ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২ আশ্বিন ১৪৩১

কথিত আরব বসন্ত এবং আমাদের বাস্তবতা

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরাশক্তি ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড়দের তৎপরতা ক্রমেই প্রকট এক ধূ¤্রজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। এ এক অদ্ভুত মেরুকরণ। দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পুরনো জোট ছাড়া দেশের বেশিরভাগ মানুষ একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গণতান্ত্রিকভাবে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবির সাথে একদিকে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের সমর্থনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত সমর্থন ও চাপ, অন্যদিকে চলমান বিশ্বরাজনীতির বাস্তবতায় ভারত সমর্থিত শেখ হাসিনা সরকারের একতরফা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে চীন ও রাশিয়ার নীরব সমর্থনের পারদ যেন ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষ গত দুটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবিকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করা হয়েছে, স্বাধীনতার পরেও দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দশক ধরে জাতীয় ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে বার বার প্রমানীত হয়েছে, রাজনীতিতে স্থায়ী-শত্রু বা মিত্র বলে কিছু নেই। আজকের বাংলাদেশে তুমুল উত্তপ্ত ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির লড়াইয়ের পরস্পর বিরোধী শক্তিগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ ও ভোটাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একমঞ্চে ও মাঠে-ময়দানে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে। আবার একইভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অংশীদারের ভূমিকায় অবর্তীণ হতে দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা, ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি পুরণেও তারা জোরালো রাখছে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের যে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে, তার প্রতি এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন না থাকলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সাংবিধানিক অঙ্গিকার, ভোটাধিকার ও মানবাধিকারের প্রশ্নে পশ্চিমাদের অব্যাহত সমর্থন ও চাপকে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সাধুবাদ জানাচ্ছে। আজকের দুনিয়ায় দুটি ভিন্ন রাষ্ট্র বা অঞ্চলের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন কেবল মাত্র বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করে না। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নাগরিক সমাজের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে এখন জনগণের সাথে জনগণের যোগাযোগ ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কের মেলবন্ধন একটি টেকসই সম্পর্ক গড়ে তোলে। ভারত আমাদের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিকভাবে অবিচ্ছেদ্য নিকটতম প্রতিবেশি, ভারতের সাথে আমাদের বাংলাদেশের হাজার কোটি ডলারের বানিজ্যিক সম্পর্ক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবিষ্মরণীয় অংশীদারিত্বের অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এতকিছুর পরও এই সময়ে এ দেশের শতকরা অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ ভারতকে বন্ধু ভাবতে পারছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর সমর্থন সব সময়ই জনবিচ্ছিন্ন একটি বিশেষ রিজিমের প্রতি। সম্প্রতি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের পরাজয়ে বাংলাদেশের তরুন প্রজন্মের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা উপেক্ষার বিষয় নয়। বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি, টেকসই ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রয়োজনে দুই দেশের রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজকে এ নিয়ে ভাবতে হবে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে বিবদমান প্রধান দুইপক্ষের মধ্যে একটি সংলাপ-সমঝোতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান চাপ উপেক্ষা করেই আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে হাঁটছে ক্ষমতাসীন সরকার। ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট বিরোধীদলের শীর্ষ নেতাসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গণ-গ্রেফতার ও লাখ লাখ নেতাকর্মীকে ঘরবাড়ি ছাড়া করে যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে লাখ লাখ নেতাকর্মী ও তাদের পরিবার মিলে দেশের কোটি কোটি মানুষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে চরমভাবে সংক্ষুব্ধ হচ্ছে। এটি অনেকটা ১৯৭১ সালের শুরুর রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে অনেকটাই মিলে যায়। গত পঞ্চাশ বছরে দেশের জনসংখ্যা আড়াইগুণ ও দেশের অর্থনীতি বহুগুণ বেড়েছে। এ সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক পটপরিবর্তন ও নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় শাসকরা জনমত ও জনপ্রত্যাশার প্রকৃত চিত্রকে যতই ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করুক, তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ ও বিশ্ব গণমাধ্যমের যৎকঞ্চিৎ পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে সবকিছুই উন্মোচিত হয়ে পড়ে। দেড় দশক ধরে ক্রমাগত নিপীড়ন, হামলা-মামলা, গুম-খুন, গণগ্রেফতার ও শত শত নেতাকর্মীর দন্ডাদেশের পরও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামকে চুড়ান্ত বিচারে কখনোই দাবিয়ে রাখা যায়নি। গত ২৮ অক্টোবরে ঢাকায় বিএনপি’র মহাসমাবেশকে ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত, নাশকতা ও প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলার ঘটনার দায় কোনো তদন্ত ছাড়াই বিএনপি’র চাপিয়ে নির্বাচনের আগে বিরোধীদল ক্র্যাক-ডাউন ও গণগ্রেফতার শুরু হওয়ার আগেই জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার মত প্রতিষ্ঠান মহাসমাবেশের পাশে নাশকতা ও হামলার ঘটনায় সরাসরি সরকারি দলের সমর্থকদের জড়িত থাকার কথা অকপটে তুলে ধরেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায় কাকরাইলে বিএনপির সমাবেশের প্রান্তে গাড়ি ভাঙ্গচুরে লিপ্ত মুখোশধারি তরুনরা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সাথে মিশে যাচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তথ্যের গ্যাপ থাকার কথা বললেও অভিযোগ্য চ্যালেঞ্জ কিংবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারেননি। এমনকি বিদেশি কূটনীতিকদের নিয়ে আয়োজিত পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত তথ্য-উপাত্তও পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাদের নিরবতা, শীতল প্রতিক্রিয়া এবং পরবর্তী সময়ের মন্তব্য থেকে তা প্রতিয়মান হয়। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নোত রাখতে জনগণের সর্বাত্মক প্রয়াসের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্য ও সমন্বিত প্রয়াসকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জনআকাক্সক্ষা ও রাজনীতিতে যে নৈরাশ্যজনক বাস্তবতা দেখা দিয়েছে, তাতে েেদশ আরেকটি বিস্ফোরন্মুখ গৃহযুদ্ধের আশঙ্কার দিকে এগিয়ে চলেছে। পুলিশ ও আদালতের মাধ্যমে সে বিস্ফোরণ ঠেকানোর অপচেষ্টা পরিস্থিতিকে আরো বেশি শক্তিশালী গণবিস্ফোরণের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ঘোষিত তফসিলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে সম্ভাব্য সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরব বষন্তের মতো একটি অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়। বাংলাদেশে এখন শীতকাল। মার্চ মাসে যে নতুন বষন্তের আগমন ঘটবে, সেখানে একটি দুর্ভীক্ষের আলামতের কথাও শোনা যাচ্ছে। বিরোধীদল দেশে একটি দুর্ভীক্ষ ঘটাবে বলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। আয়বৈষম্য ও অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ইতিমধ্যেই দেশে একটা নীরব দুর্ভীক্ষ শুরু হয়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরিব আরো গরিব হচ্ছে। গত এপ্রিলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং(সানেম) এর এক গবেষণা জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহে অসামর্থ্য হওয়ার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতার মাত্রা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটেড মূল্য কারসাজি, মুনাফাবাজি অন্যদিকে নি¤œমান ও ভেজাল খাদ্যপণ্যের শিকার হয়ে নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে সাধারণ মানুষ। এ থেকে উত্তরণের কোনো আশু সমাধান দেখা না গেলেও খোদ সরকারের পক্ষ থেকে একটি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। এবং সেই দুর্ভিক্ষ নাকি বিরোধীদল বিএনপি ঘটাবে! প্রবল প্রতিপত্তিশালী সরকার যখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখন বিরোধীদল কিভাবে দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে তার কোনো ব্যাখ্যা কারো কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রিয় ব্যাংকে বৈদেশিক মূদ্রার রির্জাভে টান পড়েছে অনেক আগেই। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোতে সময়মত জরুরি পণ্যেও এলসি খোলা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও সার আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান না থাকায় কৃষি ও শিল্পোৎপাদনেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তদুপরি দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট ও বিরোধীদলের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণেও অর্থনীতির চাকা শ্লথ হয়ে পড়েছে। খাদ্য রফতানিকারক দেশগুলোকে রফতানি নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে। আগামি মওসুমে ধান, আলু, পেঁয়াজ উৎপাদনে চাহিদা অনুসারে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে এবং ভারতসহ উৎপাদক দেশগুলো রফতানি বন্ধ রাখলে কি অবস্থা দাঁড়াতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। একতরফা ও বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি আগে থেকেই আসছিল। নির্বাচনী তফসিল সমাপ্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে দেশের রফতানি বাণিজ্যে তার প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। কোনো কোনো পশ্চিমা গার্মেন্ট ক্রেতা সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার দায়দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে ক্রয়াদেশে নতুন শর্ত জুড়ে দিতে শুরু করেছে। এমনকি পণ্য জাহাজিকরণের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে অর্থ ফেরত না দেয়ার শর্ত দিয়েছে একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের ধস নামিয়ে নিজেদের বাজার চাঙ্গা করতে সব সময়ই মুখিয়ে থাকে প্রতিবেশি ও প্রতিদ্বন্দ্ব দেশগুলো। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্যের উপর এমন সব প্রতিবন্ধকতা বাড়তে থাকলে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

গত শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর) রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, আগামি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে আরব বষন্তের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। ওয়াশিংটন মস্কোর এই আশঙ্কার কথা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেও নানা সিম্পটমে মনে হয়, সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরাও আশ্বস্ত হতে পারছে না। কেউই বাস্তব পরিস্থিতিকে অগ্রাহ্য কিংবা এড়িয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু অবস্থা সামাল দিতে পুলিশি ব্যবস্থার বাইরে আর কিছুই করতে চাইছে না সরকার ও নির্বাচন কমিশন। দেশে একটি গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি কিংবা দুর্ভিক্ষাবস্থার মতো অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে একটি একতরফা নির্বাচনের ফায়সালা এক অপরিনামদর্শি , বেপরোয়া সিদ্ধান্ত। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার রূঢ় বাস্তবতা বিদ্যমান। যে অবস্থায় একটি দেশ রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার দিকে ধাবিত হয়, বাংলাদেশে এখন তার সবকিছুই বিদ্যমান। সে সব অনুসঙ্গ অবলোকন করলে যে কোনো সচেতন মানুষ অর্থনৈতিক সংকট কিংবা দুর্ভিক্ষের আলামত বুঝতে পারেন। মারিয়া জাখারোভা সম্ভাব্য সেই পরিস্থিতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং গোপণ এজেন্ডায় ‘আরব বষন্তের’ আশঙ্কা হিসেবে বর্ননা করেছেন। এবার বিগত দশকের আরব বষন্তের পরিস্থিতির দিকে একটু নজর দেয়া যাক। ২০১০ সালের শেষদিকে শুরু হওয়া মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর জনগনের রাজনৈতিক বিদ্রোহ ছিল আরব জনগণের বহুদিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ। বিশাল অগ্নিকান্ড একটি দেশলাই কাঠি থেকেই শুরু হয়। দুই যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলির দু:শাসনে অতীষ্ট জনগন হঠাৎ বিস্ফোন্মুখ হয়ে ওঠে । জনরোষের মুখে বেন আলিকে পালিয়ে সউদি আরবে আশ্রয় নিতে হয়। মূলত প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও কর্মসংস্থানের সংকট থেকেই গনবিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়। মোহাম্মদ বাওজিজি নামের ২৭ বছরের এক তরুন হকার রাস্তায় ভ্যান চালিয়ে তরকারি বিক্রি করতো। দিনের পর দিন পুলিশের হয়রানির বিচার চাইতে গিয়ে সিটি মেয়রের কাছে অপমান-দুব্যর্বহার পেয়ে প্রতিবাদে সে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে নিজের গায়ে পেট্টোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। চারদিন হাসপাতালে মুমুর্ষূ অবস্থায় থাকার পর ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি বাওজিজি’র মৃত্যু হলে তিউনিসিয়ার প্রতিটি শহরে প্রতিবাদ -বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। গণবিক্ষোভের মুখে দুর্দোন্ড প্রতাপ জইনউদ্দিন বেন আলির তখতে তাউস উল্টে যায়। আরব দেশগুলোতে এই বিক্ষোভের তীব্র উষ্ণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আরব বষন্তের মূল শ্লোগান ছিল আশ শাব উরিদ আন-নাজিম- পিপল ওয়ান্ট টু ব্রিং ডাউন রিজিম। মানুষ স্বৈরশাসকের পতন চায়। সেই বষন্ত বাতাসে একে একে মিশরের হোসনি মোবারক, লিবিয়ার গাদ্দাফির গদি টালমাটাল হয়ে পড়ে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সিরিয়া থেকে সউদি আরবের রাজপরিবার পর্যন্ত প্রমাদ গুনতে শুরু করে। ওয়ার অন টেররিজমের এজেন্ডায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থাকা মার্কিন সমরবিদ ও গোয়েন্দা তৎপরতায় আরব বষন্ত শেষ পর্যন্ত স্তিমিত হয়ে পশ্চিমাদের রিজিম চেঞ্জের বাস্তবায়নে পরিনত হতে দেখা যায়। আরব বষন্তের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তিউনিসিয়ায় এক অরাজক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা দেয়ার পর গণতন্ত্রে উত্তরণ ও নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজনে দেশের ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি, লেবার ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংস্থা ও আইনজীবী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি চর্তুপাক্ষিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। তিউনিসিয়ান কোয়ার্ট্টেড অব ডায়ালগ নামে পরিচিত সেই আলোচনা ছিল একটি রিকনসিলিয়েশন উদ্যোগ। একটি অশান্ত-অনিশ্চিত গন্তব্যহীন যাত্রা থেকে তিউনিসিয়াকে শান্তি ও সম্ভাবনার পথে নিয়ে আসার কৃতিত্বের জন্য তিউনিসিয়ার ডায়ালগ কোয়ার্ট্রেডকে ২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। দুর্ভিক্ষ কিংবা আরব বষন্তের মত পরিস্থিতি হোক বা না হোক, অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশের শাসকদল, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে একটি সফল ডায়ালগ, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং জনআকাক্সক্ষার পরিপুরক একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ার উদ্যোগ অসম্ভব নয়।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

প্রশাসক হতে চান শিক্ষকরা, ঠেকাতে একাট্টা ৪ সংগঠন

প্রশাসক হতে চান শিক্ষকরা, ঠেকাতে একাট্টা ৪ সংগঠন

বাংলাদেশের এই দলকে সেরা বললেন হার্শা

বাংলাদেশের এই দলকে সেরা বললেন হার্শা