ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২ আশ্বিন ১৪৩১

বাংলাদেশের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে কেন ফুঁসে উঠেছে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম

বাংলাদেশের মানুষ নানা কারণে ভারতের ওপর অতিশয় বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। এর কিঞ্চিৎ প্রকাশ ঘটেছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের শোচনীয় পরাজয়কে উপলক্ষ করে। ভারতের পরাজয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ খুশি হয়ে আনন্দ-উল্লাস করেছে, মিছিল করেছে, মিষ্টি বিতরণ করেছে। এ খবর দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রধানত ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তার নেতাকর্মীরা বেজায় অসন্তুষ্ট হয়েছে। তারা বাংলাদেশ ও তার জনগণকে তীব্র ভাষায় কটুকাটব্য করেছে। হুমকি-ধমকি দিতেও ছাড়েনি। বাংলাদেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া ক্রিকেটের বিরুদ্ধে নয়, তা প্রতিটি ভারতীয়ই জানে। কিন্তু কেন এই প্রতিক্রিয়া, সেটা তারা অনেকেই গভীরভাবে খতিয়ে দেখে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার কথা ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশের মানুষ সেই সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করে। কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতের গৃহীত নীতি, আচরণ ও কর্ম খুব কমই বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, স্বাধীনতার পর পরই এখানে একটি ভারতনিয়ন্ত্রিত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছিল ভারত। ভারত থেকে অনেক কর্মকর্তা তখন এখানে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ এটা ভালোভাবে নেয়নি এবং হতেও দেয়নি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সোনাদানা, বহনযোগ্য সম্পদ, অস্ত্র-শস্ত্র, গোলারুদ ইত্যাদি লুট করে ভারতে পাচার করার একটা উৎসব হয়েছিল। তখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালামাল ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই নির্বিচার লুণ্ঠন প্রতিরোধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল। এজন্য তাকে আটক করে কারগারে পর্যন্ত নিক্ষেপ করা হয়েছিল। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের আত্মসমর্পণের দলিল ও অনুষ্ঠানে উপস্থিতি নিয়েও অনেক কথা আছে। এক্ষেত্রেও এদেশের মানুষের প্রশ্ন ও অসন্তুষ আছে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ভারত যা কিছুই করেছে, তার প্রায় সবই বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত পরশু কেন বাংলাদেশের জনগণ ভারত সরকার ও তাদের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে তার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সমর্থন করে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই সঙ্গে তিনি সীমান্তে বাংলাদেশ হত্যা, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বৈষম্য ও বাংলাদেশিপণ্য প্রবেশে বাধাদান, নানা উপায়ে হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। সম্প্রতি দিল্লিতে ৯০টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠকের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন রিজভী। বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন করেছেন, বাংলাদেশে কি সেই সব দেশের দূতাবাস নেই? দিল্লিতে গিয়ে বৈঠক করতে হবে কেন? ভারত কেনই বা আয়োজন করেছিল? এসব প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর নেই। বিএনপিকে ধন্যবাদ, তার পক্ষে রুহুল কবির রিজভীর এমন সময়োচিত ও যৌক্তিক বক্তব্য রাখার জন্য। দেশ ও জনগণের পক্ষে এরূপ বক্তব্যই কাম্য ও স্বাভাবিক।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বাদে তার কোনো প্রতিবেশীরই সম্পর্ক ভালো নেই। তার আগ্রাসী নীতি, প্রশ্ন সাপেক্ষ আচরণ ও অপকর্মই এর প্রধান কারণ। নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল ওতপ্রোত। ভুটানের সঙ্গেও। এখন সে সম্পর্ক নেই। শ্রীলংকার সঙ্গে সম্পর্কও আগের মতো নয়। এই তিন দেশে ভারতের অবস্থান নিয়েছে চীন। পাকিস্তান তো ভারতের আজন্ম বৈরী। মালদ্বীপও ভারতের অসহ্য বন্ধন ছিন্ন করেছে, চীনের পক্ষে গেছে। মোহাম্মদ মুইজ্জু ‘আউট ইন্ডিয়া’, এই শ্লোগান দিয়েই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাজিমত করেছেন। সে দেশের ভোটাররা ভারতকে আউট করে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ‘প্রতিবেশী আগে’ এমন অভিপ্রায় জানিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেশী একে এনে পেছনে চলে গেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক টিকে থাকার কারণ হিসাবে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। তাদের ক্ষমতায় আনা ও ক্ষমতায় ধরে রাখার জন্য ভারত বা মোদি সরকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ সবকিছুই করে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা সেই কৃতজ্ঞতায় ভারতান্ধতা প্রদর্শন করছে। ক্ষমতাসীনরা জনগণকে তোয়াক্কা করছে না। ভারতও এ দেশের মানুষের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার কোনো মূল্য দিচ্ছে না। বাংলাদেশে ভারতের প্রকাশ্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অন্তত দেড় দশক ধরে চলছে। এখনো তা জোরদার। চোখ-কান খোলা রাখলেই বুঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সচেতন কোনো মানুষই তা পছন্দ করে না। ভারতের অর্থনৈতিক আগ্রাসন, বাণিজ্যেক অধিপত্য যেভাবে বাড়ছে সেটাও কারো পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এখানকার এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি তাদের শিল্প ও ব্যবসা একে একে তুলে দিচ্ছে ভারতের হাতে। এর চেয়ে আত্মঘাতী কাজ আর কিছু হতে পারে না।

সবকিছু ভারতের হাতে তুলে দিতে সরকারও তৎপর। ভারতের এমন কোনো চাওয়া নেই, যা সরকার স্বতঃস্ফুর্তভাবে দিচ্ছে না। পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, ভারত এখন বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ। গার্মেন্টসহ শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারক পদে ভারতের আধিপত্য আগেই প্রতিষ্ঠিত। বাণিজ্য সর্ম্পূণভাবে তার অনুকূলে। ট্রানজিটের নামে ভারতকে করিডোর দেয়া হয়েছে। বন্দর রেল, সড়ক ও নৌপথ ব্যবহারে প্রাধান্য স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ হয়নি। বাণিজ্য বৈষম্য কমেনি। বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি কার্যত পরিত্যক্ত হয়েছে। এমতাবস্থায়, ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে খুশি বা সন্তুষ্ট থাকতে পারে? ভারতের সরকার রাজনীতিবিদ ও বিদ্ব্যত সমাজের এটা উপলব্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মালিক এর জনগণ। কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্য কেউ নয়। জনগণ ফুঁসে উঠেছে মাত্র। ফেটে পড়লে কী হবে, কেউ বলতে পারে না। তখন সব ধরনের আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ, শৃংখল চুরমার হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সুবিধা, ফ্রি ট্রানজিট, ফ্রি করিডোর, সহজে যাতায়াত কিছুই থাকবে না। আশংকার এই প্রেক্ষাপটে ভারতের উচিত, বাংলাদেশের সঙ্গে সার্বভৌম সমতাভিত্তিক নীতি অনুসরণ করা, দু’ দেশের জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় জোর দেয়া, সৎ প্রতিবেশীসূলভ আচরণ করা এবং সব ধরনের হস্তক্ষেপ ও আধিপত্য বিস্তার থেকে বিরত থাকা। মালদ্বীপ একটা নজির স্থাপন করেছে। ভারতের সরকার ও রাজনীতিবিদদের সেটা স্মরণ রাখতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী