ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২ আশ্বিন ১৪৩১

গাজায় গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩১ এএম | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩১ এএম

গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে সেখানে জাতিসংঘ সনদের ৯৯ নম্বর আর্টিকেল প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তনিও গুতেরেস। বহু বছরের মধ্যে জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত একটি বিরল ঘটনা। গাজায় গণহত্যা ও চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় এড়াতে মহাসচিব এন্তনিও গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান জ্যাভিয়ের লোপেজ ডোমিঙ্গুয়েজের কাছে পাঠানো চিঠিতে অবিলম্বে গাজায় একটি মানবিক যুদ্ধবিরতির গুরুত্ব তুলে ধরে সেখানে ৯৯ ধারা প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর ও আল আকসায় ইসরাইলের বিরামহীন আগ্রাসন ও নিপীড়নের জবাব দিতে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা আল কাসাম ব্রিগেড ৭ অক্টোবর ‘অপারেশন আল আকসা ফøাড’ নামে অতর্কিত হামলা শুরু করে। এ সময় হামাস সদস্যরা ইসরাইলের সীমান্ত দেয়াল ভেঙ্গে এবং প্যারাগ্লাইডার দিয়ে ইসরাইলে প্রবেশ করে দুই শতাধিক সামরিক-বেসামরিক ইসরাইলিকে আটক করে গাজায় নিয়ে যায়। সে সময় ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে হামাসের হামলায় সহ¯্রাধিক ইসরাইলির মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজার বেসামরিক মানুষের উপর বেপরোয়া বিমান হামলা, মর্টার হামলা ও মিসাইল বর্ষণ শুরু করে। ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া আইডিএফ’র স্থল অভিযানসহ অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলের হামলায় ১৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার শতকরা ৭০ ভাগই শিশু ও নারী। গত দুই মাসে ইসরাইলের বেপরোয়া সামরিক পদক্ষেপ স্পষ্টতই একটি নির্বিচার গণহত্যা হিসেবে সারাবিশ্বে ধিকৃত হচ্ছে। পূব-পশ্চিম বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষ গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শামিল হতে দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা নেতারা হামাসের হামলার প্রেক্ষাপটে ইসরাইলের গণহত্যার ঘটনাকে ন্যায্যতা দিতে গতানুগতিক কায়দায় ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বললেও জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছিলেন, হামাসের আক্রমণ শূন্য থেকে শুরু হয়নি। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ইসরাইলের অব্যাহত দখলদারিত্ব এবং আগ্রাসন- নিপীড়নের কারণেই হামাসের যোদ্ধারা এ ধরনের হামলায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে।

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে হামাসকে নির্মূল করা এবং আটক ইসরাইলি নাগরিকদের উদ্ধারের শপথ করেছিলেন। কিন্তু দেড় মাসের যুদ্ধে গাজায় দিনরাত বিরামহীন বোমা বর্ষণ করে হাজার হাজার বাড়িঘর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে, হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ হত্যা করেও একজন বন্দিকেও মুক্ত করতে পারেনি। উপরন্তু স্থল অভিযানে শত শত সেনাসদস্য, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান হারিয়ে পর্যুদস্ত হয়ে যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য হয়েছিল। হামাসের শর্ত মেনেই কয়েকশত ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির বিনিময়ে শতাধিক বন্দিকে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকরাও মত দিয়েছেন, ইসরাইলের পরিকল্পনা অনুসারে হামাসকে নির্মূল বা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। লেবানিজ-আমেরিকান সামরিক বিশ্লেষক গবেষক হুসেন ইবিশ ফরাসি গণমাধ্যম ফ্রান্স টুয়েন্টিফোরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হামাস কোনো ব্যক্তি বা সরঞ্জাম এবং কোনো অবকাঠামোর তালিকা নয় যে, তা ধ্বংস করা সম্ভব। এটি একটি ধারণা বা ব্রান্ডের নাম। হুসেন আবিশের এই মতের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষক এবং বিশ্বনেতাদের অনেকেই অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। গত দুই দশকে একাধিকবার হামাস ও হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার সংকল্প নিয়ে স্থল অভিযান শুরু করার পর সামরিক ও কৌশলগত পরাজয় মেনে নিয়ে যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য হয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলের জন্য এবারের পরিস্থিতি আরো প্রতিকূল ও ধ্বংসাত্মক। জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের অব্যাহত আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি না হলে গাজা ও পশ্চিম তীরের ২০ লক্ষাধিক বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে মৃত্যু, বাস্তুচ্যুতি ও মহামারির সম্মুখীন হতে হবে। এহেন বাস্তবতায় জাতিসংঘ মহাসচিবের ৯৯ ধারা প্রয়োগের বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের সময়োপযোগী পদক্ষেপের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।

দুই মাসের যুদ্ধে ১৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু, হাজার হাজার বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ-গির্জা, হাসপাতাল ও শরনার্থী শিবির ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে উত্তর গাজায় সামরিক বা কৌশলগত বিজয় অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে ইসরাইলিরা। এখন দক্ষিণ গাজার অধিকাংশ এলাকা, প্রধান শরনার্থী শিবির খান ইউনিসসহ পশ্চিম তীরেও আগ্রাসন ও গণহত্যা চালাচ্ছে তারা। বিমান হামলা, মর্টার ও কামানের গোলায় আবাসিক ভবনের ধ্বংসস্তূপকে কার্যত গণকবরে পরিণত করার পাশাপাশি রাফা সীমান্ত বন্ধ রেখে খাদ্য, জরুরি ওষুধ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ রেখে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার পথ গ্রহণ করেছে ইসরাইলিরা। যেখানে বেসামরিক গাজাবাসী ইসরাইলের কাছে নিজেদের ভূমি ছেড়ে দেয়ার চেয়ে মৃত্যুকে বরণ করাকেই শ্রেয় মনে করছে, সেখানে হামাস, হিজবুল্লাহ, ইসলামিক জিহাদ কিংবা হুতি সেনাদের পরাস্ত করে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। অতীতের বিভক্তি কাটিয়ে গাজা ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিগুলোর মধ্যে একটি বৃহত্তর ঐক্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ইরান ও তুরস্কের তরফ থেকে যুদ্ধ আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অদূরদর্শী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইসরাইলিরা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আবারো ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে। ইসরাইলি গণহত্যা সমর্থন করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। মার্কিন নেতাদের দ্বিমুখী নীতি আবারো বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা জাতিসংঘ মহাসচিবের ৯৯ ধারা প্রয়োগের উদ্যোগ অনুসারে মানবিক যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে এগিয়ে না আসলে ফিলিস্তিনের গণহত্যা, মানবিক বিপর্যয় এবং যুদ্ধ আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, তার জন্য পশ্চিমা নেতারা দায় এড়াতে পারবেন না।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী