মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ করতে হবে
০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
মানুষের জীবনবোধের সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের সম্পর্ক রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড পোপেনোরের মতে, ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, কাক্সিক্ষত-অনাকাক্সিক্ষত ইত্যাদি সমাজের সদস্যদের যে ধারণা, তার নামই মূল্যবোধ। মূল্যবোধের অবক্ষয় এখন চারিদিকে প্রকট। মূল্যবোধ বলতে একটা ধারণা বুঝায়, যদিও সুস্পষ্টটভাবে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে মূল্যবোধ সাধারণত আচার-আচরণের এক ধরনের মানববোধ, কিছু আদর্শগত বিষয়ের সমষ্টি, যার দ্বারা মানুষ যেকোনো কাজের ভালো-মন্দ, শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা যাচাই করে অগ্রসর হতে পারে। মূল্যবোধের শিক্ষা বলতে সত্যবাদিতা, অহিংসা, নির্ভিকতা, সামাজিক সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধ, সেবা প্রমুখ বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়। মূল্যবোধ কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ভালো-মন্দ বিচার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সামাজিক দিকও আছে, যেগুলো খুব প্রয়োজনীয়। মূল্যবোধ হলো মানুষ তাঁর নিজের এবং সমাজের জন্য এক বিশেষ কোড অব কনডাক্ট, যার দ্বারা একজন মানুষ অথবা সমাজ উত্তরণের দিকে অগ্রসর হতে পারে।
মূল্যবোধ সব সময় একটা জায়গায় থেমে থাকে না। ডড়ৎষফ ঠধষঁব ঝঁৎাবু মূল্যবোধের ওপর বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এই সংস্থার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বিভিন্ন শাখার বিজ্ঞানী। এর এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, মূল্যবোধ বা ভ্যালু কখনও এক জায়গায় স্থির থাকে না। সমাজ পরিবর্তন, বিবর্তনের সঙ্গে মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। ডড়ৎষফ ঠধষঁব ঝঁৎাবু- এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, যখনই কোনো দেশের ঔদ্যোগিক বিকাশ এবং তার উত্তর ঔদ্যোগিক জ্ঞান সমাজের দিকে যতই এগোচ্ছে ততই ওই দেশের পরম্পরাগত মূল্যবোধ যেমন-পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে বন্ধন, পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক, ধর্মীয় গুরুত্ব ইত্যাদিতে মানুষের টান কমছে। ডঠঝ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮-২০১৬ সাল পর্যন্ত মানুষের সুখ শান্তি এবং জীবনের সন্তুষ্টি বেড়েছে। ডড়ৎষফ যধঢ়ঢ়রহবংং রহফবী-এ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের নিরিখে সুখি দেশর তালিকা প্রস্তুত করে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, সেই সুখি দেশগুলোর মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা, সন্তুষ্টি, সৌজন্য, সহনশীলতা, প্রগতিশীলতা বিদ্যমান। তাহলে আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছি, যে মূল্যবোধ অচল-অটল নয়। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আসলে মূল্যবোধের আধার কী? এটা কি এমনিতেই গড়ে উঠে, না এর কোনও সামাজিক প্রেক্ষাপট আছে? মূল্যবোধ আসলে বিমূর্ত নয়। মূল্যবোধ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত। আজকাল বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মতবাদের প্রচার চলছে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতবাদ প্রচারে বিভিন্ন চিন্তা একত্রে প্রসারিত করার চেষ্টায়রত। এক দল জোরপূর্বক তার মূল্যবোধ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় তৎপর। বিশে^র সমস্ত ঘটনা মানুষের নখদর্পণে। বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক সফলতা আর নিত্যনতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে সবকিছু আজ মানুষের সাধ্যের মধ্যে। তা সত্ত্বেও পৃথিবী হয়ে পড়েছে হিংস্র, অশান্ত আর নৈরাজ্যের ঠাঁই। বর্তমান সমাজে বস্তুগত সমৃদ্ধির পরও এক বিরাট সংখ্যক মানুষের মধ্যে দেখা যায় অর্থনৈতিকতা, সীমাহীন দুর্নীতি, ছলচাতুরী, চূড়ান্ত মিথ্যাচার। ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতার শীর্ষে থাকাটা স্থির করে নিয়েছে মানুষ।
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তজ্জনিত হিংস্রতায় সমাজ এক অস্থির সময়ে বিরাজ করছে। এটা সমগ্র বিশে^র সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমরা এখন ঔদ্যোগিক সভ্যতার দিকে এগোচ্ছি। উত্তর-ঔদ্যাগিক স্তর পেতে এখনও বাকি। এখনও আমরা অবৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণায় আচ্ছন্ন। সেই সঙ্গে আমাদের ঠেলা হচ্ছে জাত-পাত, অসহিষ্ণুতা, নিম্নগামী যুক্তিতর্কের পরিবেশে। তাইতো ভুলে গেছি সৌজন্য বিনিময়। এইভাবে কি মূল্যবোধের উত্তরণ সম্ভব? মূল্যবোধের জন্ম সমাজেই হতে হবে। বিজ্ঞানী ব্রাউনের মতে, যদি পৃথিবীতে নৈতিকতার মান প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের বৈপ্লবিক অগ্রগতির সঙ্গে অগ্রসর না হয়, তাহলে আমরা নিঃশেষ হয়ে যাব। শিক্ষার বিস্তারে বিজ্ঞানের চমকপ্রদ আবিষ্কারের ফলে প্রযুক্তিগত বিরাট প্রসার ঘটছে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে নৈতিকতার মান অগ্রসর হয়নি মোটেই। মূল্যবোধের উত্তরণ ঘটছে না। তবে সংকীর্ণ চিন্তার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে হিংসা, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি। এমন এক সমাজকে পরিবর্তনের দায়ভার কে নেবে? আমাদের শিক্ষক-অভিভাবক, ধর্মীয় নেতাদের সমান অংশীদারিত্বে এই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সম্ভব।
সমাজে শিক্ষকের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যদি লক্ষ করি তবে দেখা যায়, কোনো এক আদর্শ শিক্ষকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরিচর্যায় আমরা আজ এতটা এগিয়েছি। তাদের ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তা, চিন্তাধারা, ভাবনায় আমরা মুগ্ধ। নৈতিক শিক্ষা বা বিদ্যায়তনিক শিক্ষায় যদিও তাদের মতো অগ্রসর হতে পারিনি তবে আমাদের ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে কতটা ফলপ্রসূ তা নিশ্চয় আমরা বুঝতে পারি। কারণ, ছাত্র জীবনে একটা ছেলে বা মেয়ে ঘরের সব থেকে বেশি সময় কাটায় স্কুলে। সেখানে একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা, সহপাঠীদের সঙ্গে সহমর্মিতা, গুরুজনদের প্রতি ভক্তি, ছোটদের আদর, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা, মুক্ত চিন্তার ক্ষমতা, বিজ্ঞানমনস্কতা এসবের মূল্যবোধের ধারণা ও অভ্যাস সেখানেই গড়ে উঠে। আর এই অভ্যাস গড়ে তোলার মূল নায়ক হলেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক পুঁথিগত জ্ঞানদানের সঙ্গে একজন পথপ্রদর্শক, সহানুভূতিশীল, বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তি। যিনি ছাত্রছাত্রীদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নিঃশুল্ক জ্ঞান দিয়ে থাকেন। সেইক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শুধু বিদ্যালয়ের শিক্ষক নন, সমাজেরও। তাই শিক্ষকের দায়িত্ব হলো যতটুকু জানা ততটুকুই সঠিকভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা। মূল্যবোধও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নিরিখে জাপান অনেক এগিয়ে। জাপানে একটি কথা আছে -অ ঢ়ড়ড়ৎ ঃবধপযবৎ ঃবষষং, ধহ ধাবৎধমব ঃবধপযবৎ ঃবধপযবং, ধ মড়ড়ফ ঃবধপযবৎ বীঢ়ষধরহং ধহফ ধ মৎবধঃ ঃবধপযবৎ রহংঢ়ধরৎবং. একজন শিক্ষক ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করার জন্য, সৎ পথে চলার জন্য, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নিরিখে সামাজ জীবনে সুস্থ মস্তিষ্কে আগ্রসর হওয়ার জন্য প্রথমে নিজেকে সেভাবে গড়তে হবে। তাহলে তিনি ছাত্রছাত্রীর আদর্শ হিসেবে পরিগণিত এবং তার প্রদত্ত শিক্ষাকে ছাত্রছাত্রীরা চিরদিন স্মরণ রাখবে। তবে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া মূল্যবোধের উন্নয়ন হয় না, এটা সত্য। তাই নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
সেই একইভাবে আমরা যারা অভিভাবক আছি তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটা শিশুর প্রথম শিক্ষা তার ঘর থেকেই শুরু, চোখ খোলার পর ঘরকেই সে আপন করে নেয়। একটি শিশু প্রথমেই তার বাবা-মার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে বড় হয়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে হয়, সততা, তাদের বিশ^াস, আচার-ব্যবহার সব কিছুই বাবা মায়ের কাছ থেকে শিখে। অভিভাবকদের মধ্যে যদি অসদাচরণ, অযৌক্তিক চিন্তা চেতনা, অন্ধবিশ^াস, কুসংস্কার দেখা যায় তবে সেই শিশুটিও মানসিকভাবে সেইভাবেই গড়ে উঠে। সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রয়োজন আছে, ভালোবাসা, সৎ-অসৎ বিচারের প্রয়োজন আছে তবে তার বীজ ঘরেই রোপণ করতে হবে এবং এর মূল হতে হবে বাবা-মা দুজনেই। মানবসমাজ সেই প্রাচীনকাল থেকেই মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। আকারে ক্ষুদ্র দ্বীপ হলেও নৈতিকতার জন্য ইংরেজরা পুরো বিশ^ জয় করেছিল। অনৈতিক কাজ দ্বারা ক্ষমতাসীন হলেও ধ্বংস অনিবার্য। পিবি শেলীর বিখ্যাত ঙুুসধহফরধং- এ বলেছিলেন, গু হধসব রং ঙুুসধহফরধং. করহম ড়ভ শরহমং, খড়ড়শ ড়হ সু ড়িৎশং, ুব সরমযঃু ধহফ ফবংঢ়ধরৎ.
আলোচনার পরিসমাপ্তিতে এটুকু বলা যায় যে, আমরা দিন দিন যেভাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলছি তাতে বর্তমান সমাজ রোগাক্রান্ত। পারস্পরিক মমত্ববোধ, প্রেম, সৌজন্যতা এসব আমরা হারিয়ে ফেলছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে, যেখানে একটা সুস্থ সমাজ উপহার দিতে পারি। নীতি-ঔচিত্যবোধ, সামাজিক ন্যায় বিচার, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা, শ্রমের মর্যাদা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য চর্চার মাধ্যমে উন্নত, সভ্য ও কলুষমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব। সঠিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চার মাধ্যমে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী