শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অযথা এক্সপেরিমেন্ট ও অনাস্থার পরিবেশ কাম্য নয়
০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে দেশ যখন এক গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরে দেশের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও সংক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে যে সর্বব্যাপী দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে তার মূলে রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন শিক্ষানীতি। কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমুহের সুস্থ ধারার অংশগ্রহণমুলক রাজনৈতিক পরিবেশ ও স্পেস না থাকায় শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা তেমন দৃশ্যমান না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সাধারণ অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার মাধ্যমে সরকারের নতুন শিক্ষা কারিক্যুলামের বিসয়বস্তু সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে তা প্রচ্ছন্ন ও অস্বচ্ছ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষা কারিক্যুলাম নিয়ে গত কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক প্রকার ঝড় উঠেছে। ঝড় কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার কন্টেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, সাধারণ অভিভাবক ও অংশীজনদের অনেকে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে রাজপথে প্রতিবাদ সমাবেশে নেমে আসতেও দেখা গেছে। তাদের অনেকেই আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে সন্তানদের শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের এই হতাশা ও উদ্বিগ্নতা অমূলক বা ভিত্তিহীন নয়। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সরকারের অবিমৃশ্যকারিতা ও অপরিনামদর্শী এক্সপেরিমেন্টের খেসারত এখন জাতিকে দিতে হচ্ছে। অতীতের সরকারগুলোর কথা বাদ দিলেও বর্তমান সরকারের আমলে গত এক যুগে প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা নিয়ে সরকারের চাপিয়ে দেয়া এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে পুরো দশক ধরেই নানা রকম বিতর্ক জারি ছিল। বিশেষত শিক্ষা কারিক্যুলাম থেকে ইসলামিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা এবং এ উপমহাদেশে ইসলামের সুমহান ইতিহাসকে উপেক্ষা করে সেখানে সেক্যুলারিজমের মোড়কে হিন্দুয়ানি শিক্ষা কারিক্যুলাম চালুর উদ্যোগকে দেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। পাঠ্যসূচি থেকে ইসলামি মূল্যবোধসম্পৃক্ত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সেখানে বিপরীতমুখী বিষয়বস্তু সংযোজনের একটি ধারাবাহিক তৎপরতা নিয়ে নাগরিক সমাজের উদ্বেগ ও প্রতিবাদী পর্যালোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমেও আলোচিত হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-সংক্ষোভের বিপরীতে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোনো যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানবজাতির বির্বতনের ইতিহাস শেখাতে গিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পরিত্যাজ্য ডারউইনের বিবর্তনবাদ আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির ঘটনাসহ বেশকিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। শতকরা ৯০ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামি মূল্যবোধের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাহ্য করে সেক্যুলারিজমের মোড়কে বিজাতীয় সংস্কৃতির বয়ান উপস্থাপনের গণপ্রতিক্রিয়া অগ্রাহ্য করা সম্ভব না হওয়ায় ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতিবাদের মুখে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও অধিদফতর পাঠ্যসূচিতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশে পাশের হার এবং উচ্চ গ্রেড নিশ্চিতের মাধ্যমে সরকার আসলে কোন লক্ষ্য হাসিল করতে চেয়েছিল তা সাধারণের বোধগম্য হয়নি। বিগত চারদলীয় জোট সরকার পাবলিক পরীক্ষায় নকলবাজি এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। মহাজোট সরকারের আমলে প্রায় প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও এবং খাতা মূল্যায়ণে অনৈতিক নির্দেশনা শিক্ষার মানকে নতুনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত একটি জাতিরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ও লক্ষ্য অর্জনের মূল অবলম্বন হচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সঠিক বিষয়বস্তুর নিরীখে প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষানীতি সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। ঊনবিংশ শতকে (১৮১৩ খৃ:) বৃটিশ শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক লর্ড ব্যাবিংটন মেকলে ভারতের জন্য প্রথম যে শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেছিলেন, তাকে বলা হয় নিম্নমুখী পরিস্রবণ শিক্ষানীতি। ইংরেজের শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে এখানে কিছু ইংরেজী শিক্ষিত জনবল তৈরী করা যারা দোভাষী কেরানী হিসেবে দায়িত্ব পালনের উপযোগী হয়ে গড়ে উঠবে। তিনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, এই শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষগুলো রক্তে-বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি, চিন্তা ও নৈতিকতায় হবে ইংরেজের মত। প্রায় ৮শ’ বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমান শাসনে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সেখানে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল উচ্চতর নৈতিক মানসম্পন্ন ত্যাগী, ধার্মিক ও মানবিক মানুষ সৃষ্টি করা। ইংরেজের কারিকুলাম শিশুদের মন-মগজে প্রথম ঢুকিয়ে দিল; ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চরে সে’। বৃটিশতের পৌনে দুইশ’ বছরে ১১টি শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে গৃহিত শিক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের গড়ে তোলা শিক্ষানীতির ভিত্তিকে নির্মূল করা। অনেকটা বাস্তবতা বর্জিত ও আবেগের বশে ভারতের মুসলমানরা ইংরেজের প্রবর্তিত শিক্ষানীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়লেও নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুন্ন থাকায় মুসলমানদের মাধ্যমে বৃটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী ইংরেজ খেদানোর আন্দোলনে শহীদের তালিকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল। বৃটিশ সামরিক জেনারেল ফিল্ড মার্শালের লেখা আত্মজৈবনিক গ্রন্থে লিখেছেন, বিদ্রোহ দমনের নামে শুধুমাত্র ১৮৫৭ সালেই ২৭ হাজার মুসলমানকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী আট দশকে স্বাধীনতার জন্য মুসলমান শহীদের তালিকা আরো অনেক দীর্ঘ হয়েছিল। ভারতের বর্তমান শাসকরা স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের খাটো করার সব রকম চেষ্টা-তদবীর চালিয়ে যাচ্ছে। সিপাহী বিদ্রোহের পর দক্ষিণ মালাবার অঞ্চলে ইংরেজের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা কৃষক বিদ্রোহ মোপলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। একজন মুসলমানের নেতৃত্বে হিন্দু- মুসলমান কৃষকদের অংশগ্রহণে সংঘটিত বিদ্রোহে হাজার হাজার মানুষ শহীদ হন। এর অধিকাংশই ছিল মুসলমান। সম্প্রতি বিজেপি সরকার একটি কমিটি করে মোপলা বিদ্রোহের ৩শতাধিক মুসলমানের ‘শহীদ’ সম্মাননা বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। এভাবেই ভারতের শিক্ষা ও ইতিহাস থেকে মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকারের প্রবণতা তৈরী করা হয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের সেই নীতিগত পরিকল্পনার ফরমান কি বাংলাদেশেও চালান করা হয়েছে? বিগত দশক থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের শিক্ষা কারিকুলামের পরিবর্তন থেকে অনেকে এমনটা আঁচ করেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রীহীনতা, এককরফা ও ভোটারবিহিন নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পেছনে ভারতের নেপথ্য ভূমিকা এবং সাংষ্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাব আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিক্ষানীতিতে পড়ছে। এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
আমাদের মত একটি জাতিরাষ্ট্রের শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ এবং কিভাবে তা বাস্তবায়িত হবে, রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী তথা প্রধান রাজনৈতিক দলের নীতি নির্ধারকদের সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা থাকা ফরজ। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের শাসকরা সে দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। ফলে শিক্ষায় যে গ্যাপ বা শুণ্যতা দেখা দিয়েছে, পুরণে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি তাদের প্রভাবকে কাজে লাগাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। শতকরা ৯২ভাগ মুসলমানের দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে ইসলামী মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা, ইসলামের শিক্ষা ও ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাসের অবতারণা অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। স্বাধীনতার পর প্রায় সব সরকারের আমলে এ পর্যন্ত অন্তত ১০টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও কোনো সরকারই একটি কার্যকর শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে একটি যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। বিশেষ জরুরি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রফেসর কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে খুব দ্রুততার সাথে ২০১০ সালে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। শিক্ষানীতির মত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতীয় সংসদ ও সামাজিক পরিমন্ডলে প্রয়োজনীয় আলোচনা ও জনমত যাচাই করা হয়নি। শিক্ষানীতি নিয়ে সরকারের একতরফা পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক পক্ষকেও তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। অত:পর নতুন শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে পাবলিক পরীক্ষায় জনতুষ্টিমূলক শতভাগের কাছাকাছি পাসের হার, উচ্চ গ্রেডের ছড়াছড়ি দেখা গেল। নতুন শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম বিদ্বেষ এবং বিজাতীয় সংস্কৃতির আমদানি সাধারণ জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে এবং নানা মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়। গণদাবির প্রেক্ষিতে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য সূচিতে কিছু পরিবর্তন আনা হলেও শিক্ষা নিয়ে নেপথ্যের অনুঘটকদের মনোভাব আর ধামাচাপা দেয়া যাচ্ছে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একদিকে আমাদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও সমাজ প্রগতিকে ধারণ করতে পারছে না। অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভরতা, উদ্ভাবনী প্রতিভা এবং কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল গড়ে তোলতেও চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশে বেশকিছু মানসম্মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইনিস্টিটিউট রয়েছে। প্রতি বছর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে পাস করে বের হলেও এদের বেশিরভাগেরই যথাযথ কর্মসংস্থান হচ্ছে না। তারা ভাগ্যান্বেষণে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে । বিদেশে গিয়ে অনেকেই ভিন্ন পেশায় কিংবা অডজব করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে, দেশের প্রধান রফতানি শিল্পখাত গার্মেন্টস এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উচ্চ বেতনের পদগুলো ভারতীয়রা দখল করে নিয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমাদের শিক্ষিত তরুনরা দেশের চাকরির বাজারে মার খেলেও এদেরে অনেকেই বিদেশে গিয়ে পশ্চিমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় স্বার্থ বিমুখ, ইসলাম বিমুখ কিংবা বাস্তব কর্মসংস্থানের চাহিদার সাথে সঙ্গতিহীন হওয়ার কারণেই লাখ লাখ ভারতীয় তরুণ এদেশের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি করে ভারতে বছরে শত শত কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ ভারতের প্রধান রফতানি ও রেমিটেন্স আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দশকের পর দশক ধরে জাতিবিদ্বেষী এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে ঠেলে দেয়ার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুফল ভোগ করছে ভারতীয়রা।
লর্ড মেকলে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে বৃটিশ কলোনির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে ব্যবহার করার প্রস্তাব করেছিলেন। দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসকদের শিক্ষানীতি ছিল ইসলাম এবং আধুনিক শিক্ষার সংমিশ্রণ। আর স্বাধীনতোত্তোর শিক্ষানীতি সত্যিকার অর্থেই পথ হারিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়েছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা সেখানকার মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত করতে চায়। ভারতের ইতিহাস থেকে মুসলমানদের গৌরবময় ভূমিকা নতুন প্রজন্মের মনমগজ থেকে মুছে দিতে তারা ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হয়েছিল সেই ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে ইখতিয়ারুদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির অভিযানের মধ্য দিয়ে। বর্ণবাদ, সামান্তবাদ ও সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বিশৃঙ্খল বাংলাকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ভিত্তির উপর পরবর্তী কালের স্বাধীন সার্বভৌম সুবে বাংলার অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করেছিলেন। কালের পরিক্রমায় নানা রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের শতকরা ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান। নতুন প্রজন্মকে এ দেশে ইসলামের বিজয়ের গৌরবময় ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে যথাযথভাবে তুলে ধরার বদলে স্বাধীন সালতানাতের প্রতিষ্ঠাদেরকে দখলদার হিসেবে উপস্থাপনের যে কোনো প্রয়াস শেকড়বিচ্ছিন্নতার আত্মঘাতী তৎপরতা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। একটি জাতিরাষ্ট্রের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে দেশ গঠনের মূল স্তম্ভ। সেখানে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক মূল্যবোধের বিষয়গুলোর সাথে সাথে চলমান বিশ্বব্যবস্থা ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারের জন্য কর্মমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও উদ্ভাবনমূলক শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তোলার উপর জাতির প্রত্যাশিত সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নির্ভর করছে। অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন, কর্পোরেট পুঁজিবাদ ও তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিস্তৃতির হাত ধরে বহুধা বিভক্ত বিশ্ব এখন একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিনত হয়েছে। গত দেড় দশক ধরে আমাদের সরকার প্রথমে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্পের রাজনৈতিক শ্লোগান চালু করেছিল। এরপর সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপকল্প নিয়ে অনেক গালগল্প শোনানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা প্রায়শ: দেখছি ইন্টারনেটের এক্সেস এবং গতির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করছে। আমাদের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে সোমালিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া থেকে পিছিয়ে থাকার তথ্য উঠে আসতে দেখেছি। আমাদের মতো আর কোনো দেশই দেশকে ডিজিটাল, কিংবা স্মার্ট বানানোর এমন বাগাড়ম্বর মহাপরিকল্পনার কথা প্রকাশ করতে দেখা না গেলেও সে সব দেশ এসব ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে।
দেড় দশক ধরে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নানাবিধ এক্সপেরিমেন্ট চালানোর পর এবার আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা কারিকুলামের আদলে গড়ে তোলার উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় ইতিমধ্যে সরকারের কথিত সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির এজেন্ডা মার খেয়েছে। এবার ফিনল্যান্ডের শিক্ষা পদ্ধতির আদলে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে যে সব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, তাতে সমাজে এর ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া, অর্থনৈতিক, সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতসহ কোনো কিছুই ফিনিশীয়দের সাথে তুলনীয় নয়। ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর জন্য অনুকরনীয় বলে ফিনল্যান্ডের শিশুরা খেলতে খেলতে মজা করতে করতে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করে। সেখানকার আবহাওয়া, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বহুযুগে গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থায় নিজেদের অনুসঙ্গে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকরা সর্বোচ্চ বেতন ও সুযোগ সুবিধা লাভ করে থাকে। ষাট লাখের কম জনসংখ্যার ফিনল্যান্ড শিক্ষাখাতে তাদের জিডিপির ৭-৮ শতাংশ ব্যয় করে থাকে। আমাদের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ফিনল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার চার-পাঁচগুণ। ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে আমাদের প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের চেষ্টা অপ্রাসঙ্গিক ও অবাস্তব। শিক্ষাব্যবস্থাকে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের প্রভাবমুক্ত রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণাসহ আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক ও কর্মমূখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী