ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২ আশ্বিন ১৪৩১

ভারতের অন্যায্য প্রভাব বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দেশের অন্তত ৭০ ভাগ মানুষ হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও ব্যাপক ধরপাকড় ও গণগ্রেফতার করে বিরোধীদলের রাজনৈতিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও আন্দোলন দমনে কাজ করে চলেছে। গত দেড় দশকে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের অন্তত তিনকোটি ভোটার বিগত দুইটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনে সরকারের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে মাঠের বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্য দিয়ে জনগণের সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করে এ ধরণের উন্নয়নের টোপ গিলিয়ে ক্ষমতাসীন রিজিমের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রোপাগান্ডা অতীতেও কোনো কাজে আসেনি। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের উন্নয়নের দশকের প্রচারনা, এরশাদের উন্নয়নের প্রচারনা এবং শেখ হাসিনার উন্নয়নের প্রচারনা প্রায় একই ধরণের পরিনতির দিকে ধাবিত হতে দেখা গেছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বহু আগে থেকেই এই নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য এবং সুষ্ঠু করতে এক ধরণের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা। বিগত প্রায় এক বছর ধরে মার্কিন কূটনীতিকদের ধারবাহিক তৎপরতার সর্বশেষ ধাপটি ছিল, দ্বাদশ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি শর্তহীন সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র চিঠি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড লু’র এই চিঠি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাৎক্ষণিকভাবে নিজে গিয়ে এসব দলের শীর্ষ প্রতিনিধিদের হাতে হস্তান্তর করেছেন। অবশ্য বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের সবাই কারারুদ্ধ থাকায় বিএনপি’র চিঠি অনলাইনে পাঠানো হয়েছিল বলে জানা যায়। ক্ষমতাসীনরা অঘোষিত প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য চাপ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে ডোনাল্ড লু’র চিঠি হাতে পাওয়ার একদিন পরই ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে কার্যত একটি অংশ্রগহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রত্যাশা ও আহ্বানকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের সত্তুর শতাংশ মানুষের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল এবং পশ্চিমা উন্নয়ন অংশীদারদেরকে ঘোষিত তফসিলের বিরুদ্ধে একটি কঠোর অবস্থান গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরে বিএনপি’র মহাসমাবেশ ঘিরে সরকারী দল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর যৌথ তৎপরতা এবং নাশকতামূলক ঘটনাগুলোকে ব্যবহার করে বিএনপির উপর ক্র্যাকডাউন ও গণগ্রেফতারের মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য একপাক্ষিক নির্বাচনব্যবস্থাকে নির্বিঘ্ন করার প্রক্রিয়াটি দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অনেকটা খোলাসা হয়ে গেছে। ঘটনার ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই বিএনপি’র সমাবেশে সরকারি দলের মুখোশধারিদের হামলা, নাশকতা ও ক্র্যাকডাউনের বিষয়টি জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে উঠে এসেছিল। এর আগেই সরকারের পক্ষ থেকে দেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের মিশন প্রধানদের নিয়ে একটি প্রেস ব্রিফিং করা হয়েছিল। সেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের নিরবতা ছিল সরকারের জন্য বিপরীত বার্তা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও পশ্চিমা দেশগুলোর তরফে একাধিকবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ উচ্চারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, ইসলামি আন্দোলনসহ মাঠের রাজনৈতিকদলগুলো ধারাবাহিকভাবে হরতাল অবরোধ কর্মসূচি পালন করে চলেছে। ব্যাপক ধরপাকড় এবং শত শত নেতাকে আদালতের মাধ্যমে রাজনৈতিক মামলায় রাতারাতি কারাদন্ড দিয়েও আন্দোলন দমাতে পারছে না সরকার।

বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর গেম প্লানের অংশে পরিনত হতে দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এখানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সবেচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। বিগত এক-এগারোর পটভূমি রচনার পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের সংঘবদ্ধ তৎপরতা, বিশেষত বিরোধীদল আওয়ামী লীগের রাজপথে রক্তাক্ত সহিংসতার ঘটনার প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ঢাকাভিত্তিক ডিপ্লোম্যাটদের অনানুষ্ঠানিক সংগঠন টুইসডে ক্লাবের তৎপরতায় দেশে এক-এগারোর জরুরি শাসন জারি হয়। বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ২০০৬-২০০৭ সালের চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ওয়ার অন টেররিজমের বাস্তবতা এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় কৌশলগত মিত্র হিসেবে ভারতের প্রভাবকে কাজে লাগাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাগ্য ভারতের অনেকটাই ভারতের উপর অর্পণ করেছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারতের শাসকরা বাংলাদেশের গণমানুষের প্রত্যাশা ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে অপরিনামদর্শী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল। সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদকে দিল্লীতে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে ঘোড়া উপহার দেয়ার মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভাগ্য দিল্লীতেই নির্ধারিত হয়েছিল বলে জানা যায়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচনের আগেই আদালতের একটি খণ্ডিত রায়কে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন বাতিল, রাষ্ট্রীয় জরুরি রাজনৈতিক প্রয়োজনে রেফারেন্ডামের আইন বাতিল করে ক্ষমতাসীনদের একক কর্তৃত্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে অন্তত ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে যা যা করণীয় তার সবই সম্পন্ন করা হয়েছে। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এবং দেশের সাথারণ মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রেক্ষাপটে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল। সে সময় দিল্লী থেকে উড়ে এসে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সূজাতা সিংয়ের নগ্ন হস্তক্ষেপের নাটকীয় ঘটনাবলী এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সুস্থ এরশাদকে অসুস্থ্য সাজিয়ে সিএমএইচ হাসপাতালে পাঠানোর পরও তিনি নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলেন। তিনি এক সময় আত্মহত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন। নির্বাচনকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে জিম্মি করার পরও ১৫৪টি আসনে কোনো প্রার্থী না থাকায় এসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে নির্বাচন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তারা রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনায় আরেকটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিরোধীদলের সাথে সমঝোতা করে একটি নতুন নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। দৃশ্যত: শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের অনিবার্য নির্ভরতা এবং বিএনপি-জামায়াতের প্রতি অনাস্থার কারণেই কোনো রাজনৈতিক সংলাপ সমঝোতা সম্ভব হয়নি। দশম জাতীয় নির্বাচনের পর প্রথমে পিলখানা ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে দেশের সেনাবাহিনীতে এক ধরণের ভারসাম্যহীনতা তৈরী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে দেশের পুলিশ বাহিনী এবং র‌্যাবকে অনেকটা দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মত ব্যবহারের পাশাপাশি বিচার বিভাগে দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনগত নিরপেক্ষ ভূমিকা চরমভাবে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি দেশের বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টদেরও ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার ঘোষনা দিয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট।
বাংলাদেশ ও ভারত একটি অবিচ্ছিন্ন ভূপ্রকৃতি তথা সাগর, নদী, পাহাড় ও অববাহিকা দ্বারা শৃঙ্খলিত। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে মানচিত্র ও পতাকার পরিবর্তন হলেও অবিভাজ্য ভূপ্রকৃতি ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের বন্ধনকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বহুভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গঠিত একটি মাল্টিকালচারাল রাষ্ট্র হিসেবে অখণ্ডতা ও আঞ্চলিক মর্যাদা বজায় রাখতে তার ঐতিহাসিক দায় মোচনে যে ভূমিকা রাখার কথা তা পালনে ভারত পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের শাসকরা কখনো এ দায় অস্বীকার করতে পারেনি। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার এবং দিল্লীতে সরকার গঠনের প্রাক্কালে ভারত প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের যে বার্তা দিয়েছিল, বাস্তবে তাদের ভূমিকা এবং ফলাফল ঘটেছে বিপরীত। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ নীতি সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে ভারতের অভ্যন্তরে প্রতিবেশী মুসলমান সম্প্রদায়কে অস্তিত্বের সংকটের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং জেনোসাইড ওয়াচ ভারতে একটি মুসলিম গণহত্যার আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছে। সেই সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের অসহযোগিতামূলক মনোভাব শেষ পর্যন্ত একটি বৈরীতাপূর্ণ সম্পর্কের উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এক সময় বিশ্বের একমাত্র ঘোষিত হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল, কিংবা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, কিংবা ভারতবেষ্টিত ক্ষুদ্র দেশ ভূটানের সাথেও ভারত আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাতের সময় এসব দেশকে স্পষ্টভাবেই চীনের পক্ষাবলম্বন করতে দেখা গেছে। সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর আয়তন, ভূরাজনৈতিক, বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং সামরিক ও কৌশলগত ভূমিকার ক্ষেত্রে অনেক বেশি পার্থক্য থাকলেও প্রতিবেশী দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আস্থা, সহযোগিতা ও মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবেশী কিংবা পরাশক্তি দেশ যত বড় কিংবা শক্তিশালী হোক, একটি জাতিরাষ্ট্র অন্যদেশের দাদাগিরি মেনে নিতে পারেনা। বিশাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা আশি বছর ধরে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে টিকে থাকার পেছনে একদিকে জাতীয় ঐক্য ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মত দৃঢ় নেতৃত্ব অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধে বিভক্ত দুই পরাশক্তির একটি সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পষ্ট অবস্থান এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সীমান্তে একটি পরাশক্তি চীনের সক্রিয় ভূমিকা না থাকলে ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের সাথে দিল্লীর ভূমিকা কেমন হতো, তা সহজেই অনুমেয়। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিলেও বাহ্যত ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, প্রতিবেশিদের সাথে দাদাগিরি এবং প্রভাব বিস্তারের নীতির কারণে উপমহাদেশের আঞ্চলিক সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। গত দুই দশকে নেপালের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ড, পাকিস্তানের সাথে ভারতের বৈরীতা বৃদ্ধি, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ থেকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষমতার পটপরিবর্তন, মালদ্বীপের নির্বাচনে চীনপন্থী শক্তির বিজয় লাভ, বাংলাদেশে ধারবাহিকভাবে একতরফা নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকির পেছনে ভারত মূল ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল নয়, দিল্লীর সাউথ ব্লকের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকেই এর জন্য দায়ী করা যায়। কংগেসের প্রধানমন্ত্রী মনোমোহন সিংয়ের সময় সুজাতা সিং ঢাকায় যে ন্যাক্কারজনক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটনার জন্ম দিয়েছিল, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সেই ভূমিকার বাস্তব কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই গণতন্ত্রের জন্য ধারবাহিকভাবে সংগ্রামরত বাংলাদেশের মানুষ কোনো আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক পরাশক্তির দাদাগিরিকে সহজে মেনে নেয়না। স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমুহের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতের নেতিবাচক ভূমিকা অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। আন্তর্জাতিক নদী আইনের বাধ্যবাধকতা অগ্রাহ্য করে আন্ত:সীমান্ত নদীর উপর একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার ধারাবাহিক ঘটনাক্রম বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষকে ভারত বিদ্বেষী করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এতকিছুর পরও বাংলাদেশের সমাজে ভারত বিদ্বেষ তেমন প্রকট হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান এবং ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নিয়ে বাংলাদেশের সমাজে ও রাজনীতিতে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়াশীল জনমত গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষের গণদাবিকে অগ্রাহ্য করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের বশংবদ ভূমিকার কারণে বিগত তিনটি একতরফা জাতীয় নির্বাচনে ভারতের নেপথ্য ভূমিকা এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে যে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে তা একটি ভারত বিদ্বেষের অভিঘাত হয়ে দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়। যদিও দুই দেশের সরকার প্রায়শ: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অভিনব উচ্চতার কথা বলেন; তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে টালবাহানা, বিএসএফ’র হাতে সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যার ঘটনা, সীমান্ত বাণিজ্যের একতরফা নিয়ন্ত্রণের সুযোগে কোনো ঘোষণা ছাড়াই যত্রতত্র পণ্য রফতানি বন্ধ করা কিংবা পণ্যের রাজস্ব বৃদ্ধির মত ঘটনাগুলো বাংলাদেশের জনজীবনে বড় ধরণের প্রভাব সৃষ্টি করে। করোনাকালে সারাবিশ্ব যখন যতটা সম্ভব দ্রুত করোনার টীকা পেতে মরিয়া হয়েছিল, তখন বিশ্বের অন্যতম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি করে সাড়ে তিন কোটি ভ্যাকসিনের মূল্য অগ্রিম গহণ করার পরও বাংলাদেশকে টীকা দেয়নি ভারত। এসব ঘটনা একটি প্রতিবেশী দেশের সাথে ভারতের সম্প্রীতি- বৈরিতা কিংবা প্রবঞ্চনার সম্পর্কের পারদ পরিমাপ করার জন্য যথেষ্ট। বিভিন্ন সময়ে ভারতের উদার গণতন্ত্রপন্থী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশাকে অগ্রাহ্য করে অগণতান্ত্রিকভাবে একটি বিশেষ দলকে ক্ষমতায় রাখতে ভারতের অন্যায্য ভূমিকার বিষয়ে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করতে শোনা গেছে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও বাণিজ্যের গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি হচ্ছে, রাষ্ট্রসমুহের পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নে সবচেয়ে কার্যকর ও টেকসই উপায়। সেসব বাস্তবতা উপেক্ষা করে ভারতের শাসকরা দুর্বল ও জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক গোষ্ঠিকে সমর্থন দিয়ে একতরফা স্বার্থ হাসিলের মওকা খুঁজেছেন। যেখানে বাংলাদেশের প্রায় আশিভাগ মানুষের দাবির সাথে একাত্ম হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় বের করার কথা বলছে, তখনো আরেকটি একতরফা নির্বাচনের পথে শেখ হাসিনার মরিয়া হয়ে অগ্রসর হওয়ার নেপথ্যে ভারতের গোপণ গ্রিন সিগনালকেই দায়ী করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে ভারতের সিগন্যাল পেয়ে বেপরোয়া হয়ে আরেকটি একতরফা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বহুমাত্রিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হওয়ার মত অনেক বড় ঝুঁকির মুখে পড়ার সমুহ আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আইসিসি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের পরাজয়ে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক তরুন ক্রিকেট দর্শককে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এ নিয়ে দুই বাংলার নেটিজনদের মধ্যে তীব্র অপ্রীতিকর বাদানুবাদ দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর নেটিজনদের কেউ কেউ বাংলাদেশিদের বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক, ও হিন্দু বিদ্বেষ হিসেবে আখ্যায়িত করতে দেখা গেছে। এরা বাংলাদেশে চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারছে না। গত ১৫ বছরে অন্তর্ভুক্ত তিনকোটির বেশি নতুন ভোটার বিগত দুইটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। এ সময়ে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণের কারণে দেশের অর্থনীতি কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে দেশের বিরোধীদল সমর্থক লাখ লাখ নেতাকর্মী রাজনৈতিক কারণে ঘরবাড়ি ছেড়ে ফেরারি জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে আদালত ও পুলিশি শক্তি দিয়ে দমনের চেষ্টা সরকারের জন্য বুমেরাং হতে পারে। এহেন বাস্তবতা উপলব্ধি করে সম্প্রতি ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সম্পাদকীয় কলামে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থে একতরফা নির্বাচনের পথে শেখ হাসিনাকে থামানো উচিৎ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উন্নয়নে বাংলাদেশের জনপ্রত্যাশার সাথে পশ্চিমাদের পাশাপাশি ভারতের অবস্থান কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠি কেন্দ্রিক না হয়ে জনগণের পক্ষে হলে তা অনেকটাই সহজ হতে পারে। তা না হলে রাজপথে সহিংস আন্দোলন এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশ। এর কোনোটিই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাম্য নয়। ভারতও কি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করে। একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে তাদের সর্বশেষ ভূমিকা দেখার অপেক্ষায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষ এবং পশ্চিমা বিশ্ব।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী