রাফায় ইসরাইলের স্থল অভিযান বন্ধ করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ এএম

গাজার সীমান্তশহর রাফায় স্থল অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে ইসরাইল। এটা সামনে আসার পর বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সঙ্গতকারণেই বেড়েছে। গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর অর্ধেকের বেশি এখন রাফায় অবস্থান করছে। তাদের বেশিরভাগই বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে এসেছে। আবার তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু, যারা উত্তর ও মধ্য গাজার ইসরাইলি অভিযানে স্বজন হারিয়েছে। ওই অভিযানের সময় ইসরাইলি বাহিনী তাদের রাফায় আশ্রয় নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এখন এখানে স্থল অভিযান চালালে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। উল্লেখ আবশ্যক, ইসরাইলি বাহিনী রাফায় হামলা চালালে রাফার অধিবাসী ও শিবিরে আশ্রিতদের অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় থাকবে না। অসহায় মৃত্যুই তাদের বিধিলিপি হয়ে দাঁড়াবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ফলকার টুর্ক সতর্ক করেছেন এই বলে যে, রাফায় স্থল অভিযান চালালে ফলাফল হবে ভয়ংকর। ইসরাইলের অন্ধ সহায়তাকারী যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত অনুরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাফার লোকজনের নিরাপত্তা ও সহায়তা নিশ্চিত করার একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা ছাড়া সেখানে অভিযান চালানো উচিত হবে না বলে সতর্ক করেছেন। গত কয়েক মাসের ইসরাইলি আগ্রাসন ও নির্বিচার হত্যাকা-ে গাজায় অন্তত ৩০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ২০ হাজার নারী ও শিশু। গাজা কার্যত ধ্বংস স্তূপ। সেখানে প্রতিদিনই ফিলিস্তিনি হত্যার উৎসব চলছে। ইসরাইলি বাহিনী সেখানে ফিলিস্তিনিদের নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা করছে। দিনের পর দিন মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ চালিয়ে গেলেও ইসরালি বাহিনীকে রোখার কোনো পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা এই একতরফা যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই নিচ্ছে না। অথচ, তারাই বিশ্বব্যাপী মানবতার প্রবক্তা হিসেবে নিজেদের জাহির করতে এতটুকু কার্পণ্য করে না। তাদের এই দ্বিচারিতা ধিক্কারযোগ্য। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনির প্রসঙ্গ উঠলেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইসরাইলিদের আত্মরক্ষার অধিকারের ধুয়া তোলে। যেন ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকার নেই। যেন ইহুদিদের রক্তেরই দাম আছে, ফিলিস্তিনিদের রক্তের কোনো দাম নেই।

এটা অজানা নেই কারো, খ্রিস্টান-ইহুদি ঐকমত্য ও ষড়যন্ত্রের ফলেই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম হয়। এখন পর্যন্ত এই রাষ্ট্রটি টিকিয়ে রেখেছে পশ্চিমাবিশ্ব। আরো স্পষ্ট করলে বলতে হয়, শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানবিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো যদি ইসরাইলকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা না দেয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরাইলকে সমর্থন না করে, তবে ইসরাইলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে ন্যূনতম অনুমিত সময়ও লাগবে না। প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের অন্যায়, জুলুম ও নির্যাতন চলছে। ভূখ-ের অধিকার, নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার অধিকার, স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারÑ কোনো কিছুই তাদের নেই। এ পর্যন্ত কত ফিলিস্তিনি যে নিহত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। পর্যবেক্ষকদের মধ্যে দ্বিমত নেই যে, গাজার চলমান অভিযান ও অবাধ হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্ববংশে নির্মূল করা। ইসরাইলের এই নির্মূলিকরণ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সর্বোত সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা গোটা বিশ্বকে বিক্ষুব্ধ করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া আউটলেটগুলোর মতে, বাইডেন ব্যাপকভাবে নিন্দিত ও ধিকৃত হওয়ায় অনেকটাই ‘হতাশ’। একইসঙ্গে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ওপরও ‘ক্ষুব্ধ’। তার এই হতাশা ও ক্ষুব্ধতার কানাকড়ি মূল্য নেই বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। তাদের মতে, যদি তিনি ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারেন, তবে তার এহেন প্রতিক্রিয়া অর্থহীন। পূর্বাপর বাস্তবতা তো এই যে, যুক্তরাষ্ট্র বললে এখনই যুদ্ধবিরতি এবং অবিলম্বে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে। চাইবে কিনা সেটাই এখন সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের পুচ্ছধারী ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিশ্ববাসীর ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন। তার ভাবমর্যাদার অবনমন তাকেও ভাবিত করে তুলেছে। আল জাজিরার এক খবরে জানা গেছে, ইসরাইলকে অস্ত্র পাঠানো বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের একটি মন্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে তার উদ্দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছেন, ‘আপনি যদি মনে করেন, অনেক সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে তবে এত মানুষের হত্যা ঠেকাতে আপনার কম অস্ত্র সরবরাহ করা উচিত। ইসরাইলি বাহিনীর হাতে অস্ত্র-গোলাবারুদ কম থাকলে গাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের নিহতের হারও হ্রাস পাবে।’

প্রেসিডেন্ট বাইডেন কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই আহ্বানে সাড়া দেবেন? দিয়ে কি তিনি একজন মানবিক মানুষ হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করবেন? সে সম্ভাবনা খুবই কম। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও হত্যাকা-কে তিনি যেভাবে সমর্থন করেছেন, যেভাবে ইসরাইলকে না চাইতেই সাহায্য-সহযোগিতা ও অভয় দিয়েছেন তাতে তার নীতি-দৃষ্টিভঙ্গি না বুঝতে পারার কোনো কারণ নেই। দক্ষিণ সুদান কিংবা পূর্বতিমুরের ব্যাপারে মার্কিনি নীতি-অবস্থান কী ছিল, সবার জানা। ওই দুটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রবর্তী ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। অথচ, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা একই রকম নয়। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকলেও ইসরাইলের কবল থেকে ফিলিস্তিনি ভূখ- মুক্ত ও স্বাধীন করার কোনো জোর পদক্ষেপই তার নেই। ফিলিস্তিনিরা মুসলমান বলেই কি? ভারতে ও মিয়ানমানের মুসলমানরা হত্যা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার। অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। ভারতে মোদি সরকারের বিষম নীতি ও অত্যাচার-জুলুমে সেখানকার মুসলমানেরা অতিষ্ঠ ও বিপন্ন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। ভারতে মুসলমানদের হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধেও কোনো জোরালো প্রতিবাদ নেই, চাপ প্রয়োগ তো পরের কথা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অমুসলমানদের ঐক্য ও সখ্যের বিষয়টি সবার জানা। এটা বাস্তবের অনিবার্য প্রবণতা এবং ইতিহাসেরও বহু চর্চিত বিষয়। মুসলমানরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ও সচেতন নয়। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সখ্যের অভাব। না হলে ওআইসির ভূমিকা সরব ও কার্যকর নয় কেন? ওআইসি যদি সরব হতো, পাল্টা ভূমিকা রাখতো, তাহলে ইসরাইল কেন, যুক্তরাষ্ট্র যতবড় শক্তিধরই হোক না কেন, তার যতই দানাদার মিত্র থাক না কেন, মাথা নোয়াতে বাধ্য হতো। ফিলিস্তিনিরা যথাযথ নিরাপত্তা পেতো, স্বাধীনতা পেতো। বিশ্ববিবেক জাগ্রত ও সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি ওআইসির দেশগুলো কি প্রত্যাশিত ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসবে? গাজায় ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা ও স্থায়ী সুরক্ষা দেয়া এখন জরুরি, অপরিহার্য মানবিক কর্তব্যও বটে। এটা উপেক্ষিত হলে তার দায় কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নয়ারের বিরল ভুল,হোসেলুর শেষের ম্যাজিক,রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে রিয়াল

নয়ারের বিরল ভুল,হোসেলুর শেষের ম্যাজিক,রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে রিয়াল

টার্গেট ১৬৫,'খুনে' হায়দরাবাদ জিতল দশ ওভার আর দশ উইকেট হাতে রেখেই !

টার্গেট ১৬৫,'খুনে' হায়দরাবাদ জিতল দশ ওভার আর দশ উইকেট হাতে রেখেই !

ডোনাল্ড লু’র সফরে রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্ব দেওয়া হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ডোনাল্ড লু’র সফরে রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্ব দেওয়া হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

২ বছর অপেক্ষা করতে হবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের

২ বছর অপেক্ষা করতে হবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের

ভারতের রক্তাক্ত নির্মমতায় নিশ্চুপ প্রধানমন্ত্রী: রিজভী

ভারতের রক্তাক্ত নির্মমতায় নিশ্চুপ প্রধানমন্ত্রী: রিজভী

ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফিরেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফিরেছেন মির্জা ফখরুল

আল্লাহ ‘রব্বুল আলামীন’-২

আল্লাহ ‘রব্বুল আলামীন’-২

বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে চায় তুরস্ক

বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে চায় তুরস্ক

বিএসইসিতে নতুন তিন কমিশনার নিয়োগ

বিএসইসিতে নতুন তিন কমিশনার নিয়োগ

গোমর ফাঁসে কামড়াকামড়ি

গোমর ফাঁসে কামড়াকামড়ি

সরকারের চলতি মেয়াদে ৬০ লাখ কর্মী পাঠানোর টার্গেট : প্রতিমন্ত্রী

সরকারের চলতি মেয়াদে ৬০ লাখ কর্মী পাঠানোর টার্গেট : প্রতিমন্ত্রী

সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী

সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন বয়কট সাংবাদিকদের

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন বয়কট সাংবাদিকদের

ফুলপুর উপজেলায আ'লীগ নেতা হাবিবুর চেয়ারম্যান নির্বাচিত, ভাইস চেয়ারম্যন সবুজ ও পান্না

ফুলপুর উপজেলায আ'লীগ নেতা হাবিবুর চেয়ারম্যান নির্বাচিত, ভাইস চেয়ারম্যন সবুজ ও পান্না

নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত বলেই কেন্দ্রে ভোটারের আকাল : মেজর হাফিজ

নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত বলেই কেন্দ্রে ভোটারের আকাল : মেজর হাফিজ

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা আজ

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা আজ

৪৮ বছরে বিদেশ গেছে এক কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার কর্মী

৪৮ বছরে বিদেশ গেছে এক কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার কর্মী

ঢাবি প্রফেসর বাহাউদ্দীনের চৌর্যবৃত্তি তদন্তে কমিটি গঠন

ঢাবি প্রফেসর বাহাউদ্দীনের চৌর্যবৃত্তি তদন্তে কমিটি গঠন

আটোয়ারীতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড.আনিছুর রহমান

আটোয়ারীতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড.আনিছুর রহমান

মাধ্যমিকের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন জুলাইয়ে

মাধ্যমিকের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন জুলাইয়ে