ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২ আশ্বিন ১৪৩১

বিএনপির আপসহীনতা বৃথা যেতে পারে না

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩২ এএম | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩২ এএম

বিরোধীদলগুলো সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে দমন-পীড়নের শিকার হবে, এটা যেন আমাদের দেশের রাজনীতির ‘সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীনদল বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপির ওপর যে তীব্র রোষ, প্রতিহিংসা ও দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, তা নজিরবিহীন। দলটিকে ক্ষমতাসীন দলের এতটাই রোষের শিকার হতে হচ্ছে যে, এর অসংখ্য নেতাকর্মী গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা-মামলা ও সাজার মধ্যে রয়েছে। ক্ষমতাসীনদল কোনোভাবেই বিএনপিকে সহ্য করতে পারছে না। দলটিকে নির্মূল করে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। এ জন্য যা করা দরকার, তাই করেছে এবং করছে। ভাঙ্গন ধরানো থেকে শুরু করে নেতাকর্মীদের উপর সব ধরনের নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করা নিয়ে বিএনপি যে একদফার আন্দোলন করছে, তা দমাতে ক্ষমতাসীনদল ও সরকার হেন কোনো পন্থা নেই, যা অবলম্বন করছে না। কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত দলটির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, গ্রেফতার, তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো নানা ভয়াবহ পন্থা অবলম্বন করছে। সরকারের এই তীব্র রোষে পড়ে ইতোমধ্যে দলটির মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, কেন্দ্রীয়নেতাসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কারাগারগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। প্রতিদিনই দলটির নেতাকর্মী গ্রেফতার হচ্ছে এবং অনেকের সাজা হচ্ছে। গ্রেফতার এড়িয়ে আন্দোলন চলমান রাখতে হাজার হাজার নেতাকর্মী ঘরছাড়া হয়ে রয়েছে। বিএনপির তথ্যমতে, প্রায় এক কোটি নেতাকর্মী ঘর-বাড়ি ছাড়া হয়ে আছে। তারা মাঠে-ঘাটে, জমিজমায়, বনে-জঙ্গলে, ঝোপ-ঝাড়ে, অন্তরিক্ষে রাতযাপন করছে। তাদের এই রাত্রিযাপনের চিত্র পত্র-পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের এই চিত্র দেখে মনে হতে পারে, তারা অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় রয়েছে। তবে গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, লক্ষ্য অর্জনে তাদের মধ্যে রয়েছে দৃঢ়তা এবং আপসহীনতা। জীবনবাজি রেখে তারা অবিচল, অটল। এ যেন মুক্তির আরেক সংগ্রাম। জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে, তবু মাথা নোয়াবে না।

দুই.
১৯৮১ সালের ৩০ মে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন কতিপয় বিপদগামী সেনাসদস্যর দ্বারা নিহত হন, তখন দলটি অত্যন্ত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দলটির হাল ধরেন এবং প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত হন। দলের দুর্দিনে সিনিয় নেতৃবৃন্দ জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দলের সাথে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেন। সাধারণ গৃহবধূ থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। তাদের এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল, জিয়াউর রহমানের যে রাজনৈতিক দর্শন তা তিনিই ভালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। তারা খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আহ্বান জানান এবং তিনি সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদ গ্রহণ করে বিএনপিতে যোগ দেন। খালেদা জিয়া যখন রাজনীতিতে যুক্ত হন, তখন তার দুই মাস পর ২৪ মার্চ তৎকালীণ সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে বন্দুকের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দৃঢ় মনোবল নিয়ে দেশবাসীকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। শুরু হয় তার এক সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এরশাদের ক্ষমতা দখলকে ‘নট আনহ্যাপি’ হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। এর মধ্যেই ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এবং মে মাসে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নেন। বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্বে থাকা বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করলে ১৯৮৪ সালের ১৩ জানুয়ারি দলের কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, এরশাদবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে তিনি অন্যান্য বিরোধীদল নিয়ে ৭ দলীয় জোটের প্রধান হন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট গঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে এরশাদ যখন জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন, তখন দুই জোট নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগ ওই বছরের মার্চের ১৯ তারিখ এক জনসভায় ঘোষণা দেয়, যারা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবে, তারা ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। তবে এই ঘোষণায় আওয়ামী লীগ স্থির থাকতে পারেনি। ১৫ দলীয় জোট থেকে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ ছয়টি দল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট নির্বাচনে না যাওয়ার ক্ষেত্রে অনড় থাকে এবং তিনি নির্বাচনকে অবৈধ হিসেবে আখ্যায়িত করে জনগণকে তা প্রতিহতের আহ্বান জানান। ১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ সংসদে বিরোধীদলের আসনে বসলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট রাজপথে থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে। এই সময়ের মধ্যে এরশাদ বেগম খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার গৃহবন্দি করেন। তারপরও খালেদা জিয়া কোনো আপস করেননি। দেশের মানুষ তাঁর এই অবিচল-অটল ও দৃঢ়তাপূর্ণ নেতৃত্ব এবং স্বৈরশাসনের সাথে আপস না করার কারণে তাঁকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯৮৭ সালের ১১ ডিসেম্বর গৃহবন্দি থেকে মুক্ত হয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালোদা জিয়া বলেছিলেন, স্বৈরাচারের পতনের জন্য আমি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট নির্বাচনে গিয়ে সংসদের বিরোধীদল হয়ে এরশাদের পাতানো নির্বাচন ও তার স্বৈরশাসনকে বৈধতা দিয়েছিল। একমাত্র বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট এরশাদের পতনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোটও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে তার পতন ত্বরান্বিত করে। তবে এরই মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হিসেবে জনগণের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। লক্ষ্যে অবিচল থাকলে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে তা অর্জিত হয়, তা প্রমাণ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। শুধু তাই নয়, এরশাদের পতনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়, সে নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে, এমন প্রত্যাশা সম্ভবত বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল করেনি। দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ধরেই নিয়েছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে এবং বিএনপি বিরোধীদলের আসনে বসবে। তখন নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়ার আনন্দ বয়ে যায়। ক্ষমতায় যাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র, এমন মনোভাব দেখা যায়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ মন্ত্রী হবেন, এমন প্রত্যাশায় নতুন পোশাক তৈরির অর্ডার দেন বলেও শোনা যায়। অন্যদিকে, বিএনপি বিরোধীদলে বসবে এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। যেদিন নির্বাচন হয় (১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি) এবং ফল ঘোষণা হওয়া শুরু হয়, সেদিন বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা কয়টি আসন পাচ্ছে, সেদিকে মনোযোগ দেয়। দেখা যায়, তাদের বিস্মিত করে গভীর রাতের দিকে বিএনপি’র আসন সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং একসময় আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে যায়। চূড়ান্ত ফল ঘোষণায় দেখা যায়, বিএনপি পেয়েছে ১৪০টি, আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, জামায়াতে ইসলাম ১৮টি এবং বাকিগুলো কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য দল। এই ফলাফল আওয়ামী লীগের জন্য বজ্রপাত হয়ে আসে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের জন্য জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের সাথে চেষ্টা করেও সরকার গঠনের জন্য ১৫১ আসন জোগাড় করতে পারেনি। অন্যদিকে, বিএনপি সরকার গঠনের উদ্যোগ নিলে জামায়াতে ইসলাম তাকে সমর্থন দিয়ে সরকার গঠন করতে সহায়তা করে। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়া কোনো ধরনের আপস না করেই দীর্ঘ ৯ বছর যে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, তার ফল পেয়েছেন দেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসার মাধ্যমে। ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক লড়াইয়ে যদি আপসহীন থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে লক্ষ্য অর্জন যে সম্ভব, তা বেগম খালেদা জিয়া প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনি এটাও প্রমাণ করে দিয়েছেন, ভঙ্গুর একটি দলকে নিয়ে কিভাবে সংগ্রাম করে লক্ষ্যে পৌঁছা এবং ক্ষমতায় যাওয়া যায়।

তিন.
দেড় দশক ধরে বিএনপি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, এ দাবি যে ন্যায্য, তা আজ দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। এ লড়াই করতে গিয়ে দলটির শত শত নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে হামলা-মামলা, গ্রেফতার, নিপীড়ন-নির্যাতন, ঘরছাড়া, কর্মহারা এবং সর্বশেষ প্রশ্নবিদ্ধ মামলায় সাজার শিকার হচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার দলটির নেতাকর্মীদের ওপর যে স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। শুধু তাই নয়, দলটিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে নির্মূল করে দেয়ার জন্য হেন কোনো প্রচেষ্টা নেই, যা সরকার করেনি। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটিকে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। শীর্ষ নেতাদের জেলে পুরে রেখেছে। প্রতিদিন নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও সাজা দেয়া হচ্ছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দলটি যে আন্দোলন করছে, সে আন্দোলন দমাতে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নেতাকর্মীদের ওপর গ্রেফতারের জাল বিছিয়ে রেখেছে। নেমেছে হেলমেট ও মুখোশপরা সন্ত্রাসী বাহিনী, যারা বিএনপি’র নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে হত্যা ও নির্যাতন করছে, বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। সাদা পোশাধারীরা ছাত্রদলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে চার-পাঁচ দিন গুম করে রাখছে। যাদের গ্রেফতার করতে পারছে না, তাদের স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে দমাতে কী ভয়াবহ, ভয়ংকর ও অমানবিক প্রক্রিয়া। সম্প্রতি বিএনপি’র নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা পরিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করেছে। সেখানে হাজির হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অমানবিক নিপীড়ন-নির্যাতনের কথা তারা বলেছে। তিন বছরের ছোট্ট শিশু নুরিকে নিয়ে হাজির হয়েছেন তার দাদা। তার বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে না পেরে তার মাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। তার মা এখন জেলে। হৃদয় বিদীর্ণ করা এসব সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপি’র এসব নেতাকর্মীর কি দোষ? একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করাই কি তাদের দোষ? যদি তাই হয়, তাহলে তো স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যে আন্দোলন-সংগ্রাম করা হয়েছে, সেটাও দোষের ছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই, এরশাদ যেভাবে একটি নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেছিল, তা সরাসরি স্বৈরশাসন হিসেবে চিহ্নিত। এরশাদকে এ নিয়ে কখনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় গিয়ে স্বৈরাচারি আচরণ করে, তখন তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়। বর্তমান সরকারকে ইতোমধ্যে কর্তৃত্ববাদী সরকার হিসেবে দেশে-বিদেশে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ নিয়ে অবশ্য ক্ষমতাসীনদলের মধ্যে কোনো আক্ষেপ বা প্রতিবাদ নেই, বরং তাতে সে খুশি বলে প্রতীয়মান হয়। গণতন্ত্রের মোড়কে যখন কোনো সরকার স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠে, তখন তার বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ কোনো বিষয় নয়, অত্যন্ত কঠিন। বস্তুত, বিএনপি হিমালয়সম সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। তার নেতাকর্মীরা মরছে, নির্যাতীত হচ্ছে, সর্বহারা হয়ে পড়ছে, তারপরও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আপসকামী কিংবা পিছপা হচ্ছে না। তারা অপসহীন হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার স্বৈরাচারবিরোধী আপসহীন নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য থেকে। তিনি আপসহীনতার যে বীজ দলটিতে বুনে দিয়েছেন, তা দলটির নেতাকর্মীদের মন ও মননে স্বৈরাচার কিংবা যেকোনো দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা চিরস্থায়ীভাবে তৈরি করে দিয়েছে। যার কারণে, মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে রাত কাটিয়ে আন্দোলন করে যেতে পারছে।

চার.
প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির এই আপসহীন আন্দোলন সফল হবে কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, সফল হবে নানা উপায়ে। সেসব উপায়ের মূল ভিত্তি হচ্ছে, তার সংগ্রাম। আজ যে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে, বিএনপি যে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই বলছে। শুধু তাই নয়, বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর যে নির্মম নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন-গুম, হামলা-মামলা চালানো হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতেই দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইনের শাসনের ব্যত্যয়, বাকস্বাধীনতা হরণের বিষয়গুলো সামনে এসেছে এবং বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপি এবং তার নেতাকর্মীরা যদি আপসকামী হতো, তাহলে তাদের এত জীবন দিতে হতো না। হামলা-মামলার শিকার হয়ে জেলে যেতে হতো না। জীবন-জীবিকা ও পরিবার-পরিজন হারিয়ে সর্বহারা হয়ে বনেজঙ্গলে রাত কাটাতে হতো না। বেগম খালেদা জিয়া যেমন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও কোনো আপস করছেন না, তেমনি তার দলের নেতাকর্মীরাও আপস করছে না। এই আপসহীনতা বৃথা যেতে পারে না।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী