সরকারের বাড়তি চাপ নেয়া উচিত হবে না

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

দেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূস দেশে মামলা-মোকদ্দমা এবং বিভিন্নভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বলে বহুদিন ধরে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অভিযোগ করে আসছে। শ্রম আদালতে তার শাস্তি নিয়ে তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এছাড়া প্রায় নিয়মিতই ড. ইউনূসকে হয়রানি করা নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মিরপুরে টেলিকম ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস অভিযোগ করে বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ টেলিকমসহ তার প্রতিষ্ঠিত ৮টি প্রতিষ্ঠান ‘জবরদখল’ করে নিয়েছে। তিনি বলেছেন, আমরা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আছি। আমাদের ৮টি প্রতিষ্ঠান ‘জবরদখল’ হয়ে গেছে। গ্রামীণ ব্যাংক এখন নিজের মতো করে এসব প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তালা মেরে রেখেছে। তিনি বলেছেন, জীবনে বহু দুর্যোগ দেখেছি। এমন আগে কখনো দেখিনি। পুলিশের কাছে গিয়েও প্রতিকার পাইনি। জিডি করেছিলাম। জিডির কপি নিয়ে পুলিশ এসেছিল। কোনো সমাধান দেয়নি। ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠান জবরদখল হওয়া নিয়ে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র বেশ কড়া মন্তব্য করেছে। গতকাল জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমরা খুব বেশি অবগত। আমি বারবার বলেছি, বহু বছর ধরে জাতিসংঘের একজন অত্যন্ত মূল্যবান অংশীদার মিস্টার ইউনূস। তিনি আমাদের অফিসিয়াল এবং আনঅফিসিয়াল সক্ষমতায় আমাদেরকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। সহ¯্রাব্দ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সাধারণভাবে আমাদের উন্নয়নমূলক কাজকে ঘিরে যেসব উদ্যোগ রয়েছে, তা সমর্থন করেন তিনি। তাকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে যেসব রিপোর্ট আমাদের কাছে আসছে তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শ্রম আইনে করা মামলাটি অস্বাভাবিক গতিতে বিচার করা হয়েছে। অন্য একটি মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগপত্র দিয়েছে। তিনি বলেন, শ্রম আইন ও দুর্নীতি দমন আইনের অপব্যবহারের ফলে বাংলাদেশে আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে ড. ইউনূসের মামলা নিয়ে বরাবরই আইনি প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা, হয়রানির অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ যেভাবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছে, তা দেশের জন্য সুখকর বিষয় নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আখেরে এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতি ও ভাবমর্যাদাকে ক্ষতির সম্মুখীন করবে। দেশের অর্থনীতি এখন অত্যন্ত কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। মানুষের আয় কমে গেছে, হু হু করে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে, অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নি¤œগামী। ডলার সংকট, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে খরা, আমদানি-রফতানি হ্রাস, জ্বালানি সংকট ইত্যাদির কারণে অর্থনীতি অত্যন্ত ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও গণতন্ত্রের সংকোচনের মতো পরিস্থিতি রয়েছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রকাশিত ডেমোক্রেসি ইনডেক্স ২০২৩ অনুযায়ী, বিশ্ব গণতান্ত্রিক সূচকে দুই ধাপ অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। ২০২৩ সালে বিশ্বের ১৬৫টি দেশ ও দুটি অঞ্চলের মধ্যে ৫ দশমিক ৮৭ স্কোর নিয়ে ৭৫তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এটা দেশের জন্য সুখকর নয়। কোনো দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনীতির অবনমন, গণতন্ত্রের সংকট তীব্র আকার ধারণ করলে, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সে দেশের ভাবমর্যাদা যেমন ক্ষুণœ হয়, তেমনি আস্থার ঘাটতি দেখা দেয়। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারিরা বিনিয়োগে ভরসা পায় না। এটা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নানা চেষ্টা করেও বাড়ানো যাচ্ছে না। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক তৃতীয় টার্মিনাল করা হলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কিংবা বিনোয়োগ তেমনভাবে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইতোমধ্যে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। এতে কর্মসংস্থান আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। কর্মসংস্থানের অভাবে পরিবার ও সমাজে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। যুব সমাজের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায়, ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ ও প্রভাবশালী দেশগুলো যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, নিদারুণ সংকটের মধ্যে তা বাড়তি সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই ইস্যু নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যে শঙ্কা ব্যক্ত করেছে, তা কোনোভাবেই স্বস্তির বিষয় নয়। বলা বাহুল্য, দেশটি কূটনৈতিক ভাষায় যে বক্তব্য দিয়েছে, তা অন্যান্য দেশের বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা কোনোভাবেই দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

ড. ইউনূস কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন যে, তাকে নিয়ে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সরকারকে সমালোচনা বা বিরোধিতা করতে হবে। সরকারের আচরণে প্রতীয়মান হয়, তাকে প্রতিপক্ষ ভাবা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি তার কর্মকা- দিয়ে বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছেন। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। তার নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করছে। অথচ দেশে তাকে নানাভাবে হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা যথাযথ ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। তাই বলে তার প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়া হবে এবং তিনি কোনো প্রতিকার পাবেন না, তা হতে পারে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের অর্থনীতির শোচনীয় পরিস্থিতি নিয়ে সরকার স্বস্তিতে নেই। পাশাপাশি গণতন্ত্র, আইনের শাসন ইত্যাদি নিয়ে যথেষ্ট চাপের মধ্যে রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে, ড. ইউনূসকে বিভিন্ন উপায়ে যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছে এবং তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে যে প্রতিক্রিয়া আসছে, তা সরকারের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা মনে করি, সরকারের এহেন বাড়তি চাপ নেয়া সঙ্গত নয়। বরং চাপ কমানো উচিত।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নয়ারের বিরল ভুল,হোসেলুর শেষের ম্যাজিক,রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে রিয়াল

নয়ারের বিরল ভুল,হোসেলুর শেষের ম্যাজিক,রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে রিয়াল

টার্গেট ১৬৫,'খুনে' হায়দরাবাদ জিতল দশ ওভার আর দশ উইকেট হাতে রেখেই !

টার্গেট ১৬৫,'খুনে' হায়দরাবাদ জিতল দশ ওভার আর দশ উইকেট হাতে রেখেই !

ডোনাল্ড লু’র সফরে রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্ব দেওয়া হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ডোনাল্ড লু’র সফরে রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্ব দেওয়া হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

২ বছর অপেক্ষা করতে হবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের

২ বছর অপেক্ষা করতে হবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের

ভারতের রক্তাক্ত নির্মমতায় নিশ্চুপ প্রধানমন্ত্রী: রিজভী

ভারতের রক্তাক্ত নির্মমতায় নিশ্চুপ প্রধানমন্ত্রী: রিজভী

ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফিরেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফিরেছেন মির্জা ফখরুল

আল্লাহ ‘রব্বুল আলামীন’-২

আল্লাহ ‘রব্বুল আলামীন’-২

বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে চায় তুরস্ক

বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে চায় তুরস্ক

বিএসইসিতে নতুন তিন কমিশনার নিয়োগ

বিএসইসিতে নতুন তিন কমিশনার নিয়োগ

গোমর ফাঁসে কামড়াকামড়ি

গোমর ফাঁসে কামড়াকামড়ি

সরকারের চলতি মেয়াদে ৬০ লাখ কর্মী পাঠানোর টার্গেট : প্রতিমন্ত্রী

সরকারের চলতি মেয়াদে ৬০ লাখ কর্মী পাঠানোর টার্গেট : প্রতিমন্ত্রী

সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী

সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন বয়কট সাংবাদিকদের

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন বয়কট সাংবাদিকদের

ফুলপুর উপজেলায আ'লীগ নেতা হাবিবুর চেয়ারম্যান নির্বাচিত, ভাইস চেয়ারম্যন সবুজ ও পান্না

ফুলপুর উপজেলায আ'লীগ নেতা হাবিবুর চেয়ারম্যান নির্বাচিত, ভাইস চেয়ারম্যন সবুজ ও পান্না

নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত বলেই কেন্দ্রে ভোটারের আকাল : মেজর হাফিজ

নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত বলেই কেন্দ্রে ভোটারের আকাল : মেজর হাফিজ

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা আজ

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা আজ

৪৮ বছরে বিদেশ গেছে এক কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার কর্মী

৪৮ বছরে বিদেশ গেছে এক কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার কর্মী

ঢাবি প্রফেসর বাহাউদ্দীনের চৌর্যবৃত্তি তদন্তে কমিটি গঠন

ঢাবি প্রফেসর বাহাউদ্দীনের চৌর্যবৃত্তি তদন্তে কমিটি গঠন

আটোয়ারীতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড.আনিছুর রহমান

আটোয়ারীতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড.আনিছুর রহমান

মাধ্যমিকের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন জুলাইয়ে

মাধ্যমিকের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন জুলাইয়ে