মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে
০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ এএম
আমরা এক অদ্ভুত সমাজে বাস করছি, যেখানে নীতি-নৈতিকতা আর মানবিক মূল্যবোধের তেমন কোনো মূল্যায়ন নেই, আছে এক প্রকারের জবরদস্তি। সত্যিকারার্থে সামাজিক মূল্যবোধের স্পিরিডটা মানব জীবনে কতটা প্রয়োজন, সে বিষয়ে চিন্তা-চেতনার মূল জায়গা থেকে পড়ে আছি বহু দূরে। অথচ, মানবিক উপাদানগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার কথা বিকশিত এক সমাজের, যেখানে আগামী প্রজন্ম হবে নিরাপদ আর আমরা হবো গর্বিত।
মানুষ একাকি বাস করার কথা স্বপ্নেও ভাবে না। কেননা, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ গঠনের ভেতর দিয়ে মানুষ যাত্রা করেছিল স্বপ্নিল পৃথিবীতে, যেখানে তার দায়িত্বই হলো ন্যায় আর সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। এক কথায় ব্যক্তি মানুষের সব সার্থকতা সমাজকে কেন্দ্র করেই। সমাজের মানবিক স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করেই মানুষের পূর্ণতা। প্রশ্ন হলো, মানুষ দল বেঁধে বাস করলেই তা কী সমাজ হয়? প্রত্যেক মানুষ একে অপরের স্বতঃসিদ্ধ কল্যাণের কথা ভেবে সাধ্য মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলার অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যখন বাস করবে, নিশ্চয়ই তখন সেই জনগোষ্ঠীর অবস্থানগত এরিয়াটা সমাজ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
সমাজের স্থিতিশীল উন্নতির ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা ও মানবিক প্রগতির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সকলপ্রকার কুপ্রথা, কুসংস্কার, রীতি-নীতি বর্জিত আচরণ, অবিশ্বাস, গোঁড়ামিকে সমূলে ধ্বংস করতে প্রতিবাদী এক আন্দোলন, যার ভেতর দিয়ে অপরাপর মানুষ নিরাপদ জীবনের স্বাধ উপভোগ করবে, এমন নিশ্চয়তার অস্তিত্বই সমাজ সংস্কার।
মানব অস্তিত্বর প্রয়োজনে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এগিয়ে নেওয়া ব্যক্তি মানুষের অন্যতম দায়বদ্ধতা। সমাজে ধনী, গরিব, সহায়-সম্বলহীনÑ নানা রকম মানুষের বাস থাকবেই। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাইকে নিয়েই তো সমাজ। পিছিয়ে পড়া মানুষদের অগ্রগতির পথ মসৃণ করাই সমাজসেবা। কেমন আছেন আমার পাশের বাড়ির মানুষ, এমন একটি সরল প্রশ্ন করার মতো সাহস ও সময় কি আমাদের আছে? ক্রমেই আমরা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি, যার প্রভাব সমাজে নেতিবাচকভাবে পড়ছে।
অপ্রিয় হলেও সত্য, সমাজে বিভিন্ন ধরনের অনাচার আর বৈষম্য দিনকে দিন বাড়ছে। আধুনিক বিশ্বের বাহ্যিক চাকচিক্যকে আমরা বুক আগলে নিতে পারলেও, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থা হতে বেরিয়ে আসতে পারিনি। সেকেলের সমাজব্যবস্থার কুসংস্কার, অনাচার, আত্ম অহমিকা, বৈষম্য ও অবমূল্যায়ন আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। শ্রেণিবৈষম্যের দিকে তাকালে দৃশ্যমান যে, সমাজে ধনী ও দারিদ্রের বৈষম্য কতটা দুঃখজনক। একটি গরিব লোক শিক্ষিত, মেধাবী ও নেতৃত্বের যোগ্যতা রাখলেও আমাদের সমাজব্যবস্থা যোগ্য মানুষটিকে অবমূল্যায়ন করে পেছনে ফেলে রাখে। অপরদিকে একজন সম্পদশালী ব্যক্তি মেধা ও নেতৃত্বে পরিপূর্ণ না হয়েও সমাজে নেতৃত্বের দায়িত্ব পাচ্ছে। এই সমাজ নিয়ে নিঃসন্দেহে আমাদেরই ভাবতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে পরিপূর্ণ এক মানবিক সমাজের।
গ্রাম থেকে শহরের নানা আলোচনায় তথা শিক্ষকের লেকচার, টিভির টকশো, ধর্মীয় বিদ্বানের উপদেশ কিংবা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, এমন কি সমাজের বাজে লোকটার মুখেও এমন কথা হর-হামেশায় শোনা যায় যে, সমাজটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, আর চলে না। সততা আর শিক্ষার মূল্যায়ন নেই, জ্ঞানীর কদর নেই। এমন সমাজের আমূল সংস্কার দরকার।
যেখানে সবাই সমাজের পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে আধুনিক এক উপভোগ্য সমাজ গড়তে চায়, সেখানে কাক্সিক্ষত সমাজের কেন দেখা পাই না? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমরা ইসলামিক সমাজ নির্মাণের কথা চিন্তা করতে পারি, যা একই সঙ্গে সুষম, নৈতিক ও মানবিক।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন: হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের নিয়ে চিন্তা কর। তোমরা যখন সৎপথে রয়েছ, তখন কেউ পথভ্রান্ত হলে তাতে তোমাদের কোনো ক্ষতি নেই। সুরা মায়েদা: ১০৫
মহান আল্লাহ কুরআনের অন্য জায়গায় বলেন: তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও? অথচ, তোমরা কিতাব পাঠ কর। তবু কি তোমরা চিন্তা কর না? সুরা বাকারা: ৪৪
উপরোক্ত দু’টো বাণীর স্পষ্ট পাঠোদ্ধার হলো, সমাজ সংস্কারের বীজ রচিত হবে একজন মানুষের নিজ অঙ্গন ও আঙ্গিনা থেকে নিজের মন চরিত্রের উন্নয়নের ভেতর দিয়ে নিজকে গঠনের মাধ্যমে। অথচ, এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যারা নিজেদের দোষ-ত্রুটি দেখে না কিংবা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অপরাধ থেকে নিজদের মুক্ত রাখতে পারে না। কিন্তু ঈমানের অনিবার্য দাবি যে, নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভুলগুলোকে শুধরানো।
একজন মানুষের সামষ্টিক রূপই হলো মজবুত সমাজ। ব্যক্তি তার নিজ অস্তিত্বের সংস্কারকরণের মধ্য দিয়ে সামাজিক সংস্কারের মূল স্তম্ভ রচনা করবে। মানুষের নৈতিক সংশোধনই সামাজিক সংস্কারকে প্রস্ফুটিত করবে। এই যে মানব রচিত তথা কথিত সংস্কার, তার সাথে এখানেই ইসলামি সংস্কারের আদর্শগত পার্থক্য। মানব রচিত সংস্কার যেখানে অন্যকে দিয়ে সংস্কার শুরু করে, সেখানে নিজেকে নৈতিকতা ও চরিত্র গঠনের মধ্য দিয়ে ইসলামি বিপ্লব রচিত হয়।
আমাদের সমাজ তখনই সফল হবে, যখন আমরা নিজেদের দোষগুলো খুঁজে বের করতে পারব। ইহতেসাব বা আত্মসমালোচনা করতে পারলেই সমাজ হবে পরিশুদ্ধ, জাতি হবে উন্নত। মহান আল্লাহ আমাদের চিন্তা করার জন্য দিয়েছেন যোগ্যতা ও ক্ষমতা। বিষয়টি কুরআনে এসেছে এইভাবে: বরং মানুষ নিজেই নিজের ব্যাপারে খুব ভালো জানে। সুরা কেয়ামাহ : ১৪
সমাজে একপ্রকার রোগ আবাস গেড়েছে, অন্যের প্রতি দোষ চাপানোর। এ ব্যাপারে নবী মুহম্মদ সা.-এর বাণী হলো: যে অন্যের ওপর আপত্তি করে বলবে যে, মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে, সর্বাধিক ধ্বংসিত ব্যক্তি সে নিজে।
অপরূপ শাসনে ব্যক্তি গঠনের উর্বর ক্ষেত্র ইসলাম! সমাজের কলহ দূরকরণে সামাজিক আন্দোলন ও সংস্কারের যাত্রা হবে প্রতিটি নাগরিকের নিজের আঙিনা থেকে। কোনভাবেই সমাজের পরিবর্তনে অন্যের ওপর অপপ্রচার ও উন্নাসিকতায় তাড়িত হওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার বিচারবর্জিত কাজের ভিত্তি রচনা করে। সংস্কার হবে আমাকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, যা অন্যরা দেখে অনুসরণ করবে। এভাবে গড়ে উঠবে এক মানবিক সমাজ। আর তাতে আগামী প্রজন্ম এক নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবে।
মহাবিশ্বের অতিক্ষুদ্র একটি জায়গার নাম পৃথিবীÑ যেখানে নিত্য নতুন কলহ আমাদের শান্তিকে বিনষ্ট করছে। অথচ, স্বার্থকেন্দ্রিক বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সুখ নেই। এতে ব্যক্তি ও পরিবারকে ঘিরে আত্মকেন্দ্রিকতার এক সংকীর্ণ গণ্ডি গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে সুখ রয়েছে অপরাপর মানব সমাজ ও দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করে বেঁচে থাকার মধ্যে। একজন মানুষ সঠিক শিক্ষা গ্রহণ না করলে তার প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। সে কারণে আমাদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আর সেই শিক্ষাটাই সঠিক, যাকে বলা হয় স্বশিক্ষা। একটি কথা মনে রাখা ভালো, সমাজ নিয়ে চিন্তা করার বয়স লাগে না, প্রয়োজন হলো মননশীল মানসিকতার। শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলে সমাজের কোনো পরিবর্তন আদৌ আসবে না। ভাবতে হবে চারপাশের প্রতিটি মানুষকে নিয়ে। নিজ অস্তিত্বের সত্যিকার পরিবর্তন ছাড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই, আমাদের সবার মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে, মূল্যবোধই পারে সমাজের রূপ সম্পূর্ণরূপে পালটে দিতে।
লেখক: গবেষক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী