ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ : স্মৃতিতে অম্লান

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

জন্ম-মৃত্যু শ্বাশত-চিরন্তন সত্য। মৃত্যু সাধারণত জীবনের স্বাভাবিক ক্রম পরিণতি বলে অভিহিত। সে পরিণতি অর্থাৎ মৃত্যুকে আটকাতে মানুষ চিরতরে ব্যর্থ। তারপরও মানুষ চেষ্টা করে প্রাণপণ নিজেকে আরও ক’টা দিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য। জর্জ বানার্ডশ বলতেন, মানুষের অন্তত সাড়ে তিনশত বছর বেঁচে থাকা উচিত। তা না হলে একজন ব্যক্তির পক্ষে তার কর্মের প্রাপ্তির ভিত গড়া কিছুতেই সম্ভব হয় না। বানার্ডশ তার নিজের জীবন সম্বন্ধে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। তাঁর ধারণা ছিল, তিনি অন্তত দেড় শত বছর বাঁচবেন, যদি না তিনি কোনো দুর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে ৯৪ বছর বয়সে হঠাৎ গোসলখানায় পা পিছলে তিনি মারা যান। আমাদের আপনজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সর্বজনশ্রদ্ধেয় দার্শনিক, মানবহিতৈষী, অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমাদের মধ্যে বেঁচেছিলেন ৯০ বছরেরও বেশি সময়। অনেক চেষ্টা-তদবির করেও তাকে আরও ক’টা দিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মৃত্যুর মাস খানিক আগে আমি তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। ভালো-মন্দ অনেক আলাপ-আলোচনার পর বিনয়ের সাথে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি ক’দিন থেকে লিখছেন না কেন? বললাম, আমার মতো লক্ষ লক্ষ পাঠক আপনার লেখা পড়ার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি বলেন, ব্যথায় নড়াচড়া করা যায় না। মজা করে বলেছিলাম, দাদা পা-টা বদলে নিলে কেমন হয়। হেসে বলেন, আর বদলে লাভ কি! ট্রেনে উঠার সময় তো হয়ে গিয়েছে। এ আলাপের পর তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না, বিভিন্ন কাজে আমিও ছিলাম ভীষণ ব্যস্ত। একদিন ভোরে পূবালি ব্যাংকের পরিচালক আলহাজ্ব এম এ রকিব আমাকে ফোন করে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মৃত্যু সংবাদ জানালেন। তখন ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, রকিব ভাই বোধহয় মজা করছেন আমার সঙ্গে। খবরটা বোধ হয় সত্য নয়। তাৎক্ষণিক আমি তাঁর মেয়ে সাদিয়া চৌধুরী পরাগের কাছে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। আমরা জন্য এ ভীষণ দুঃসংবাদটি সত্যই হয়ে গেল।

১৯৭৪ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ঢাকায় থাকা অবস্থায় তাঁর বাসায় যাওয়া আসা ছিল। সুযোগ পেলেই দু’কথা বলার চেষ্টা করতাম, প্রশ্ন করতাম কিছু জানার বা শিখার আগ্রহে। বয়সের হিসাব বেশ ফারাক দু’জনার। কিন্তু তিনি আদর করতেন বলেই পাশে যেতাম কথা বলতাম, দাদা বলেই সম্বোধন করতাম। পরবর্তী পর্যায়ে বৈবাহিক সূত্রে দাদা-নাতি সম্পর্ক আমাদের রয়েই গেল। মজা করে বলতেন, তুমি তো আগে থেকেই আমার নাতি, আমি দাদা, বৈবাহিক সূত্রেও তুমি আমার নাতিন জামাই মন্দ না আমাদের সম্পর্ক, আরো দৃঢ় হলো। আসলে রাশভারি এ মানুষটির ভিতরে যে আরও এক ভিন্ন মানুষ লুকিয়েছিল, তার সঙ্গে মেলামিশা না করলে হয়ত জানতেই পারতাম না। আমি তাঁকে যেভাবে দেখেছি তার মহৎ জীবনের যতখানি জেনেছি, তারই নিরিখে কালের পরিপ্রেক্ষিতে তার মূল্যায়ন বক্ষ্যমান প্রবন্ধের লক্ষ্য। কাজটি নিঃসন্দেহে দুরূহ। দেওয়ান আজরফের সঙ্গে আমার যে গভীর ও আন্তরিক সম্পর্ক ছিল, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই এ দায়িত্ব আমাকে নিতে হলো।

অপরিচিত মানুষের সঙ্গে চট করে কথা বলতেন না দেওয়ান সাহেব। কিন্তু একবার মিশে গেলেই হয়, রীতিমত জমিয়ে কথা বলতেন। তাইতো অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে। ক্লান্তিকর কাজের পর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিত দেওয়ান আজরফের রসে ভরা মন্তব্য। স্বীয় মেধাবলে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। জাত, ধর্ম, বর্ণ নিবিশেষে সকল মানুষকে ভালবাসতেন। ফলে শিক্ষা-হিতৈষী ও মানবপ্রেমিক হিসাবে এক অনুকরণীয় আদর্শের প্রতীক ও প্রেরণার উৎস হয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন। শিক্ষা, সমাজসেবা ও মানব কল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন তিনি।

এ মুহূর্তে অনেক কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক স্মৃতি। কাগজে লিখতে গিয়ে বা অতীত জানার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন হতো নানা তথ্য ও পরিসংখ্যান। সে সময় কম্পিউটার বা ইন্টারনেটও ছিল না। কিন্তু আমাদের ভরসা ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেকে শুরু করে উপসাগরীয় যুদ্ধ অথবা এ অঞ্চলে তথা উপমহাদেশের অতীত ও বর্তমান বিষয়াদি সম্পর্কে তার ছিল গভীর জ্ঞান। ছিলেন এক জীবন্ত তথ্যভাণ্ডার। খুব কম লোকই তার কাছে কোনও কিছু জানতে চেয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসে একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হলেও ধ্যান-ধারণায় একজন যথার্থ উদার মানুষ পরিচয়ে তিনি ধন্য হয়েছেন। তিনি হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল সম্প্রদায়ের কাছে সমানভাবে সমাদৃত ছিলেন। এ যুগে বড় দুর্লভ এ ধরনের মানুষ।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অত্যন্ত বলিষ্ঠ নীতির অধিকারী ছিলেন। কোথাও কোনো ভুল থাকলে স্পষ্টভাবে ধরিয়ে দিতে কোনো দিনই দ্বিধা করতেন না। সামনে প্রশংসা করে পিছনে সমালোচনা করতে কখনও তাকে দেখা যায়নি। এ দিক দিয়েও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রায়শই দুঃখ করে বলতেন, এ অঞ্চলের বেশিরভাগ পাঠক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে গুরত্বহীন বিষয়গুলো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিত্য দিনের জীবন-যন্ত্রণা নিয়ে অসংখ্য খবর, প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ হলেও পাঠকদের সাড়া মেলে নিতান্তই কম। এ নিয়ে তার আক্ষেপ ছিল সতত। ফলে মাঝে মধ্যে অনুযোগের সুরে বলতেন, আর কত লিখব? কাদের জন্যই লিখব? নিজেদের জীবন-যন্ত্রণা সম্পর্কেই মানুষ এত নিস্পৃহ। শুধু শুধু লিখে কাগজ নষ্ট করার মানে কিছু হয় কি? কোনদিনে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি দেওয়ান আজরফের মুখে। সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন কারো সমস্যার কথা শুনলেই বিচলিত হয়ে উঠতেন তিনি।

আজ মনে পড়ছে ঢাকার জালালাবাদ এসোসিয়েশনের অফিস কক্ষে বসে একদিন কোনও এক বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্বন্ধে তাঁর মৃত্যুর পর কাগজের পাতায় স্মৃতিচারণ করে লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। পাশের চেয়ারে বসাছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। ঐ ব্যক্তির ছবি কাছে পাচ্ছিলাম না। রসিকতা করে দেওয়ান সাহেবকে বলেছিলাম, দাদা প্রয়োজনে কোনো কিছু না পেলে বড় সমস্যায় পড়তে হয়। বিচলিত হতে হয়। নিজের স্মৃতিচারণ করে বিস্তৃত জীবনের একটা লেখা তৈরি করে আমাকে দিয়ে যাবেন। সঙ্গে একটা ছবিও, যাতে করে সহসাই লে-আউট করে ফেলতে পারি।
না, আমার এ আবদারটুকু তিনি রাখেননি। একেবারে নিঃশব্দে সবার কাছ থেকে তিনি বিদায় নিলেন। সে দিনের সে রসিকতা যে এত তাড়াতাড়ি নির্মম বাস্তব হয়ে দেখা দেবে তা ভাবতে এখনও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটাতো কাগজের লে-আউট নয় যে, যখন খুশি একটাকে উঠিয়ে আরেকটা বসিয়ে দেখা যায়। এটাতো জীবনের লে-আউট। একবার চলে গেলে শত চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায় না। দেওয়ান সাহেব তো চলে গেলেন কিন্তু রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

পিসিবির অভিনব উদ্যোগ- ‘কানেকশন ক্যাম্প’

পিসিবির অভিনব উদ্যোগ- ‘কানেকশন ক্যাম্প’

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ