‘ইয়ে তো স্রেফ ট্রেইলার থা, পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। জামিনে কারাগার থেকে বেরোনোর পরদিন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে ঝালকাঠি-১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, যিনি কথায় কথায় স্বাধীনতার ইতিহাস শুনাতেন, এখন তিনি নিজেই ইতিহাস। অনেকেরই মনে থাকতে পারে, এরশাদ আমলে জনৈক নেতা জ্বালাময়ী বক্তৃতা করার পরদিনই এরশাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। ক্ষমতার লোভ এমন যে, সারাজীবনের অর্জন, নীতিকথা যেখানে মূল্যহীন।

ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রমুখের একটা রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাদের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই সেরকম অরাজনৈতিক সেলিব্রেটি, অভিনয়, গান থেকে ক্রিকেট তারকা ও নানান শৈলীর কলাবিদ স্টারদের তুমুলভাবে নির্বাচনী খায়েশ লক্ষ করা যাচ্ছে। এমপি হওয়ার দৌড়ে শামিল হতে তারা রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জনগণ যে তাদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে তা নয়, তারপরও তারা ‘জনসেবা’ করবেনই।

সব হয়েছিস ‘এমপি’ হয়েছিস ব্যাটা? ‘না’। ‘তাহলে জীবনটা তোর ষোল আনাই মিছা’! নেতা, চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী হবার জন্য সবাই ব্যস্ত, সবাই সুযোগ সন্ধানী। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, শান্তি রক্ষায় ত্যাগী নেতা আছে কতজন? এমনতর সুযোগ পাওয়ার কারণেই গড়ে উঠেছে, সিন্ডিকেটধারী কারবারী, ভেজাল কারবারী, টাকা পাচারকারী ও দেশে স্বৈরতান্ত্রিকতার মজবুত কাঠামো। যতো অপরাধই করুক ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিলে নিমিষে পাপমুক্ত! রাজনীতি করার স্বাধীনতা সবার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জাতির, রাজনীতিতে নীতি আদর্শ, নৈতিকতা না থাকার কারণে, গণতন্ত্রহীনতার কল্যাণে যদু, মধু, কদুও হয় খবরের শিরোনাম, বণে যায় ১৮ কোটি মানুষের আইন প্রণেতা! এর পরিণতি আজ অথবা কাল ক্ষমতাসীনদের ভোগ করতেই হবে।

খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আতি, পাতি, সিকি সব নেতারা এমপি হতে চায়।’ সবাই ধরে নিচ্ছেন নৌকা প্রতীক পেলেই এমপি হওয়া নিশ্চিত। তাই মূল পরিশ্রমটা হলো নৌকা প্রতীক নিশ্চিত করা। একটি নাটক রয়েছে ‘বাবা আমি মন্ত্রী হবো’। কারণ, একবার এমপি, মন্ত্রী হতে পারলেই রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত। এমনকি কয়েক প্রজšে§র আখের গোছানো সারা।

এভাবে যদি অন্য শ্রেণি-পেশার মানুষ এসে এমপি হয়, তাহলে যারা ফুল টাইম রাজনীতি করেন, দেশ ও জনগণকে নিয়ে ভাবেন, তাদের কী হবে? যার যা করার, কিংবা যার যে যোগ্যতা আছে, তার সেটা করাই ভালো। রাজনীতিবিদদের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও সেবার ইতিহাস থাকতে হবে। দেশের নন্দিত, আলোচিত, সমালোচিত তারকারা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে কোনো অন্যায় করেননি। প্রশ্ন হলো, জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে হলে কি এমপি হতে হয়? রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে গভীর রোগবালাই বাসা বেঁধেছে, এর সমাধান আছে কী?

এ সাব-কন্টিনেন্টে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের প্রারম্ভটা হয়েছে যাদের প্রযত্নে বা হাত ধরে, তাদের সবাই পূর্ণাঙ্গ সময়ের জন্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সবাই মুখ্যত রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাজনীতিবিদরা তো ৪০/৫০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটা পর্যায়ে এসে থাকেন। অন্যদের কি তেমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে? যেকোনো কাজের একটি প্রসেস থাকে। প্রথমে জমি তৈরি, এরপর বীজ বপন, সার-ওষুধ প্রয়োগ, নিড়ানি, কোপানি। এরপর জমিতে ফসল ফললে ঘরে তোলা যায়। রাজনীতির প্রক্রিয়াগুলোও এমন হওয়াই উচিত নয় কী?

দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করানো হয়েছে যে, এমপি নির্বাচিত হতে এখন আর ভোটারের মন জয় করে আসতে হয় না। আবার নির্বাচিত হওয়ার পরও কোনো অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন চিন্তা থাকে না। আর সেকারণেই সবাই এখন এমপি হতে চায়। এসব দেখলে মনে হয় রাজনীতি আর এখন আর রাজনীতি নেই! একজন ৩০/৪০ বছর দল করেও নমিনেশন পাবে না, আর ভিন্ন পেশার একজন হুট করে এসে নমিনেশন পেয়ে যাবে। আর্থিক চাহিদা মেটাতে পারলেই হলো। এটা যেকোন রাজনৈতিক দলের জন্য দেউলিয়াপনা! কোনো গণতান্ত্রিক দলের কাছ থেকে এটা প্রত্যাশিত নয়। দল ও দেশের চেয়ে যদি ব্যক্তি বড় হয়, তবে সে দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

এখন কে কত বছর মাঠের রাজনীতি করে এসেছে, দলের জন্য কার ত্যাগ কত বেশি, কিংবা জনগণের সঙ্গে কার সম্পৃক্ততা আছে, সেগুলো দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাবেক আমলা, উকিল, চিকিৎসক, পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এগিয়ে থাকেন প্রতিযোগিতার দৌড়ে। এমনও দেখা যায়, মনোনয়ন পাওয়ার আগে দলের নেতাকর্মীরাও তাদের প্রার্থীকে চেনে না।

ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ক্রিকেট, সিনেমা কিংবা সংগীতজগতের সেলিব্রেটিদের পদচারণা কয়েক দশক ধরেই বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই প্রবণতা বাংলাদেশেও বহুগুণ বেড়েছে। যদিও পাকিস্তানের ক্রিকেট তারকা ইমরান খান পার্টি তৈরি করে রাজনীতিতে এসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন।

স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর দল, ৭৫ বছরের পুরনো দল জনমতকে ভয় পায়, ভাবা যায়? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ৭৫ পরবর্তী সময়ে কোন্দল, বিভাজনের মতো বিষয়গুলো দলটির অগণন নেতা-কর্মীর জন্য ভীষণ বেদনার ও অসহনীয় কষ্টের। আওয়ামী লীগ ভোটচোর, আওয়ামী লীগ ভোটডাকাত, আওয়ামী লীগ ক্ষমতার জবরদখলকারী, আওয়ামী লীগ নিশিরাতের ভোটের উদ্ভাবক, আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী, আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট, এ কথাগুলো কি আওয়ামী লীগের সাথে যায়? কিন্তু যারা প্রকৃত অর্থেই আওয়ামী লীগকে মানুষের ভালবাসার দল হিসেবে দেখতে চায়, মানুষের নির্ভরতার বাহন হিসেবে দেখতে চায় নৌকাকে, তাদের বুকের ব্যাথা, মনের কষ্ট কে শুনবে?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী