ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২ আশ্বিন ১৪৩১

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১২ এএম | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১২ এএম

গ্রেফতারের পর পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। উচ্চ আদালত থেকে পুলিশের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নির্যাতন না করার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন না করারও নির্দেশনা রয়েছে। সেটাও মানা হচ্ছে না। সম্প্রতি বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিনই দলটির নেতাকর্মী গ্রেফতার হচ্ছে। গ্রেফতার এড়াতে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী ঘরছাড়া হয়ে রয়েছে। তাদের অনেকে বনে, জঙ্গলে, ক্ষেত-খামারে রাতযাপন করছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। যারাই গ্রেফতার হচ্ছে, তাদের অনেকে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এতে কারো মৃত্যু হচ্ছে, অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ২৪ নভেম্বর রাজধানীর ৩৯ নং ওয়ার্ডের বিএনপির সদস্য ইমতিয়াজ হাসান বুলবুলকে ওয়ারি থানা পুলিশ গ্রেফতার করে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। থানায় তাকে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন শেষে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে ২৬ নভেম্বর হার্টঅ্যাটাক হলে তাকে গোপনে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তির পর গত বৃহস্পতিবার তার মৃত্যু হয়। যদিও ওয়ারি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ নামে কাউকে তারা গ্রেফতার করেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কারা তাকে গ্রেফতার করেছে এবং কারাগারে পাঠিয়েছে? তার এই মৃত্যুর দায় কার? অন্যদিকে, গত শুক্রবার কাশিমপুর কারাগারে অসাদুজ্জামান হীরা নামে গাজীপুরের শ্রীপুরস্থ কাওরাইল ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে ফিরে আসার পর শ্রীপুর থানার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এসব মৃত্যু কোনোভাবেই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

গতকাল একটি দৈনিকে ‘বিএনপি নেতাকর্মী হঠাৎ হয়ে যাচ্ছেন নিখোঁজ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে গত এক মাসে ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে যায়। চার-পাঁচ দিন নিখোঁজ থাকার পর তাদের কাউকে আদালতে হাজির করা হয়, কাউকে রাস্তায় ফেলে যাওয়া হয়। এই চার-পাঁচ দিন তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালানোয় তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরিবারের লোকজন তাদের খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যায়। একসময় জানতে পারে তারা কারাগারে রয়েছে। এই সময় পর্যন্ত তারা এক ভয়াবহ অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হয়। এসব ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটছে। এর মধ্যে পুলিশি নির্যাতনে কারো কারো মৃত্যুর অভিযোগও রয়েছে। কয়েকদিন আগে যুবদলের এক নেতাকে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিষয়টি কয়েকজন আইনজীবী আদালতে উপস্থাপন করে সুয়োমোটো বা স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ নেয়ার আর্জি জানালে আদালত তা আমলে না নিয়ে রিট করার পরামর্শ দেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আদালতকে অনেক সময় নদীদখল, পরিবেশ দূষণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, অমানবিক কোনো ঘটানসহ জনস্বার্থবিষয়ক সমস্যায় স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্দেশনা দিতে দেখা যায়। অথচ বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি নির্যাতন এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় স্বপ্রণোদিত কোনো উদ্যোগ বা অদেশ-নির্দেশ দিতে দেখা যায় না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আইন এখন যেন সবার প্রতি সমান আচরণ করছে না। বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের বেলায় কঠোর, ক্ষমতাসীনদলের নেতাকর্মীদের বেলায় নমনীয় হয়ে পড়েছে। আইনজীবী সৈয়দ মেজবাহ মো. জয়নুল আবেদীন মেসবাহ বলেন, আইন যদি আইনের গতিতে চলে, তাহলে এসব অভিযোগ উঠত না। ক্ষমতাসীনদের জন্য এক ধরনের আইন, বিরোধী দলের জন্য আরেক ধরনের প্রয়োগ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় পুরো আইনি ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। গত শুক্রবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের এক ওয়েবনিয়রে আইনবিদরা বলেছেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা নয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সম্মান ক্ষুণ্ন করার পথে নেমেছে। এখানে আদালত, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগের। আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, জনগণের কাছে বিচার বিভাগের আস্থাহীনতা বেড়ে যাচ্ছে। যারা সরকারের সমালোচনা করে তাদের বিরুদ্ধে আইন খুব কড়া। তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ হয়। অন্যদিকে যারা সরকার পক্ষের লোক তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ হয় না। আইনবিদদের এসব মন্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে আইনের শাসনে মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে এখন সবাই সমান নয়। আইনের শাসন সুদৃঢ় থাকলে পুলিশ হেফাজতে মানুষের যেমন মৃত্যু হতো না, তেমনি পুলিশও মানবাধিকার লঙ্ঘন করত না।

গ্রেফতার ও রিমান্ডের অপব্যবহার রোধে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বহাল রেখেছেন। নির্দেশনা অনুযায়ী, কাউকে গ্রেফতারের আগে পুলিশকে তার পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। থানায় আনার পর দ্রুত গ্রেফতারের কারণ লিখতে হবে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। বাসা বা কর্মস্থল থেকে গ্রেফতার না করলে গ্রেফতারের এক ঘণ্টার মধ্যে স্বজনকে জানাতে পুলিশ বাধ্য। গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। আদালতের অনুমতি নিয়ে আসামিকে কাচের দেয়ালের কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের পর আসামিকে চিকিৎসকের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। চিকিৎসকের প্রতিবেদনে নির্যাতনের প্রমাণ পেলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেবেন আদালত। বাস্তবতা হচ্ছে, পুলিশ উচ্চ আদালতের বেশির ভাগ নির্দেশনা মানছে না। এসব নির্দেশনা পুলিশ মানছে কিনা, কিংবা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুলিশ যে নির্যাতন করেছে সে অভিযোগ আদালতকে খুব একটা নিতে দেখা যায় না। কিছুদিন আগে গ্রেফতারকৃত বিএনপির প্রথম সারির বেশ কয়েকজন নেতা আদালতে পুলিশ হেফাজতে তাদেরকে নির্যাতনের কথা বললেও আদালত তা আমলে নেয়নি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখন পুলিশি হেফাজতে যারা বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করছে এবং তার ফলে মৃত্যু ঘটছে, সেই পুলিশ সদস্যদের কোনো একসময় বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, এখন ক্ষমতার দাপটে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রেফতার ও নির্যাতন করলেও অদূর ভবিষ্যতে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী