নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে নানা প্রশ্ন
০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১২ এএম | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১২ এএম
কখনো কখনো কিছু বিষয় বুঝতে কিছুটা দেরি হলেও একটা সময় বুঝের আয়ত্বে চলে আসে। শিক্ষার বিষয়টা একটু স্পর্শকাতর। তাই সহজেই সুযোগ নিতে পারেন ক্ষমতাসীনরা। অভিভবক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বুঝে ওঠার আগেই বাজেট-বরাদ্দসহ কাজটা সেরে ফেলার চালাকি তারা করতে পারেন। নতুন শিক্ষাক্রম থেকে দশম শ্রেণির আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়ার কাজটা এমনভাবেই করা হয়েছে। এই পাবলিক পরীক্ষা চালুর কাজও অনেকটা এমনভাবেই হয়েছিল।
নবম শ্রেণিতে বিভাগ পছন্দের সুযোগ পাল্টে তা নেয়া হয়েছে একাদশ শ্রেণিতে। একাদশে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো বিভাগে পড়বে। চলতি বছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আগামী বছর বাস্তবায়ন করা হবে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে ধাপে ধাপে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার কথা। এই কারিকুলামে মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষা যেটুকু আছে তাও শেষ হয়ে যাবে, নবম শ্রেণিতে সবার জন্য গণিত ও বিজ্ঞান অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক হওয়ায় টপিক আগের চেয়ে কমাতে হবে। ফলে যারা বিজ্ঞান ও গণিত শিখতে আগ্রহী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর মাধ্যমে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রায় নাই হয়ে যাবে। কিন্তু, সরকারের দিক থেকে যুক্তির কোনো অভাব নেই। শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে শেখাতেই নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। বাস্তবটা কি আদৌ সেরকম?
দক্ষতা অর্জনের কথা বলে নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চেয়ে ব্যবহারিকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যার ফলে পড়ার চেয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক নানান কাজের চাপ বেড়েছে, যা অনেক অভিভাবকের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা চোখের সামনে দেখছে, ব্যবহারিকের নামে সন্তানরা পড়তে বসে না। সারাক্ষণ কী সব অ্যাসাইন্টমেন্টের কথা শোনায়। বন্ধু-বান্ধবের সাথে বসে থাকে। গোটা ব্যবস্থাটা ওই রকমই হয়ে গেছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক স্তর, অর্থাৎ নার্সারি ও প্লে-তে শিশুদের জন্য এখন আর কোনও বই থাকবে না। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরাই তাদেরকে সরাসরি শেখাবেন।
এরপর প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তাদের মাত্র তিনটি বই পড়ানো হবে। তবে কোনো পরীক্ষা নেওয়া হবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে বছরব্যাপী চলা বিভিন্ন শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরে শ্রেণিভেদে ত্রিশ থেকে ষাট ভাগ পর্যন্ত মূল্যায়নই করা হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন সময়ে। শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের দক্ষতা, উপস্থাপন, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হবে দশটি বিষয়ে। বিষয়গুলো হচ্ছে: ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ। আর সামষ্টিক মূল্যায়ন অর্থাৎ পরীক্ষা হবে ৪০ শতাংশ। এছাড়া শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্পকলায় শতভাগ ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন বা বছর শেষে পরীক্ষায় থাকবে ৪০ শতাংশ। বাকি বিষয় জীবন ও জীবিকা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
শিক্ষার্থীদের এখন নবম ও দশম শ্রেণিতে অভিন্ন সিলেবাসে পড়ানো হবে। এর মধ্যে নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ। বাকি বিষয়গুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য- এই তিন বিভাগে ভাগ হবে। এখান থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো বিভাগ বেছে নেবে।
এছাড়া নতুন পাঠক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি অনুসারেই অভিন্ন দশটি বিষয়ের ওপর এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে। একইভাবে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ধরনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দু’টি আলাদা পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর দুই পরীক্ষার ফল সমন্বয় করে হবে এইচএসসি’র চূড়ান্ত ফলাফল।
আগে যেখানে প্রথম শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হতো, সেখানে এখন প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। আবশ্যিক বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আগে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী-পিইসি, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট-জেডিসি পরীক্ষা নেওয়া হতো। এসব পরীক্ষা এখন আর নেই।
বাংলাদেশের জন্ম থেকে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রতিটি কমিশনের ছিল নিজস্ব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সব শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শহরের রাস্তার মতো। খোঁড়াখুঁড়ি যেন শেষই হয় না। স্বাধীনতার পর প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় ১৯৭২ সালে, যা ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন নামে বেশি পরিচিত। এরপর ১৯৮২ সালে হয় মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৭ সালে মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ২০০১ সালে এমএ বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন।
নতুন কারিকুলামে কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। তার পরিবর্তে আছে ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন ও প্রজেক্টনির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রজেক্ট ও অ্যাসাইনমেন্টের সংযোজন অবশ্যই প্রশংসনীয়। একে বলা হচ্ছে, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষাপদ্ধতির জায়গায় একধরনের বৈপ্লবিক চিন্তা। কিন্তু কখন, কোথায় হলো এ বিপ্লবটা? কারা ঘটালেন? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল চ্যালেঞ্জ হলো মানুষ ও রোবটের বুদ্ধিমত্তায় কে টিকে থাকবে, সেটা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি করণীয় হলো নিজেদের বুদ্ধিমত্তাকে আরও বেশি শাণিত করা, একটি বুদ্ধিদীপ্ত, উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল জাতি তৈরি করা। বর্তমান কারিকুলাম দিয়ে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করে বড় বড় বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী প্রজন্ম তৈরি করা যাবে? শিক্ষাসূচি, পদ্ধতি নিয়ে এ দেশে কতো যে এক্সপেরিমেন্ট! সৃজনশীল, এমসিকিউসহ কতো কী?
এমনিতেই দেশে অন্তত এগারো-বারো কিছিমের শিক্ষা ব্যবস্থা ধাবমান-চলমান। আবার মাঝেমধ্যে একমুখিতার কথা বলে বহুমুখিতার প্রবণতা। আজ বৃত্তি, কাল বৃত্তি তুলে দেয়া। যখন যেটা মন চায়, সেটার পক্ষে ব্যাপক যুক্তি। আর কিছু লোকের কিছুদিন এর বিপক্ষে মাতামাতি করে ঘরে ফিরে যাওয়া। কিছু লোকের সায় দিয়ে বাহ, বাহ আওয়াজ। কদিন বাদেই আবার সেঠাই বেঠিক।
পদ্ধতি বদলানোর এ ধারায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর মনগড়া ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার আগে তেমন ভাবনাচিন্তার দরকার মনে করলো না সরকার? নাকি ভেবেছে অন্যকিছু? সরকারি মহলের দাবি, এই কারিকুলাম দিয়ে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠি তৈরি করা যাবে। এতোদিনের কারিকুলাম দিয়ে তা হলে কী হয়েছে? এখন বড় বড় বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীতে দেশ ভরে উঠবে? অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন একলাফে গাছের মগডালে তোলার এ চিন্তার পরিণাম কী হবে ভেবে পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হবে নাতো? খেলার মাঠ প্রস্তুত না করে, খেলা পরিচালনার জন্য একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ রেফারি নিয়োগ না দিয়ে একদল খেলোয়াড়কে ফাঁকা মাঠে ছেড়ে দিলে কী হয়?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী