ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২ আশ্বিন ১৪৩১

ড. আব্দুর রাজ্জাকের খোলাসা বক্তব্য

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মিডিয়াতে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তার ওই বক্তব্য প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, বিএনপিকে ভোটে আনতে সরকার চেষ্টা করেছে। বলেছেন: ‘নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপি নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে বিএনপি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। বার বার নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, তারা যদি নির্বাচনে আসেন তাহলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে। শুধু পিছিয়ে দেওয়া নয়, বলা হয়েছিল, তাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে তার বয়ান: ‘সহিংসতা আটকাতে পরিকল্পিতভাবেই এটা করা হয়েছে। ২০ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার না করলে কি আর হরতালের দিন গাড়ি চলত? গণগ্রেফতার ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। যেটা করা হয়েছে, চিন্তাভাবনা করেই করেছি। ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। দলেও তার অবস্থান অনেক উপরে। তার এ বক্তব্য হেলাফেলা করার বা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তাকে দ্ব্যর্থহীন এবং সত্যভাষণ হিসেবে গণ্য করা যায়। অজানা সত্য ও তথ্য জানিয়ে দেওয়ায় তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। তার বক্তব্য অনেকটাই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মতো। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সরকার ও আওয়ামী লীগ আদৌ চেয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার, হামলা, মামলা, সাজা ইত্যাদি থেকে এটাই বরং প্রতীয়মান হয়, সরকার ও আওয়ামী লীগ কেউই চায়নি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। বিএনপি ছাড়া সরকার-সমর্থকদের নিয়ে একটি নির্বাচন করাই যে সরকার ও আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ছিল, সেটা এখন আর কারো অবিদিত নেই। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপিকে অবনমিত বা ভাঙার জন্যই সব কিছু করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এসব ক্ষেত্রে ন্যূনতম মানবাধিকারও রক্ষিত হয়নি। গণতান্ত্রিক বিশ্ব বরাবরই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকারের পরিপন্থি কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা ও অনুরোধকে থোড়াই কেয়ার করা হয়েছে। মানবাধিকার সুরক্ষার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও তার কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে অনেক আগে। অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বাধাগ্রস্তকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে কিছুদিন আগে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। এমনকি বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের এটা অজানা নেই, এখানে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। এ শাসন অব্যাহত রাখতে প্রশাসন, পুলিশ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি বিচার বিভাগও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের প্রতি আরোপিত হতে পারে, তাদের মধ্যে রাজনীতিক, প্রশাসন ও পুলিশের লোকজন ছাড়াও বিচার বিভাগের সদস্যদের রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড়েনি। এই সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ড. আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য অনেক কিছুর গোমর ফাঁস করে দিয়েছে। বিচার বিভাগকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করার সাক্ষ্য রয়েছে তার বক্তব্যে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের একটিই শুধু নয়, আইন ও সংবিধানের রক্ষকও বটে। একই সঙ্গে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার ওপর তার প্রভাব স্বীকৃত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য। আমাদের বিচার বিভাগ কাগজ-পত্রে স্বাধীন বটে, তবে বাস্তবে নয়। নিম্ন আদালতসমূহ নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। যখন বলা হয়, বিএনপির যারা জেলে আছে, সাজা হয়েছে, তাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে তখন প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে? বিচারের একটি পদ্ধতি আছে। চাইলেও কাউকে যখন ইচ্ছা ছেড়ে দেওয়া যায় না। যদি ছেড়ে দেওয়ার কথাই ওঠে, তবে বলতে হবে, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বা যারা দণ্ডিত হয়েছে তাদের কোনো অপরাধ নেই। উল্লেখ করা যেতে পারে, অধিকাংশ মামলাই পুলিশ বাদী হয়ে করেছে। ‘মিথ্যা মামলা’, ‘গায়েবি মামলা’ ইত্যাদি অভিধা ব্যবহৃত হয়েছে এসব মামলার ব্যাপারে। প্রবাসী, পঙ্গু, এমনকি মৃত ব্যক্তিও এসব মামলার আসামি হয়েছে। ‘সাজা’ দেওয়াও যে সাজানো, সে অভিযোগও আছে। নির্বাহী বিভাগ চাইলেই যদি আসামি বা সাজাপ্রাপ্তরা মুক্ত হতে পারে, তবে বিচার বিভাগের মর্যাদা, স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব থাকে কি?

বিচার বিভাগ বা আইন-আদালতের ব্যাপারে মানুষের সংশয়ই কেবল বাড়েনি, আস্থাও হ্রাস পেয়েছে অনেক। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন আইনের লক্ষ্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা দুষ্টের পালন ও শিষ্টের দমনে পর্যবসিত হচ্ছে। এর অর্থ, আইন ঠিকমতো কাজ করছে না এবং আদালতও আইন নিশ্চিত করছে না বা করতে পারছে না। একজন গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি জামিনে মুক্ত হয়ে পরদিন সরকারি দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য সাব্যস্ত হয়, তবে আইনের প্রতি, আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস বহাল থাকে কী করে? সম্প্রতি এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে। আরো অনেক ঘটনাই অতীতে ঘটেছে, যাতে বিচার বিভাগ বা আইন-আদালত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিচার বিভাগ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত। সেজন্যই তার স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখা বা থাকা অপরিহার্য। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়া চলছে অনেক দিন ধরে। মাঝে মাঝেই তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। দেশে-বিদেশে এটা অজানা নয়। আমাদের জন্য এটা মোটেই সুখকর-স্বস্তিকর খবর নয়। সম্মান-মর্যাদার তো নয়ই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য বিচার বিভাগকেই দেখতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে। সঙ্গতকারণেই ড. আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্যের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের অভিমত জানতে আগ্রহী দেশের মানুষ।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী