সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
বর্তমানে নারী ও শিশুরা সবচাইতে বেশি মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছে। শিশুর উপর পৈশাচিক আচরণ ও বর্বর হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটছে, যা খুবই দুঃখজনক। শিশুদের অধিকার রক্ষায় শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। শিশু অধিকার সনদে ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। বেঁচে থাকা ও উন্নয়নের অধিকার, মতামত প্রদানের অধিকার, বৈষম্যহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার এবং শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ দেখা। শিশুদের যেকোন ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাদের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অধিকার জন্মগত।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) মদীনা সনদের মাধ্যমে নারী, শিশু, শ্রমিকসহ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। মানুষের জন্য স্বীকৃত অধিকার যখন লংঘিত হয়, তখনই আমরা বলে থাকি মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বরত ব্যক্তি বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ হলো জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং আইন প্রয়োগের যতগুলো পদ্ধতি আছে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা এবং মানবাধিকার লংঘিত হলে বিচারপ্রার্থীর বিচার সুনিশ্চিত করা। যে সকল শিশু প্রতিকূল পরিবেশে জন্মে ও বড় হয়; বিশেষত যারা পথশিশু, এতিম ও জেল খানায় কয়েদী বা হাজতী মায়ের সঙ্গে আছে, সে সকল শিশু বা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া কিশোর-কিশোরী তাদের মৌলিক ও মানবাধিকার বলে কি কিছু আছে?
দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত তাদের পরিবার। জীবন সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অর্থ উপার্জনের জন্য পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। খোলা আকাশের নিচে গাড়ির ধোয়া ও ধুলোবালি উপেক্ষা করে গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি খোলাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। কেউবা মাথায় ইট বা ভারি বস্তু নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। কেউ লোহা কাটার কাজে ব্যস্ত। তারা অসহায় ও দুর্বল বিধায় সকল নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করে এবং তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য না দিয়ে ঠকানো হয়। এতিম, অসহায়, গৃহহীন, দুঃস্থ, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় তাদের নিয়োগের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের দিনরাত খাটানো যায়। এতে শিক্ষাবঞ্চিত হওয়া ছাড়াও পঙ্গুত্ববরণসহ অকালে মৃত্যুর মুখেও পতিত হয় অনেকে।
আইন থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগ এবং গণসচেতনতার অভাবে শিশুদের এসব কাজে ব্যবহার রোধ করা যাচ্ছে না। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশার মধ্যে রয়েছে পরিবহন (বাস, ট্রাক ইত্যাদিতে), মোটর ওয়ার্কশপ ও গ্রিল ওয়ার্কশপ, লেইদ মেশিন ইত্যাদিতে, শিপ ইয়ার্ডে, ইঞ্জিন বোট ও মাছ ধরার ট্রলারে, নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে, ক্যামিকেল কারখানায়, ধূমপান ও মাদক ব্যবসায় নিয়োগ ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা, জোর-জবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুঘর্টনার আশঙ্কা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে।
যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে সকল কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে। আমাদের শ্রম আইনেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী বা কিশোর, যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। তবে কোনো শিশু (চৌদ্দ বছর পূর্ণ হয় নাই এমন কোনো ব্যক্তি) যদি কোন ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার হলো: ৭ বছরের নিচে শিশুর কোনো আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে শিশুর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, ১২ বছরের নিচে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। ১৪ বছরের নিচে কারখানায় কাজ নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহন খাতে কাজ নিষিদ্ধ। ১৬ বছরের নিচে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে শিশুকে কারাগারে রাখা বেআইনি। সহিংসতা, অপব্যবহার ও শোষণের মতো প্রধান প্রধান যেসব হুমকি আছে সেগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে কিশোর বয়সেই। এই বয়সে প্রধানত কিশোরেরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বন্দ্ব সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে অথবা শিশুশ্রমিক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব কারণে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করা বা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ কমে যায়।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো অধিকার থেকে বঞ্চিত পথশিশু জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের অপকর্মে। একশ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ী আছে, যারা পথশিশুদের দিয়েই মাদক সরবরাহ, ব্যবসা কিংবা পাচার করে। অনেক সময় পথশিশুরা নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বিদেশে পাচারেরও শিকার হচ্ছে অনেক শিশু। দারিদ্র্যের কারণে নিজের ভালো-মন্দ না বুঝেই নানামুখী ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবও রয়েছে। শিশুদের দিয়ে কোনো রকমের অসামাজিক কার্য সম্পাদনের বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে। প্রথমে পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পলিসি তৈরি করা উচিত। পথশিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা ও তাদের পুনর্বাসন বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে। পথশিশুদের যেন কোনোভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা টার্গেট করতে না পারে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ শিশুবান্ধব সংস্থার উন্নয়নকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের দেশের অনেক ছিন্নমূল শিশু রয়েছে, যারা দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে না। অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের দিন কাটে অনেক কষ্টে। ঠিকমতো খাবার জোগাতে পারে না। তারা কীভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে? এজন্য এসব শিশুকে শিক্ষাদানের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এসব শিশুর অভিভাবকদের দারিদ্র্য দূরীকরণে আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। তাদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। উন্নত দেশে দেখা যায়, শিশুর সব দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। আমাদের দেশেও অবহেলিত শিশুদের সব দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারে। পরিশেষে বলব, অবহেলিত শিশুদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের এগিয়ে আসা দরকার।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী