রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১১ এএম
চারদিকে এখন আলাপ কেবল সংস্কার নিয়ে। সংস্কারের বাংলা অর্থ মেরামত, শুধরানো। আরেক অর্থ ভালো করা বা ভালো হয়ে যাওয়া। বাংলা প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, ভালো হতে পয়সা লাগে না। তা হলে কী লাগে? লাগে ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলেই হয়ে যায়? না, কখনো কখনো ইচ্ছা থাকলেও ভালো হওয়া যায় না। ভালো হওয়ার আর সময় থাকে না। বহু বছর পর একটা সময়-সুযোগটা ধরা দিয়েছে ভালো হওয়ার।
গত এক মাসে যা ঘটেছে, তা ধারণা করাও কঠিন কারো কারো জন্য। কী থেকে কী হয়ে গেল!
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি শুরুতে ছিল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ও শান্তিপূর্ণ। তাদের দাবিগুলো ছিল একদিকে যৌক্তিক, আরেকদিকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে। আন্দোলনকারীরা ক্ষমতার প্রার্থী ছিল না। সরকারের বিদায়ও চায়নি। তারা চেয়েছিল শুধু কোটাপদ্ধতির সংস্কার, কোটার বিলুপ্তি নয়। সরকারের পক্ষে ওই দাবি মেটানো সম্ভবও ছিল। কিন্তু, সরকার তা কেবল অগ্রাহ্যই করেনি, বরং মারমুখী হয়ে হত্যা-দমন-পীড়নে ছাত্রদের প্রতিপক্ষ করে দিয়েছে। আর গোটা সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর পর যা হবার তাই হলো। নতুন করে বলার কিছু নেই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণআন্দোলন ও গণবিক্ষোভ অনেক হয়েছে, কিন্তু এবারের মতো বলপ্রয়োগ ও মৃত্যু আগে কখনো ঘটেনি। এবার কেবল আন্দোলন সফল হয়নি, পুলিশ-সিভিল-আইন প্রশাসনের দলবাজিসহ করুণ দুর্গতিও ধরা পড়েছে। ভয়াবহ সব ঘটনা লুকানো বা আড়াল করা বা কোনো দোহাই দেয়ার সুযোগ নেই। বরং সুযোগ আছে শুধরানোর।
ছাত্ররা সেই সুযোগটা এনে দিয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপিসহ বিরোধীরা বহু আন্দোলন করেও ক্ষমতাসীনদের একচুল টলাতে না পারলেও ছাত্ররা একটা ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ ও দাবানল সৃষ্টির মাধ্যমে তা পেরেছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে ছাত্রদের আন্দোলনকে মূলধন করে। ছাত্ররা নিরপেক্ষ লোক হিসেবে বিশ্ববরেণ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এসেছে। তার সামনে এখন অনেক দায়িত্ব। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার উপদেষ্টারা বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই শপথ নিয়েছেন। বর্তমানে সংবিধানে অন্তর্বর্তী, মধ্যবর্তী কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান না থাকলেও রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে এরকম একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায় বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ এমনকি সর্বোচ্চ আদালতও স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত শপথবাক্য পাঠ করেছেন। যেমন তারা শপথে বলেছেন: ‘আমি সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব। (তৃতীয় তফসিল, ১৪৮ অনুচ্ছেদ)।’ তার মানে তারা প্রত্যেকে বিদ্যমান সংবিধান রক্ষারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সরকারে, শাসনে, ক্ষমতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্তূপীকৃত বিশাল জঞ্জাল সাফ করা তার দায়িত্ব। এটি বিশাল সংস্কারযজ্ঞ। সেইসঙ্গে নতুন কিছু গড়ার বিষয়ও আছে। অভ্যুত্থানেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পলায়ন করেছেন এবং জনগণ ছাত্রদের বৈধতা দিয়েছে। এটা নির্বাচনের বিকল্প। এই বিকল্পটা সাময়িক। সময়টা কত দীর্ঘ হবে, তাও জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। জনগণের ইচ্ছা, আগের সরকার যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, সেগুলোর ন্যূনতম মেরামত না হওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। নির্বাচন ব্যবস্থা পরিপক্ব হওয়ার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। আবার ব্যবস্থা ঠিক হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত নির্বাচন করা না গেলে তার ফলও শুভ হওয়ার লক্ষণ নেই।
নির্বাচনের আগে কতটুকু সংস্কার করা যাবে, তাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নির্বাচন ও সংস্কার পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। সংস্কার না করলে নির্বাচন হবে না, আবার নির্বাচন না করলে পূর্ণ সংস্কারের কর্তৃত্ব পাওয়া যাবে না। এখন তাহলে শুরুটা হবে কোত্থেকে? সংস্কারের শুরুটা আসলে হয়ে গেছে। আর সেটা হচ্ছে অনেকটা প্রশাসন কেন্দ্রিক। তাও অদলবদল। চিহ্নিত দুষ্টদের বাড়ি পাঠানো, আর নির্যাতিতদের দায়িত্বে বসানো। এটি একেবারেই আংশিক এবং মামুলি সংস্কার। গোটা রাষ্ট্রেই সংস্কার দরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটি সব জায়গায় জোরালোভাবে উঠছে। এর মাঝে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সংবিধান সংস্কারকে। কয়েক দিন ধরেই সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন করে লেখার বিষয়টি নিয়ে অ্যাকাডেমিক পরিসরে আলোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এখনই সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে কেন? সংবিধানে বহু সংশোধন হয়েছে। অনেকে মনে করেন, সংবিধান আর সংবিধানের জায়গায় নেই। এর ব্যাপক সংস্কার বা পুনর্লিখন আবশ্যক।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর কল্যাণে আওয়ামী লীগ দায়কে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। তারা তত্ত্বাধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের ওই সাংবিধানিক গর্ভপাতই যতো নষ্টের গোড়া। শেখ হাসিনার সর্বশেষ অপকর্ম ছিল নির্বাহী আদেশবলে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা। অবশ্য সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার সেই প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করেছে। আবার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও তারা আমলে নেয়নি। বাস্তবতা হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শুধু সংবিধান বা এর সংস্কার নিয়ে বসে থাকার অবস্থা নেই। ভঙ্গুর অর্থনীতি, হাটবাজার, শিক্ষা, সবদিকেই কাজ করতে হচ্ছে। এ কাজগুলোও এক একটি সংস্কার। কিন্তু, সংবিধান সংস্কার অনেকটাই অ্যাকাডেমিক বিষয়। তার ওপর সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি জোরালো হচ্ছে কয়েকটি মহল থেকে। সংবিধানের পুনর্লিখন না করলে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সাফ করা যাবে না বলে মত তাদের।
রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের কাজ অবশ্যই জরুরি। নইলে রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, সেগুলোকে কার্যকর করা যাবে না। শুধু অন্তর্বর্তী সরকার সবকিছু করতে পারবে না। সেখানে আন্দোলনকারী, আন্দোলনের সমর্থকদের ভূমিকা রাখতে হবে। সরকার প্রধান হিসেবে একজন সর্বোচ্চ কত মেয়াদে থাকতে পারবেন, সেই প্রশ্নও আছে। একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়েও কথা আছে। ক্ষমতা যাতে এক হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, সেই তাগিদ অনেক দিনের। ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত করার এসব পথ সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করা না হলে ভবিষ্যতে একজনের পর একজন স্বৈরাচার জন্মাতেই থাকবে। সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া এ পথ বন্ধ করা যাবে না।
সংস্কার হোক আর পুনর্লিখনই হোক, সংবিধানের কয়েক জায়গায় পরিবর্তন-পরিমার্জন আনতেই হবে। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতিসহ আরও অনেক অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনা হলেও নতুন অনেক কিছু যুক্ত করা হয়। যেমন: ৭ (ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ (৫০টির বেশি) অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদকেই সংশোধন অযোগ্য ঘোষণার এখতিয়ার কোনো সংসদের নেই। কেননা, পরবর্তী সংসদ যদি দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন করতে চায়, সেই সুযোগ থাকা উচিত। একটি সংসদ আরেকটি সংসদের এখতিয়ার সীমিত বা সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে না।
তাছাড়া কোন সংশোধনীটি গৃহীত হবে কিংবা কোন সংশোধনীটি দেশ ও জনগণের জন্য প্রয়োজন, সেটি নিয়ে বিতর্ক করার মতো শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে থাকতে হয়। গত চার মেয়াদে সংসদে সেরকম কোনো বিরোধী দল ছিল না। বরং ছিল অনুগত বা আজ্ঞাবহ বিরোধী দল। আর সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে গঠিত সংসদের বিরোধী দল ছিল আরও বেশি দুর্বল। এরকম দুর্বল বিরোধী দলসম্বলিত সংসদের সরকারি দল যা খুশি করতে পারে। সংবিধানকে নিজেদের ইচ্ছেমতো এবং নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষমতো সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারে। আওয়ামী লীগ সেটাই করেছে। এ সময়ে প্রশাসন-পুলিশসহ বিভিন্ন সেক্টরে সময়োপযোগী মেরামত করা জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিভোর্সের শুনানি চলাকালে বউকে কাঁধে নিয়ে পালানোর চেষ্টা স্বামীর
মুন্সীগঞ্জে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর তৃতীয় জানাজা সম্পন্ন
‘ইসলামপন্থীদের ফাঁদে ফেলে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে’
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ছিল ইতিহাসের বৃহত্তম হামলা: নেতানিয়াহু
সিলেটের ১২ লাখ টাকা মূল্যের ভারতীয় ক্রীম সহ একটি প্রাইভেটকার আটক : পুলিশের মামলা
উত্তাল পাকিস্তান ইমরান খানের মুক্তির দাবি।
আনারসের পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন শৌখিন পণ্য
গাজা যুদ্ধের বছর পূর্তিতে বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ
এমিরেটস এয়ারলাইন্সে ব্যবহার করা যাবে না পেজার ও ওয়াকিটকি!
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে পাকিস্তানে বিক্ষোভ
বাজার সিন্ডিকেটবাজদের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর হুঁশিয়ারি
পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ইতিহাস! বিনা খরচে জন্মাল টেস্ট টিউব বেবি
গ্রেপ্তারের তালিকায় ৯০ পুলিশ কর্মকর্তা!'
সিরাজগঞ্জে ছাত্র-জনতার মিছিলে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলিবর্ষণকারী আওয়ামী দুর্বৃত্ত আবু মুছা কক্সবাজারে গ্রেপ্তার
সিলেটে আন্দোলনে নিহত ২২ জনের দাফন ময়নাতদন্ত ছাড়াই, লাশ তোলা হবে ৯ জনের
আওয়ামী লীগের শাসনামলে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী নির্যাতন ঢাবিতে : গবেষণা
তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছে রাশিয়া।
বিভিন্ন পক্ষ ইইউ’র অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের বিরোধিতা করে
বন্যায় শেরপুরের অবস্থা ভয়াবহ, মৃত্যু বেড়ে ৭, পানিবন্দী লাখো মানুষ
৭৫ বছর ধরে বিশ্বের শান্তি রক্ষায় কাজ করছে চীন