রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে অস্বস্তিতে সাধারণ মানুষ

Daily Inqilab মুহাম্মদ শাহ আলম

১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম

সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে নেই। এক অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ইত্যাদি কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনে কষ্টের মধ্যে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ডলারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। খোলা বাজারে ডলারের দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ ১২৮ টাকায় পৌঁছেছে। গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে, এক দফা দাবিতে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর লাগাতার আন্দোলন হরতাল, অবরোধে সহিংস ঘটনায় প্রাণহানি, মামলা, হামলা, গ্রেফতার ইত্যাদি কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। সাথে যুক্ত হয়েছে মানুষের আর্থিক দূরাবস্থা। সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাপন দুরুহ হয়ে পড়েছে। বাজারের প্রতিটি নিত্য পণ্যের দাম নাগালের বাইরে। চাল, ডাল, তেল, ব্রয়লার মুরগি, চিনি, লবণ, আটা-ময়দাসহ সব পণ্যই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। এর আগে দফায় দফায় বেড়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের দাম। ওষুধের দামও বেড়েছে।

দ্রব্যমূল্যের এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয় বৈশ্বিক মহামারী করোনা পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল গ্যাসসহ আমদানি নির্ভর বিভিন্ন পষ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরবর্তীত কমেছে। দেশে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্ট সেক্টরের শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। আন্দোলনে গত ৩০ অক্টোবর আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে অন্তত দুইজন নিহত এবং প্রায় ৪০ জন আহত হয়। এতে বেশ কিছু কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার, যা আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। এই সাড়ে ১২ হাজার টাকায় সংসার চালানো সম্ভব হবে না দাবি করে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মজুরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। তাদের এই দাবি আদায়ের জন্য গত ৮ নভেম্বর গাজীপুরে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে আনজুয়ারা নামে এক নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

দেশের এই পরিস্থিতি মাঝেই মানুষের অভাব অনটন নিয়ে কথা বলছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি গত ৮ নভেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি মনিটরিং ও রিভিউ কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তার এলাকার মানুষের কষ্ট নেই। আজ থেকে ২০ বছর আগে আমার এলাকায় ১০টা মোটরসাইকেল ছিল। তখন আমি প্রথম নির্বাচন করি। আজ সেখানে হাজার হাজার মোটরসাইকেল। সেখানকার নারীরা দিনে তিনবার লিপস্টিক লাগাচ্ছে। চারবার করে স্যান্ডেল বদলাচ্ছে। আমি খুব ভালো জানি, আমার কোনো সমস্যা নেই। এদিকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপি মহাসমাবেশ করে। বিএনপি সমাবেশ বানচালের প্রতিবাদে ২৮ অক্টোবর সমাবেশ থেকেই পরের দিন ২৯ অক্টোবর বিএনপি সকাল সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। হরতালের দিন সকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর টানা তিন দিন অবরোধ পালনের পর শুক্র ও শনিবার বিরতি দিয়ে পুনরায় ৫ ও ৬ নভেম্বর অবরোধ পালনের করে। পরবর্তীতে এক দিন ৭ নভেম্বর বিরতি দিয়ে আবারও ৮ ও ৯ নভেম্বর অবরোধ পালন করে এবং চতুর্থ দফা ১২ও ১৩ নভেম্বর অবরোধ পালন করে। গত ৭ নভেম্বর দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ৫৫৫৯ জন বিএনপির নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা দায়ের হয়েছে ১৩২টি। আহত হয়েছেন ৩৫১৮ জন। আওয়ামী লীগের হামলা ও পুলিশের গুলিতে একজন সাংবাদিকসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসসহ আট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। গত ৬ নভেম্বর এক বিবৃতিতে সংগঠনগুলো বাংলাদেশের চলমান বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন ও বিক্ষোভে সহিংসতা এবং গ্রেপ্তার নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ অবস্থা ধারণ করেছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করা এবং বিরোধীদলগুলোর একদফা সরকার পতনের লক্ষ্যে লাগাতার চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকারের দমন পীড়ন, মামলা, গণগ্রেফতার ইত্যাদি বিষয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত তাদের মতামত পরামর্শ তুলে ধরছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বিবৃতি প্রদান করছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম বাংলাদেশর পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত-যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। পঞ্চম টু প্লাস টু বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা অংশ নেন। বৈঠকে অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কাত্রা বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে বৈঠক শেষে দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নেই। বিনয় কাত্রা মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। উভয় পক্ষই বাংলাদেশের বিষয়ে ¯পষ্টভাবে তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। আমরা বাংলাদেশ স¤পর্কে খুব ¯পষ্টভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেছি। মার্কিন মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার সময় আমরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি কীভাবে মূল্যায়ন করি তা ¯পষ্টভাবে জানিয়েছি, এই আলোচনায় বাংলাদেশের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি বলেন, তৃতীয় কোনো দেশের নীতি নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারি না। আমি মনে করি, যখন বাংলাদেশের উন্নয়ন বা নির্বাচনের কথা আসে, তখন এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার।

আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। নির্বচন কমিশন সকল প্রস্তুতি স¤পন্ন করেছে। অথচ বিএনপিসহ আন্দোলনরত বিরোধীদলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তার আতংকে বাড়িঘর, পরিবার ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে লাখ লাখ বিএনপির নেতাকর্মী। তাদের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য, আয় রোজগারের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের লোকজন মানসিক দুশ্চিন্তা ও অর্থনৈতিক কষ্ট নিয়ে দিনাতিপাত করছে। সন্তানদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠায় রয়েছে। রাজনীতির মাধ্যমে দেশ ও জনগণের সেবা করার মানসিকতা নিয়ে বিরোধীরাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করে এখন জনসেবা দূরে থাক নিজের পরিবারের সেবা করার সক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলছে।

লেখক: আইনজীবী


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

সাভারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কেউ ছাত্র ছিল না

সাভারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কেউ ছাত্র ছিল না