ইসরাইলি আগ্রাসন ও গণহত্যায় বিশ্ববিবেক নিশ্চুপ কেন?

Daily Inqilab গাজী মোহাম্মদ এনামুল হক

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রত্যেক জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তবে এমন মৃত্যু কাম্য নয়, যে মৃত্যু মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ৫০০টিরও বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম শহর ধ্বংস করা হয়েছিল, যাকে ফিলিস্তিনিরা আরবি ভাষায় ‘নাকবা অথবা বিপর্যয়’ হিসাবে উল্লেখ করে। সে সময় গণহত্যায় কমপক্ষে ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। ইহুদিরা সে সময় ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ দখল করে। আর অবশিষ্ট ২২ শতাংশ বর্তমানে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পরই শুরু হয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরাইল, মিসর, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তা শেষ হয়। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন আরব সেনাবাহিনীর একটি জোটের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান হাইটস ও মিসরের সিনাই উপদ্বীপসহ ফিলিস্তিনের বাকি অংশ দখল করে। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য দ্বিতীয় জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি বা ‘বিপর্যয়’। সে সময় অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায়ও বসতি স্থাপন শুরু করেছিল ইহুদিরা। ১৯৮৮ সালে ইসরাইলের মানবাধিকার সংস্থা বি’তেসেলেমের মতে, ইন্তিফাদার সময় ইসরাইল বাহিনীর হাতে ১ হাজার ৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। এর মধ্যে শিশু ছিল ২৩৭ জন। গ্রেফতার করা হয়েছিল এক লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে। ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লিকুদ বিরোধী নেতা এরিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের পুরাতন শহর ও তার আশপাশে হাজার হাজার নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে সফর করেছিলেন। সে সময় ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘর্ষে দুদিনে পাঁচজন ফিলিস্তিনি নিহত ২০০ জন আহত হয়েছিল। ২০০৬ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় হামাস। ২০০৭ সালের জুনে হামাসের ওপর ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগ এনে গাজা উপত্যকায় স্থল, বিমান ও নৌ অবরোধ আরোপ করে ইসরাইল। গাজায় ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩টি এবং ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলস্থ দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের ঘোষণা দিলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তারই ধারবাহিকতায় ২০২১ সালে ১টিসহ চারটি দীর্ঘস্থায়ী সামরিক হামলা করেছে ইসরাইল।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার কয়েক মাস পেরিয়েছে। হামলা-সংঘাতে প্রতিদিনই গাজায় প্রাণ যাচ্ছে বহু মানুষের। সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে নারী ও শিশুদের ওপর। জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএনওমেন জানিয়েছে, গাজায় প্রতি ঘণ্টায় দুজন মা প্রাণ হারাচ্ছে। ইউএনওমেন সতর্ক করে বলেছে, গাজায় এখন যা ঘটছে সেসবের ভয়াবহ মানসিক আঘাত (ট্রমা) ফিলিস্তিনিদের প্রজন্মান্তরে বইতে হবে। প্রায় ১৬ হাজার নারী-শিশুর প্রাণ গেছে। গাজায় অন্তত ৩ হাজার নারী বিধবা হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার শিশু বাবা হারিয়েছে। ইউএনওমেন আরও জানিয়েছে, গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১৯ লাখ হামলার জেরে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সেখানকার প্রায় ১০ লাখ নারী-মেয়েশিশু আশ্রয় ও নিরাপত্তা খুঁজছে। জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ফলে তরুণদের একটি ‘প্রজন্ম’ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে। ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ওচা) যুদ্ধের প্রভাবের ওপর নিয়মিত বুলেটিন প্রকাশ করে। সংস্থাটির মতে, গাজার অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়ি বা আবাসন ইউনিট ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি ১০টি স্কুলের মধ্যে ৯টির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। হাসপাতাল, পাবলিক বিল্ডিং ও বিদ্যুতের নেটওয়ার্কগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাতের আঁধারে বোমার অগ্নি-ফুলকিই একমাত্র আলোর উৎস। যে কোনো সমাজের মতো, গাজার ভবিষ্যৎ তার সন্তান। কিন্তু এখানে তারা চরমভাবে যুদ্ধের শিকার। জাতিসংঘ বলেছে, তাদের এক প্রজন্ম পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইলি সেনাদের উল্লাস করার ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৩টি কার্যকর। এর মধ্যে অনেকগুলো বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তারা প্রায়শই চিকিৎসা না নিয়েই চলে যায়।

প্রাণ মুসলমান, খ্রিস্টান বা ইহুদির হোক তা সমান মূল্যবান। যুদ্ধ প্রাণহানি ও ধ্বংস ছাড়া আর কোনো কিছু দেয় না। ফিলিস্তিনি ভূখ- থেকে ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ নির্মূল ও বিতাড়নই ইসরাইলের আসল লক্ষ্য। পশ্চিমারা সব সময় ফিলিস্তিনিদের কোনো জবাবী হামলার পর ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলে ইসরাইলকে প্ররোচণা ও শক্তি যোগায়। প্রশ্ন হলো, আত্মরক্ষার অধিকার কি কেবল ইসরাইলের বা ইহুদিদের আছে, মুসলমান বা ফিলিস্তিনিদের নেই? বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার অজুহাতে তারা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্র ও তাদের জনগণের সঙ্গে কী ব্যবহার ও আচরণ করেছে, তা কারো অজানা নয়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র নামে এসব মুসলিম রাষ্ট্রকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এতদিনের ‘ফিলিস্তিন সমস্যা’র সমাধান না হওয়া বিশ্ব নেতৃবৃন্দের শোচনীয় ব্যর্থতার প্রমাণ বহন করে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো আন্তরিক হলে অনেক আগেই এ সমস্যায় সমাধান হয়ে যেতো। বস্তুত তাদের স্বার্থেই সংকট বহাল রয়েছে। তারাই এ সংকট জিঁইয়ে রেখেছে। ভারত, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইউরোপীয় কমিশন, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, স্পেন, চেক প্রজাতন্ত্র, ইউক্রেন ও পোল্যান্ড ন্যাক্কারজনকভাবে ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সন্ত্রাসী কাজে মদদ দিচ্ছে। আর ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলছে- চীন, ইরান, সৌদি আরব, কাতার, পাকিস্তান, লেবানন, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ। আরব বিশ্ব কিংবা ওআইসি’র ভূমিকা এক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। আরব লীগ ও ওআইসি দৃঢ়ভাবে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ালে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা লেজ গুটাতে বাধ্য হতো। গোটা মুসলিম জাহানকে মনে রাখতে হবে, ফিলিস্তিনের পরাজয়ের অর্থ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের পরাজয়। তারা শান্তি, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পক্ষে কিনা, তার প্রমাণ দেয়ার এখন একটা উপযুক্ত সময়। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমরা সর্বান্তকরণে কামনা করি, আল্লাহ যেন ফিলিস্তিনের মুসলিম ভাইদের এই মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফিক দান করেন। কেউ না থাকলেও তাদের জন্য আল্লাহ রয়েছেন, এটাই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। ইসরাইলের বিশাল সামরিক শক্তির বিপরীতে ফিলিস্তিনিরা শক্তিতে যত ক্ষুদ্রই হোক আল্লাহর রহমতের চেয়ে বড় শক্তিশালী আর কিছু নয়। সুতরাং আমরা তাঁরই রহমত কামনা করি। সেই সাথে মুসলিম বিশ্বের দায়িত্বশীলদের জন্য দো‘আ করি, তারা যেন নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার চেয়ে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। কেননা আল-আকসা কেবল ফিলিস্তিনের নয়, সমগ্র মুসলমানদের। কোনো মুসলিমের সর্বশেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত তারা তাদের এই রক্তের অধিকার ছাড়তে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফিলিস্তিনকে রক্ষা করুন। ফিলিস্তিনের মুসলিম ভাই-বোনদের রক্ষা করুন।

লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, ফুলতলা, খুলনা


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নয়ারের বিরল ভুল,হোসেলুর শেষের ম্যাজিক,রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে রিয়াল

নয়ারের বিরল ভুল,হোসেলুর শেষের ম্যাজিক,রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে রিয়াল

টার্গেট ১৬৫,'খুনে' হায়দরাবাদ জিতল দশ ওভার আর দশ উইকেট হাতে রেখেই !

টার্গেট ১৬৫,'খুনে' হায়দরাবাদ জিতল দশ ওভার আর দশ উইকেট হাতে রেখেই !

ডোনাল্ড লু’র সফরে রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্ব দেওয়া হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ডোনাল্ড লু’র সফরে রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্ব দেওয়া হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

২ বছর অপেক্ষা করতে হবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের

২ বছর অপেক্ষা করতে হবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের

ভারতের রক্তাক্ত নির্মমতায় নিশ্চুপ প্রধানমন্ত্রী: রিজভী

ভারতের রক্তাক্ত নির্মমতায় নিশ্চুপ প্রধানমন্ত্রী: রিজভী

ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফিরেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফিরেছেন মির্জা ফখরুল

আল্লাহ ‘রব্বুল আলামীন’-২

আল্লাহ ‘রব্বুল আলামীন’-২

বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে চায় তুরস্ক

বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে চায় তুরস্ক

বিএসইসিতে নতুন তিন কমিশনার নিয়োগ

বিএসইসিতে নতুন তিন কমিশনার নিয়োগ

গোমর ফাঁসে কামড়াকামড়ি

গোমর ফাঁসে কামড়াকামড়ি

সরকারের চলতি মেয়াদে ৬০ লাখ কর্মী পাঠানোর টার্গেট : প্রতিমন্ত্রী

সরকারের চলতি মেয়াদে ৬০ লাখ কর্মী পাঠানোর টার্গেট : প্রতিমন্ত্রী

সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী

সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন বয়কট সাংবাদিকদের

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন বয়কট সাংবাদিকদের

ফুলপুর উপজেলায আ'লীগ নেতা হাবিবুর চেয়ারম্যান নির্বাচিত, ভাইস চেয়ারম্যন সবুজ ও পান্না

ফুলপুর উপজেলায আ'লীগ নেতা হাবিবুর চেয়ারম্যান নির্বাচিত, ভাইস চেয়ারম্যন সবুজ ও পান্না

নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত বলেই কেন্দ্রে ভোটারের আকাল : মেজর হাফিজ

নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত বলেই কেন্দ্রে ভোটারের আকাল : মেজর হাফিজ

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা আজ

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা আজ

৪৮ বছরে বিদেশ গেছে এক কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার কর্মী

৪৮ বছরে বিদেশ গেছে এক কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার কর্মী

ঢাবি প্রফেসর বাহাউদ্দীনের চৌর্যবৃত্তি তদন্তে কমিটি গঠন

ঢাবি প্রফেসর বাহাউদ্দীনের চৌর্যবৃত্তি তদন্তে কমিটি গঠন

আটোয়ারীতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড.আনিছুর রহমান

আটোয়ারীতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড.আনিছুর রহমান

মাধ্যমিকের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন জুলাইয়ে

মাধ্যমিকের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন জুলাইয়ে