লেনদেন ভারসাম্যে ঝুঁকি

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:২৪ এএম | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:২৪ এএম

লেনদেন ভারসাম্যে (বিওপি) বাংলাদেশ মাঝারি ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস। প্রতিষ্ঠানটির মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তবে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের ‘বি১’ ঋণমান বহাল রেখেছে মুডিস। গত মে মাসে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ নামিয়ে ‘বিএ৩’ থেকে বি১ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তখন ঋণমান কমানোর কারণ হিসাবে ডলার সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়া, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, বর্ণিত কারণগুলো এখনো বহাল আছে। ডলার সংকট তো এখন তুঙ্গে। ডলারের বাজার এতটাই অস্থিতিশীল যে, বাংলাদেশ ব্যাংক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরও তা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। প্রতি ডলার এখন ১২৭ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ডলারের দাম ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ওদিকে প্রতিনিয়ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উপনীত হয়েছিল। তারপর থেকে ক্রমাগত কমছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যয় সংকোচনÑ কোনো কিছুতেই রিজার্ভে ধস ঠেকানো যাচ্ছে না। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯.৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। রিজার্ভস্থিতির আরো অবনমন ঘটতে পারে। সামনে বড় অংকে বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধ করার কথা রয়েছে। সেটা করলে রিজার্ভ রীতিমত তলনিতে এসে দাঁড়াতে পারে। মুডিস এখন মাঝারি ধরনের ঝুঁকিতে থাকার কথা বলেছে রিজার্ভের চলমান স্থিতি পর্যালোচনা করে। সেটা যদি ১০ বিলিয়ন ডালারে নেমে আসে তবে তা উচ্চঝুঁকিতে পরিণত হবে। লেনদেনে ভারসাম্য উচ্চঝুঁকিতে পড়া হবে বিপর্যয়কর। এছাড়া বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দুর্বলতা কমেছে কিংবা তারল্য সংকটের ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে, এমনটাও বলার উপায় নেই। সুতরাং, পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়।

বহির্বিশ্বের সঙ্গে চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে যে লেনদেন হয়, তার ভিত্তিতে লেনদেনের সামগ্রিক চিত্র উঠে আসে। লেনদেন ভারসাম্যপূর্ণ, না ঝুঁকিপূর্ণ তখনই নির্ণীত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, বর্তমানে সামগ্রিক লেনদেনে ভারসাম্য নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। চলতি অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ২৮৫ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল। রফতানি বাড়ানোর মাধ্যমে ঘাটতি মোকাবিলা সম্ভবপর। কিন্তু আমাদের রফতানিপণ্যের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য এত কম যে, চাইলেই রফতানি ও রফতানি আয় বাড়াতে পারি না। মুডিস বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার ৪টি দেশের মধ্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য রফতানি করায় তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে আছে ভারত। পক্ষান্তরে, রফতানি কিছু সংখ্যক পণ্যে সীমিত হওয়ার কারণে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ ঝুঁকিতে রয়েছে। অতএব, লেনদেন ভারসাম্যে ঝুঁকি কাটাতে হলে রফতানিপণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। বহির্বিশ্বে ভালো বাজার আছে, এমন পণ্যের উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে হবে। মুডিস লেনদেন ভারসাম্যে ঝুঁকির যে কারণটি উল্লেখ করেছে, সেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হলে রফতানিপণ্যে বৈচিত্র্য ও রফতানি বৃদ্ধি অপরিহার্য। আমাদের দেশে আমদানি, রফতানি ও অন্যান্য লেনদেন যেহেতু ডলারে হয়ে থাকে, কাজেই ডলারের আগম বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রফতানি ছাড়াও ডলার আগমের বিবিধ উৎস রয়েছে। রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক সহায়তার কথা এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। উদ্বেগজনক হলেও বলতে হচ্ছে, রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে, বৈদেশিক বিনিয়োগ তেমন একটা আসছে না এবং বৈদেশিক সহায়তায়ও টান দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায়, ডলার আগমের উৎসগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যাতে আগম বেশি হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশের লেনদেন ভারসাম্যে ঝুঁকির বড় কারণ হিসাবে ক্রমাগত রিজার্ভ কমে আসাকেই দায়ী করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি উল্লেখ করেছেন, রিজার্ভের দুটি দিক: একটি লেভেল, অন্যটি নির্দেশনা। এখন রিজার্ভ লেভেল কম। এটা ঠিক রাখতে গত দেড় বছরে সার্বিক নির্দেশনা আসেনি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে রিজার্ভ ৪/৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেছেন। তার মতে, এ আশংকা নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সার্বিক নির্দেশনা দিতে হবে এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। দেশের সার্বিক অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। এমন কোনো সূচক নেই, যাকে ঊর্ধ্বমুখী বলে অভিহিত করা যায়। অর্থনীতিবিদরা একটা প্রায় দেউলিয়া অর্থনীতিই এখন প্রত্যক্ষ করছেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ক’দিন আগে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক রিজার্ভ পরিস্থিতির সঙ্গে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির মিল লক্ষ করছেন। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, দেশের অর্থনীতি এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। তিনি তার ৩৬ বছর কর্মজীবনে এতো বড়ো অর্থনৈতিক সংকট দেখেননি বলে মন্তব্য করেছেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির আশংকা করা হচ্ছে, গার্মেন্টশিল্পে এখন যে আন্দোলন-সংগ্রাম-কারখানা বন্ধের পরিস্থিতি চলছে, তাতে অর্থনীতি মারাত্মক বিপর্যয়কর পর্যায়ে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্রুত রাজনৈতিক সংকট মোচন এবং শান্তি, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতি নির্মাণে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

সাভারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কেউ ছাত্র ছিল না

সাভারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কেউ ছাত্র ছিল না