ড চিরনির্বাপিত হয়েছিল; শ্বেতসাগরের পানিরাশি হঠাৎ শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল; সিরিয়ার মরুতে নহর বয়ে গিয়েছিল; দেবালয়ের প্রস্তরমূর্তি কপাল ঠোকেÑ তাঁর সেই শুভাগমনকে বিশ্ববিবেক ক্ষণিকের তরেও ভুলতে পারে না।
নবীজি শুধু মুসলমানদের জন্য আগমন করেননি। তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল জগতের সকল ধর্মের, সকল মানুষের জন্য। শুধু মানুষ নয়, বিশ্বজগতের সব সৃষ্টির জন্যই তিনি রহমত। এই অর্থে তাঁর জন্মদিবসকে কেবলই ‘ঈদ’ নয়, বিশ্ববাসীর মহোৎসবও বলা যায়। আর এ সত্যটাই কবির কণ্ঠে এভাবে ধরা দিয়েছে, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহম্মদ এলো রে দুনিয়ায়/ আয় রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।... আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়...’।
মহানবী (সা.) ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক, সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক। তাঁরই ছোঁয়ায় বর্বর আরবজাতি সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিল। অন্যায়, অবিচার ও হানাহানিতে নিমজ্জিত আরববিশ্ব সত্য ও শান্তির সন্ধান পেয়েছিল। আজও তাঁর মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তাই আজ সংকটময় বিশ্ব যখন শান্তির অন্বেষায় দিশাহারা, তখন মহানবীর শিক্ষা ও আদর্শই আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে। জর্জ বার্নাড শ লিখেছেন, ‘বর্তমান অশান্ত বিশ্বে হযরত মুহম্মদ (সা.) জীবিত থাকলে এক কাপ কফি পান করতে যে সময় ব্যয় হয়, এই সময়টুকুর মধ্যেই বিশ্বের তাবৎ সমস্যাবলির সমাধান দিতে সক্ষম হতেন।’
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ইরাকের শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার হয়নি

আশুলিয়ায় যাত্রীবাহী লেগুনা সড়কের পাশের খোলা ড্রেনে পরে নিহত ২

সিংগাইরে তেলের লড়িতে অগ্নিকান্ডে লড়ি ও মোটরসাইকেল ভস্মীভূত

বাংলা নববর্ষের র্যালিতে উপস্থিত না থাকায় ইবির হলে খাবার বন্ধ

প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠিতে যা বলেছে বিএনপি

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় স্বর্ণের দাম

লামায় দ্রুতগামী পিকআপ থেঁতলে দিল শিশুর পা
আচমকাই ডাউন হোয়াটস অ্যাপ, গ্রুপে যাচ্ছে না মেসেজ!

কসবায় বিদ্যুৎস্পর্শে দুই চাচাতো ভাইয়ের মৃত্যু!

সরিষার তেল ভেজাল না খাঁটি? জেনে নিন এই গোপন উপায়ে

সিকৃবিতে আন্ত: লেভেল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ২৬ তম ব্যাচ

নোয়াখালীতে ব্রান্ডের নকল বস্তায় চাউল প্যাকেট করে বিক্রি ;ভোক্তা অধিকারের ১ লক্ষ টাকা জরিমানা

ইমরান খান-বুশরা বিবির বিয়ের অজানা অধ্যায় প্রকাশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে সেরাটা দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ: নিগার

কূট-কৌশলে ভিআইপিদের টার্গেট করতেন মেঘনা আলম চক্র

সুন্নত নামাজে ভুল করে নামাজ শেষ করে ফেলা প্রসঙ্গে?

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে প্রজ্ঞাপন জারি

টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় ড. ইউনূস

গাজায় মানবিক সহায়তা নিষিদ্ধ ঘোষণা ইসরায়েলের, সংকট তীব্র

উইন্ডিজকে হারালেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ