দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে
১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে থাকে। এ বিষয়টি চিন্তা করে দূরদর্শী জাতির পিতা স্বাধীনতার পর পরই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় যুগোপযোগী ও সমন্বিত দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস ও প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কেবল দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম ধারণা থেকে সরে এসে দুর্যোগে পূর্ব প্রস্তুতি, দুর্যোগকালীন সুরক্ষা ও দুর্যোগ উত্তর পুনর্গঠন এ প্যারাডাইম শিফটে কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন, বিধি, পরিকল্পনা ও নীতিমালার আলোকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক এর লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এদেশে দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস কর্মসূচির মূল ভিত্তি গড়ে গেছেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম, দূরদর্শী পরিকল্পনা ও নতুন নতুন কৌশলকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার আজ দেশকে সারা বিশ্বের কাছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনুকরণীয় রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য সরকার কাজ করছে। কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অর্জনের জন্য দুর্যোগসহনশীল দেশ ও জাতি গঠন একান্ত প্রয়োজন। এ জন্য সমাজ থেকে অসমতা দূর করে সকল স্তরের জনগণকে দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। সমাজে সমতা আনয়ন করে দুর্যোগসহনশীল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে এবং বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জনগণের আয় বৃদ্ধি, খাদ্য সরবরাহে ভারসাম্য আনয়ন, দারিদ্র্যমোচনে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা/কাবিটা), গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর), অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান (ইজিপিপি) এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ ও তা সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলমান। অসহায় নারী, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, সমাজের অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারিত করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধা পাচ্ছে। সরকার দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ২৫.১ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। এতে জনগণের দুর্যোগ প্রশমনের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাড়ে তিন’শ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে বন্যার আগাম তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে মৌসুমী বন্যার ৫ দিনের deterministic forecast ও ১০ দিনের probabilistic forecast দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আকস্মিক বন্যা মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে রিমোট সেনসিং, জিআইএস, রাডার, স্যাটেলাইট তথ্য-চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে বন্যা আসার ৩ থেকে ৫ দিন আগেই বন্যার পূর্বাভাস ও বন্যার স্থায়িত্ব সর্ম্পকে সতর্কবার্তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন উন্নত গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা প্রদান করা হচ্ছে। দেশবাসীকে আগাম সতর্কবার্তা দিতে দেশের ৮টি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসানো হয়েছে। তাছাড়া বজ্রপাত প্রবণ ১৫টি জেলায় ৩৩৫টি বজ্র নিরোধক দ- স্থাপন করা হয়েছে। এ বছর সর্বোচ্চ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় আমাদের আগাম সতর্কতা, প্রস্তুতি ও সাড়াদান আরেকটি নজির সৃষ্টি করেছে। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য National Emergency Operation Centre (NEOC) প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করা হয়েছে। Humanitarian Staging Area স্থাপনের কাজও চলমান।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেক বেশি। কিন্তু ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমরা এখনও তেমন সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। ভূমিকম্পসহনীয় দেশ গড়তে সরকার কাজ করছে। ইতোমধ্যে আটটি জোনে ভাগ করে ঢাকাকে ভূমিকম্পসহনীয় হিসেবে গড়ে তুলতে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ভূমিকম্পে কার্যকর অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহ পূর্বক সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে জরুরি সাড়াদানকারী সংস্থাসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০৭১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার কাজ করছে। এ ব্যাপারে জাপান সরকার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে। জাইকার সহযোগিতায় ভূমিকম্পসহনীয় ভবনের ওপর জরিপ করা হয়েছে। ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো ভবনগুলো পর্যায়ক্রমে ভেঙ্গে ফেলা হবে। জাতীয় বিল্ডিং কোড মেনে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। আবার কিছু বিল্ডিং রেট্রোফিটিং করা হবে। শুধু ঢাকা নয় সারা দেশের সকল অবকাঠামোকে পর্যায়ক্রমে ভূমিকম্পসহনীয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।
দুর্যোগে কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সাড়াদান পর্যায়ে নারী, শিশু, বৃদ্ধ শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অসমতা দূরীকরণে দরিদ্র ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ ও দুর্যোগ সহনশীল বাসস্থান নির্মাণে দেশব্যাপী চালু রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার আশ্রয়ণ প্রকল্প। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে ঘর দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গৃহহীন পরিবারের জন্য ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ১১ হাজার ৬০৪টি, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫টি দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ করেছে। ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের পুনর্বাসনকল্পে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ২৯১টি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৮ হাজার ৫৯১টি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৬১৩টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করেছে। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করবে এ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে দুর্যোগের মাত্রা ও প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে ৬টি দুর্যোগ হটস্পটে বিভক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০৩০ সালে ও পরবর্তীতে ২০৫০ সালে দুর্যোগ কবলিত মানুষের সংখ্যা তথা ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হারে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এর প্রথম পর্যায়ে মোট বিনিয়োগের একটা বড়ো অংশ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীভাঙন রোধ, পানিধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও নাব্যতা বৃদ্ধির খরচ হিসেবে ধরা হয়েছে। নদী ড্রেজিং, গ্রীষ্মকালে সেচের পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ, খাল খনন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, সংস্কারসহ নানাবিধ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় এসব বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ দুর্যোগ সহনশীল (Disaster Resilient) দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হবে।
চলতি বছরে তুরস্ক ও সিরিয়ায় সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্প, মিয়ানমারে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় এবং সম্প্রতি লিবিয়ায় সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার তা-বে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মানবিক সহায়তা ও উদ্ধারকারী দল প্রেরণ করা হয়েছে। এতে বহিঃর্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা আরও উজ্জ্বল হয়েছে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতার পরিচিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। সমন্বিত উন্নয়ন ও সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত দুর্যোগে বাংলাদেশ পাশে আছে এবং থাকবে।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, জনসংযোগ কর্মকর্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী