পাহাড়ে শান্তি এখনো অধরা
০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু স্বাক্ষরের ২৬ বছর পরেও চুক্তিটি জাতীয় রাজনৈতিক দল এবং উপজাতি গোষ্ঠিগুলির মধ্যে আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিস্থিতি দ্বন্দ্ব এবং সমঝোতার একটি জটিল মিশ্রণ। অঞ্চলটি এখনো ছোট ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠির মধ্যে উত্তেজনা, প্রতিবেশী রাজ্যগুলির হস্তক্ষেপ, চরম দারিদ্র্য, সম্পদের ঘাটতি এবং নিম্ন সাক্ষরতার হার দ্বারা বেষ্টিত।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকে দেশের অনেক অর্জনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য চুক্তি’ তথা শান্তিচুক্তি। এ চুক্তির জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠি সক্রিয় থাকার কারণে সহিংসতার প্রবণতা বেড়েছে। বন ও পাহাড়ঘেরা এই অঞ্চলে চারটি জাতিগত রাজনৈতিক দল: পিসিজিএসএস, জনসংহতি সমিতি, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) রয়েছে। তাদের মধ্যে আদর্শগত মতবিরোধ তেমন একটা নেই। কিন্তু সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য দলগুলো আন্তঃসংঘাতে লিপ্ত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মতে, পাহাড়ে সব দলেরই রকেট লঞ্চার, স্বয়ংক্রিয় স্নাইপার রাইফেল এবং ভারী মেশিনগানের মতো উন্নত অস্ত্রসহ নির্দিষ্ট সশস্ত্র শাখা রয়েছে। তারা কাঠের ব্যবসা, বাজার, গবাদি পশু, পরিবহন, এবং অন্যান্য বিভিন্ন পরিষেবায় চাঁদাবাজি করে। অপহরণের মাধ্যম মুক্তিপণ আদায়ও তাদের আয়ের একটি বড় উৎস। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠির দ্বারা স্থানীয় মহিলাদের অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগও রয়েছে। ঠিকাদারদেরও দিতে হয় মূল বাজেটের ১০ শতাংশ হারে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে আন্তঃগোষ্ঠি সংঘর্ষে ১১০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী গেরিলাদের আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র সমর্পণ করার কথা থাকলেও অনেকেই এখনো অস্ত্র সমর্পণ করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো সম্প্রতি নতুন করে অস্থির হয়ে উঠেছে। সেখানে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চলছে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠির মধ্যে হত্যা এবং পাল্টা হত্যাকাণ্ড চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার মধ্যে বেশি অস্থিরতা দেখা যায় বান্দরবানে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সেখানে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের সাথে একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করে এবং কঠোর সশস্ত্র আন্দোলনের হুমকি দেয়। এর আগে, ইউপিডিএফ শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। ১৯৯৭ সালে যখন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল, তখন পাহাড়ে অনেক ছোট ছোট গ্রুপ থাকলেও কুকি-চিনের মতো গোষ্ঠিগুলো তখন ততোটা গুরুত্ব পায়নি। তাদের দাবি-দাওয়াও পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি অনেকটা হঠাৎ করেই কুকি-চিনের মতো গোষ্ঠিগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে চাপের বিষয় হলো উপজাতীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে ব্যাপক খ্রিস্টানকরণ। উন্নয়ন অংশীদারদের ছত্রছায়ায় কাজ করা বেশ কয়েকটি এনজিওর মাধ্যমে মিশনারিরা সাধারণত ধর্মীয় প্রচারণা সম্পন্ন করে। খ্রিস্টান মিশনারিরা অর্থ এবং অন্যান্য জাগতিক ফাঁদ ব্যবহার করে দরিদ্র উপজাতিদের খ্রিস্টান হওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে গত দুই দশকে ৪৩৪৪টি পরিবার খ্রিস্টান হয়েছে এবং গির্জার সংখ্যা নাটকীয়ভাবে ১৯৯৭ সালের ২৭৪টি থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৬৪৪টা হয়েছে। এটি লক্ষণীয় যে, বান্দরবান জেলার উপজাতি জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এখন খ্রিস্টান।
শান্তিচুক্তি নিঃসন্দেহে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য বিপুল সম্ভাবনা এবং সুযোগ তৈরি করেছে। এই ২৬ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন প্রচেষ্টা পাহাড়ি জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে, যা পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যবধান কমাতে বিস্তর অবদান রেখেছে। অনেক উপজাতি মূলধারার মধ্যবিত্ত বাংলাদেশি সমাজে ভালোভাবে একত্রিত হয়েছে, যেখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির অফিসার এবং রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশের সামরিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে কাজ করছেন।
পার্বত্য অঞ্চলের আলাদা বৈশিষ্ট্য, বিশাল হ্রদ, বিস্তৃত খোলা জায়গা এবং সেইসাথে সমৃদ্ধ জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। ফলে সেখানে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে। দেশের প্রধান অঞ্চলগুলির সাথে প্রত্যন্ত এবং রহস্যময় অংশগুলিকে সংযুক্ত করার অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলির কারণে এবং অনিশ্চিত পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রত্যন্ত সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির দ্বারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কারণে পর্যটন বৃদ্ধি পেয়েছে। চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীকে তাদের নির্দিষ্ট জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখার অনুমতি দিয়ে মূলধারার অর্থনীতিতে একীভূত করেছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি রক্ষা ও লালন-পালনের লক্ষ্যে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক সংগঠন আইন ২০১০’ পাস করা হয়। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির অধিকার এখন আগের চেয়ে বেশি স্বীকৃত। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় মাথাপিছু উন্নয়ন বরাদ্দ অন্যান্য জেলার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কিছু আইন সংশোধন করেছে, কিছু আইন নতুন করে প্রণয়ন করেছে। প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার নিয়ে সংঘাত মোকাবেলায় ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। পাশাপামি সরকার ধীরে ধীরে সামরিক ক্যাম্প কমিয়ে আনছে। পার্বত্য অঞ্চলে চুক্তি-পরবর্তী উন্নয়নের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো উন্নয়ন সহযোগীদের আগমন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এনজিও এবং আইএনজিওগুলির সম্প্রসারণ।
এই অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পাহাড়ি ও বাঙালি উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করে ভূমি বিরোধের বিষয়টি অবিলম্বে সমাধান করা দরকার।
লেখক: গবেষক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী