রাজনীতি ও নির্বাচন যেন অর্থনীতির ক্ষতি না করে
১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকে বার বার অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় কারণ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুর্বলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার অভাব। বাংলাদেশের নির্বাচনে বড় দুটি দল বা জোট সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে থাকে। দুটি দলের মধ্যে যে বিরোধ তা অধিকাংশ অতীত কেন্দ্রিক, ভবিষ্যৎনির্ভর নয়। সবাই গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্রের চর্চা খুব কমই আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা না থাকে, আনুগত্য ও শৃঙ্খলার ঘাটতি থাকে তাহলে তারা ক্ষমতায় গেলেও দেশের মধ্যে নানা অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতার আরেকটি কারণ হলো, এ দেশের সংবিধান বার বার পরিবর্তন করা। এটা সংবিধানের অন্যতম দুর্বলতা যে, নির্বাহী বিভাগের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। আইনসভা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও নির্বাহী বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন বলা হলেও ক্ষমতার উচ্চ পর্যায় থেকে তা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কাঠামোও দুর্বল, যা কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমানো সম্ভব নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনীতিকে ঋণাত্বকভাবে প্রভাবিত করে। এতে দেশ ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন দেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন চলছে। যেখানে নিবন্ধিত ৪৪ দলের ভিতরে ছোট বড় দল নিয়ে ৩০টি দল অংশ নিলেও বৃহৎদল বিএনপিসহ ১৪টি দল নির্বাচন থেকে দূরে আছে। এ প্রেক্ষিতে টিআইবি বলেছে, সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বুঝায়, তা হচ্ছে না, এটি উদ্বেগের কারণ। এতে যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না, যা আগামী দিনের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সকলের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না। বিদেশেও হবে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিদেশিরাও বিনিয়োগ করবে, স্থানীয় লোকেরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে, বিনিয়োগ বেড়ে যাবে, অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলো সচল হতে শুরু করবে। আর অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক না হলে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে। সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করবে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনীতির সংকট উত্তরণ কঠিন হতে পারে। নির্বাচন পরবর্তী অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার না হলে যারাই ক্ষমতায় যাক মেয়াদপূর্ণ করতে পারবে না। কারণ, অর্থনীতিক অবস্থা ভালো না থাকলে কোনো রাজনৈতিক সরকার বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। অর্থনীতিক অবস্থা ঠিক না থাকলে এক নায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাও ঠিকে থাকে না। কারণ, টিকে থাকতে হলে জনগণকে কিছু দিতে হবে। বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো কমেছে। নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের পক্ষে অর্থনীতিতে বড় কিছু করাও সম্ভব নয়। তাই এ সময়ে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আমদানির ওপর কড়াকড়ি পরিস্থিতিকে আরো সংকটে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন রপ্তানিবৃদ্ধি, প্রবাসী আয় বাড়ানো। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চলমান রাখার জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অবরোধ, ধর্মঘট অর্থনীতির গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা মনে করেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে দিনে তাদের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অর্থনীতিবিদদের নানা গবেষণা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির ক্ষতির দিকগুলো পত্রপত্রিকায় ও মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। অর্থনীতি সম্পর্কে খারাপ খবর সকলের চোখে পড়ছে। হরতালে যোগাযোগ ব্যবস্থা, দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ, বন্দরে মালামাল খালাসসহ উৎপাদনমুখী শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ভালো খবর নয়। সকলের মতামত ও সংলাপের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমযোতার বিকল্প নেই। একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে সু-বাতাস আনার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেম ও দেশের জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার মানসিকতা। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শ ও চিন্তার পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু দেশের অর্থনীতি, জনগণের জান-মালের হেফাজত, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণসহ উন্নত দেশের কাতারে উন্মীত হওয়ার জন্য সকলের এক লক্ষ্যে কেন্দ্রীভূত থাকা উচিত। রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না, আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ, আমদানি-রপ্তানিসহ উন্নয়ন ও উৎপাদনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। ভুল পথে থেকেও আমরা সঠিক পথে আছি বললে ভবিষ্যতে আরো বেশি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। অর্থনীতির বর্তমান যে সংকট তা একদিনে তৈরি হয়নি। এটি এখন আর নির্দিষ্ট খাতেও সীমাবদ্ধ নেই। সব খাতে এ সংকট ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা জানি, সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো একটি অন্যটির ওপর নির্ভরশীল। একটি খারাপ হলে অন্যগুলোর উপরেও এর প্রভাব পড়ে। তবে আপাতত ৩টি সমস্যা মোকাবেলা করা জরুরি। এগুলো হলো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার ও রিজার্ভ পরিস্থিতি। সাথে সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত ব্যাংকিং খাতের উপর নজর দেওয়া। এ খাতে ঋণ আদায়ের হার এত নিচে নেমে এসেছে যে খেলাপী ঋণ বেড়েই চলেছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপী গ্রাহকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে। ব্যাংক খাতের উপর মানুষের যে আস্থা ও বিশ^াস তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে। পত্রিকার পাতা, মিডিয়ায় ব্যাংকের নানা অনিয়মের খবরে আমানতকারীদের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় কাজ করছে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর ২০২৩ শেষে ব্যাংকিং খাতের খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। খেলাপী ঋণের এই পরিমাণ গত সেপ্টেম্বর ২০২২ এর চেয়ে ২১ হাজার কোটি টাকা বেশি। সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত শ্রেণীকৃত ঋণের হার দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ৯.৯৩ শতাংশ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর এ হার ছিল ৯.৩৬ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। বর্তমানে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
ডলার সংকটতো কাটছেই না। রেমিট্যান্স কম, রপ্তানি আশানুরূপ নয় এবং বৈদেশিক ঋণের প্রবাহও কম। ব্যাংকিং চ্যানেলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এতে দেখা দিচ্ছে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি। খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশের ওপর। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে। এ কঠিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেও ফল তেমন আসছে না। সব মিলিয়ে অর্থনীতি বর্তমানে সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া অর্থনীতির সংকট মোকাবেলা করা কঠিন হবে। তা নির্ভর করছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপর। অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে একটি ভালো নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে তার উপর অর্থনীতির সংকট উত্তরণ নির্ভর করবে। কারণ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক না থাকলে কোনো রাজনৈতিক সরকারই টিকতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা না থাকলে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় থাকে না। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সহিষ্ণুতা নেই। তারা একে অন্যকে নির্মূল করে দেওয়ার মনোভাব পোষণ করে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। তাই টেকসই উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সংকট দূর করে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে অনুকূল পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী